রাতারাতি ‘টক অফ দ্য টাউন’। নাওয়াখাওয়ার সময় নেই! সব স্তরের সংবাদমাধ্যম ঢাকুরিয়া নস্করপাড়া লেনের ছোট্ট গলিতে। লগ্নজিতা চক্রবর্তীও অনর্গল। যাঁরা তাঁর কথা শুনতে চাইছেন, কাউকে ফেরাচ্ছেন না শিল্পী।
প্রশ্ন: লগ্নজিতা চক্রবর্তী তারকা?
লগ্নজিতা: (হেসে ফেলে) তারকা কি না জানি না। তবে জাতীয় স্তর থেকে নিজের শহরের সব সংবাদমাধ্যম আমার ঠিকানা জেনে গিয়েছে। একটি ঘটনার দৌলতে আমার ছোট্ট পাড়াটিও আলোচনার কেন্দ্রে। এখানে অনেকেই চেনেন না আমায়। এখন তাঁরাও এক ডাকে চিনছেন।
প্রশ্ন: আপনার কথা শুনতে হলে আপনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, ফোনে আপনি অধরা?
লগ্নজিতা: শনিবার রাত থেকে কিচ্ছু খাইনি। রবিবার দুপুরে কোনও রকমে খাবার মুখে তুললাম। অনবরত সাংবাদিকেরা আসছেন। কথা বলছেন। এর ফাঁকে কী করে ফোনে কথা বলব? সাক্ষাৎকার দেব? সেই ফাঁকটুকুও তো পাচ্ছি না!
প্রশ্ন: মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি খুব ভয় পেয়েছেন?
লগ্নজিতা: মা-বাবার সঙ্গেও কথা বলতে পারিনি! সমানতালে লোক আর ফোনের বন্যা বইছে। অন্য দিন বাড়ি থাকলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বসে খাই। রবিবার দুপুরে সেটাও হয়নি। রাতে আশা করছি একসঙ্গে বসে খাব আমরা। তখন কথা হবে। মা-বাবার সঙ্গে কথা হবে যে দিন ওঁদের কাছে যাব।
প্রশ্ন: সাত্যকি কি বেঙ্গালুরু থেকে চলে আসছেন?
লগ্নজিতা: সাত্যকির সঙ্গে হোয়াটস্অ্যাপে কথা হয়েছে। চলে আসবে কেন! ও প্রেম করার সময় থেকেই জানে, ওর বৌ নিজেরটা নিজেই সামলাতে পারে। (দম নিয়ে) আমি বিবাহিত। আমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি প্রত্যেকে ভীষণ ভাল। তার মানে এই নয়, আমার সব দায়িত্ব স্বামীর। নিজের অভিযোগপত্র নিজেই লিখতে পারি। তার জন্য বরকে দরকার পড়ে না। তাঁকে লিখেও দিতে হয় না (হাসি)।
কেন এ রকম ঘটল? ছবি: ফেসবুক।
প্রশ্ন: কী থেকে কী হয়ে গেল?
লগ্নজিতা: কী বলি বলুন তো! আমিই নিজে বুঝে উঠতে পারছি না। স্কুলের অনুষ্ঠান। আমাদের স্কুলেও এ রকম অনুষ্ঠান হত রবীন্দ্র সদনে। আমরা দল বেঁধে শুনতে যেতাম। সে রকমই একদল কচিমুখ আর তাদের মা-বাবা। সঙ্গে স্কুলের শিক্ষকেরা। মঞ্চে উঠলাম। কয়েকটি গানের পর স্কুল কর্তৃপক্ষ সম্মাননা জানালেন। আমি আবার গাইছি। ‘জাগো মা’ গাওয়া শেষ করেছি। হঠাৎ স্কুলমালিক মেহবুব মল্লিক মঞ্চে উঠে প্রায় মারতে এলেন! কী সমস্যা ওঁর কিচ্ছু জানি না। হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসি। থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করি।
প্রশ্ন: বাকিরা নির্বাক দর্শক?
লগ্নজিতা: না না! ওঁরাই তো মেহবুব মল্লিককে ধরে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। বের করে দিয়েছেন স্কুল থেকে। আমার কাছে বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু ওঁদের দোষ কোথায়? উপস্থিত অভিভাবকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গুটিয়ে গিয়েছিলেন সকলে।
প্রশ্ন: আপনার ‘জাগো মা’ শুনে স্কুল মালিক এ ভাবে জেগে উঠলেন কেন?
লগ্নজিতা: ওঁকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমার সঙ্গে কী ঘটতে পারত, কী ঘটেছে— সেগুলোই আমার সঙ্গে আছে। আর এত কিছুতে কি মাথা দেওয়া সম্ভব! আমি তো আমার মতো করে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলাম। আমার তো এটা কাজও নয়। তা ছাড়া, ঘটনা ঘটার পর মেহবুব মল্লিকের সঙ্গে আর দেখাও হয়নি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশেও বিনোদনদুনিয়া আক্রান্ত। ভারতেও কি তার আঁচ লাগল?
লগ্নজিতা: বলতে পারব না। মেহবুব মল্লিক কেন এই আচরণ করলেন, তিনিই জানেন। আমি ওঁকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।
প্রশ্ন: আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে আপনি ‘নিষিদ্ধ’। কাজ পাচ্ছেন না দু’বছর ধরে। কিন্তু আপনার গায়ে কেউ হাত তুলতে আসেননি...
লগ্নজিতা: সত্যিই, অনেক ঘটনা ঘটেছে। নানা রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। লড়াই করতে করতে এগিয়েছি। বাকিরা যে ভাবে এগোন। (মৃদু হেসে) কিন্তু এরকম সৌভাগ্য এই প্রথম।
প্রশ্ন: ভয় পেয়েছিলেন?
লগ্নজিতা: ভয় আমি পাই। কিন্তু সেই ভয়গুলো অন্য রকম। রেওয়াজে ফাঁকি দিলে ভয় করে। মা-বাবা বা শ্বশুর-শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়লে ভয় করে। বইয়ের পাতায় মন বসাতে না পারলে ভয় করে। ভুঁড়ি বেড়ে গেলেও ভয় করে। বিশ্বাস করুন, সে দিন একটুও ভয় পাইনি। কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল।
প্রশ্ন: এটা আপনার চেনা বাংলা নয়...
লগ্নজিতা: না, নয়। এই বাংলার এ রকম রূপ দেখিনি। দেখতে হবে সেটাও ভাবিনি। দেখার পর অন্য রকম লাগছে।
লগ্নজিতা কি ভয় পাচ্ছেন? ছবি: ফেসবুক।
প্রশ্ন: কবে বদলে গেল বাংলা? যে দিন থেকে দেশ ধর্মগন্ধী হয়েছে, কে কী খাবে, কী পরবে তাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, রাজ্যেও পরধর্মঅসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে কি সে দিন থেকে?
লগ্নজিতা: কিচ্ছু জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, যা ঘটল ঠিক ঘটল না। এ রকম কিছু ঘটা উচিত ছিল না।
প্রশ্ন: আপনি নাকি থানাতেও সঠিক ব্যবহার পাননি?
লগ্নজিতা: ভুল কথা। ওঁরা যা করা দরকার সঠিক ভাবে সেটা করেছেন।
প্রশ্ন: রাজ্য বিজেপি-র পক্ষ থেকে এ রকম বার্তাই দেওয়া হয়েছে...
লগ্নজিতা: ওরা কেন, কী বলেছেন কিচ্ছু জানি না। জানার মতো অবস্থাতেও নেই আমি।
প্রশ্ন: বিরোধী দল কী করে ঢুকে পড়ল?
লগ্নজিতা: আমার মঞ্চে আমার কর্তৃত্ব থাকার কথা। সেটাই যখন আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না যে কে উঠবেন, কে আমাকে মারবেন, সেখানে কে, কোথায়, কী বলবেন বা করবেন তারও দায়িত্ব কি আমার? আমার সঙ্গে যা হয়েছে সেটা অভিযোগপত্রে লেখা। সেই অভিযোগপত্র সব সংবাদমাধ্যমের হাতে হাতে ফিরছে। প্রকৃত ঘটনা সেটাই।
প্রশ্ন: এখন এ-ও শোনা যাচ্ছে, আপনি বিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছেন...
লগ্নজিতা: সামনেই নির্বাচন। তা হলে এখনই আমায় নাম লেখাতে হবে। আমিও এখানে আছি। বিরোধী শিবিরও আছে। একটু ধৈর্য ধরুন। আমি যোগ দিলে সেটাও সাংবাদিকেরা জানতে পারবেন। প্রার্থী হিসাবে আমার নাম ঘোষণা হবে। ভোটের ফলাফল দেখেও বুঝতে পারবেন। আমি যোগ দিলাম কি না, পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: আপনাকে শাসকদলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন..
লগ্নজিতা: আমি ওঁর ভিডিয়োবার্তা দেখেছি। কুণালকে আন্তরিক ধন্যবাদ, আমায় এ ভাবে সমর্থন জানানোর জন্য।
প্রশ্ন: আরজি কর-কাণ্ডের পরে শাসকদলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। চাইছিলেন, আলোচনায় বসতে। এ ভাবেই কি রাস্তা তৈরি হল?
লগ্নজিতা: আমি জানি না। এই ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনাকে জড়াতেও চাই না। এই ঘটনা রাস্তা খুলে দিল কি না, তাই নিয়েও ভাবিত নই। আমার সঙ্গে এটা ঘটেছে শনিবার। আমি আমার রাজ্যের প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি। পুলিশ গ্রেফতার করেছে মেহবুব মল্লিককে। আমি চাই, উনি যেন ছাড়া না পান। উনি ছাড়া পেলে ওর মত আরও অনেকে এটাই করবেন। আমার সঙ্গেও করবেন। বাকিদের সঙ্গেও করবেন।
প্রশ্ন: পেশাদুনিয়ার সহকর্মীরা খবর নিয়েছেন?
লগ্নজিতা: প্রত্যেকে। বড়, সমবয়সি, ছোট— সবাই ফোন করে জানিয়েছেন, পাশে আছেন। আমি যেন ভয় না পাই। সাবধানে থাকি। কী যে ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে, আমি একা নই।
লগ্নজিতার আগামী পরিকল্পনা কী? ছবি: ফেসবুক।
প্রশ্ন: নিরাপত্তারক্ষী রাখবেন?
লগ্নজিতা: দেখুন, আমি সত্যিই সব দিক থেকে ছোট। আকারে, সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে, অর্থকরী দিক থেকেও। ছোট্ট পাড়ায় ছোট্ট আবাসনে বাস। ওঠানামার জন্য লিফট নেই। এবং এই ভাবে থেকেই আমি খুশি। এই অবস্থায় নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে হাঁটলে লোকে তো হাসবে! তা ছাড়া, তাঁদের ব্যয়ভারই বা বহন করব কোথা থেকে?
প্রশ্ন: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পীদের অপমান সহ্য করেন না। তাঁকে জানাবেন?
লগ্নজিতা: আমার পড়াশোনা বলে, ‘মুখ্যমন্ত্রী’ পদ বিশাল বড়। যে কোনও ঘটনায় তাঁর কাছে দ্বারস্থ হওয়ার মতো পদ নয়। বাংলার প্রশাসনের উপরে যথেষ্ট ভরসা আছে। তারাই পুরোটা সামলে নিতে পারবে।
প্রশ্ন: লগ্নজিতা কি দিন কয়েক অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকবেন?
লগ্নজিতা: দূরে থাকব কেন! ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠান আছে আরামবাগে। আমি যাব। সেখানেও আমার সপ্তম গান হবে ‘জাগো মা’। আমার বিশ্বাস, ওই দিন মার না খেয়েই অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরব।