Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ফ্যাব ফাইভ

এক সময় ফ্যাবিউলাস ফাইভ বলা হত সচিন-সৌরভ-দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ-কুম্বলেকে। আজ টালিগঞ্জে একই নামেই ডাকা শুরু হয়েছে পাঁচজনকে। আবির, শাশ্বত, ঋত্বিক, যিশু আর পরমব্রত। কেন? লিখছেন ইন্দ্রনীল রায়এক সময় ফ্যাবিউলাস ফাইভ বলা হত সচিন-সৌরভ-দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ-কুম্বলেকে। আজ টালিগঞ্জে একই নামেই ডাকা শুরু হয়েছে পাঁচজনকে। আবির, শাশ্বত, ঋত্বিক, যিশু আর পরমব্রত। কেন? লিখছেন ইন্দ্রনীল রায়

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

দিন পাঁচেক আগে কলকাতা লিটারেরি মিট-এ হাজির ছিলেন দুই ‘গোয়েন্দা’— আবির ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের নিয়ে দর্শকদের মধ্যে শুরু হল তুমুল হইচই। শুধু হ্যান্ডশেক আর সেলফি তুলতেই কেটে গেল পনেরো মিনিটেরও বেশি সময়।

এক সপ্তাহ আগে বেঙ্গালুরু এয়ারপোর্টের চেক ইন কাউন্টারের এক বাঙালি কর্মী হঠাৎ বোর্ডিং পাস দিয়ে একটা ছবি তোলার রিকোয়েস্ট করে বসলেন যিশু সেনগুপ্তর কাছে।

কিছু দিন আগে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ছবির প্রচারে গিয়েছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে শুধু তাঁকে দেখতেই ভিড় করেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা।

একই মাতামাতি সাত দিন আগে সাউথ সিটি মলে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে নিয়ে। প্রিমিয়ার শোতে তিনি ঢুকছেন দেখে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা এক বাঙালি দম্পতি।

একটা সময় ছিল যখন সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ আর অনিল কুম্বলেকে বলা হত ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ফ্যাবিউলাস ফাইভ’। ছোট করে ‘ফ্যাব ফাইভ’।

ওই ক্রিকেটারদের ক্ষেত্র এবং পরিধি আন্তর্জাতিক হলেও সেই রেশ টেনেই আজকের টলিউডও পাঁচজন অভিনেতা সম্বন্ধে একই কথা বলা শুরু করেছে। নতুন ঘরানার বাংলা ছবি এতটাই জনপ্রিয়তা দিয়েছে তাঁদের।

আবির, শাশ্বত, ঋত্বিক, যিশু আর পরমব্রত। টালিগ়ঞ্জের ‘ফ্যাবিউলাস ফাইভ’। ‘ফ্যাব ফাইভ’।

কখনও ভিলেন, কখনও সাধারণ কেরানি, কখনও খুনি

কিন্তু আজকে, ২০১৫-র ফেব্রুয়ারিতে, হঠাৎ কেন তাঁদের উপর এতটা ভরসা করছে টলিউড?

কী এমন হল যে প্রসেনজিৎ-দেব-জিতের মতো হেভিওয়েট নায়ক থাকতেও এই পাঁচজনকে নিয়ে এমন পাগলামি করছে প্রযোজক, পরিচালক থেকে দর্শক— সবাই?

‘‘আপনাকে বুঝতে হবে টলিউড বদলে গিয়েছে। আজ বুদ্ধিদীপ্ত ছবি হচ্ছে। শহর থেকে শহরতলির দর্শক এমন ছবিই পছন্দ করছেন। আর গত দেড় বছরে এটা অন্তত আমরা বুঝে গিয়েছি তামিল-তেলুগু রিমেক আর চলবে না। এই পাঁচজন কোনও দিন তামিল-তেলুগুর রিমেক করবে না। কখনও তারা ভিলেন, কখনও তারা সাধারণ কেরানি, কখনও তারা খুনি। এই ভ্যারাইটিটা এদের পাঁচজনেরই রয়েছে। তাই এরা ভবিষ্যতেও বক্স অফিস মাতাবে,’’ বলছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়।

তার মানে কি আজকে দেব, জিৎ, অঙ্কুশদের এই ফ্যাব ফাইভ সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন? ‘‘দেখুন, ইন্ডাস্ট্রিতে ও রকম কেউ কাউকে চ্যালেঞ্জ জানায় না। দেব আর জিৎও তো বুদ্ধিদীপ্ত ছবির দিকেই ঝুঁকছে। দেব ‘বুনো হাঁস’ আর ‘চাঁদের পাহাড়’ করল। জিৎ ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ করল। এই পাঁচজন, কমার্শিয়াল ছবির নায়কদের এত দিনকার খেলার স্টাইলটাও বদলাতে বাধ্য করেছে,’’ খোলাখুলি বলছেন সৃজিত ।

এবং এটা ঘটনা যে, গত বছরের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়া, ‘আবার ব্যোমকেশ’ ও ‘বাদশাহী আংটি’ দু’টো ছবিতেই দর্শক দারুণ পছন্দ করেছেন আবির চট্টোপাধ্যায়কে। এই বছরের প্রথম ব্লকবাস্টার হিট নিঃসন্দেহে দোসরা জানুয়ারি মুক্তি পাওয়া শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের ‘এবার শবর’।

গতবছর পুজোর সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চতুষ্কোণ’ যে গত ছ’মাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত হিট, সেটাও নিশ্চিন্তে বলা যায়। আর সেই ছবিতে পরমব্রতর অভিনয় নিয়ে শোরগোল প্রথম দিন থেকেই।

আর ‘শব্দ’র পর থেকে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে নিয়ে দর্শকদের কৌতূহল সর্বক্ষণ। বলা হয়, তিনি যে ছবিতে অভিনয় করেন সেই ছবিতে তিনিই বাকি শিল্পীদের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান।

বাকি রইলেন যিশু। এক সময় কমার্শিয়াল ছবি করলেও আজকে যিশু সেনগুপ্তের ফিল্মোগ্রাফিতে সৃজিত, অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেনের ছবি জ্বলজ্বল করছে। ‘জাতিস্মর’‌য়ের পর তাঁর যেন নবজন্ম হয়েছে টলিউডে। আবির-পরবর্তী ব্যোমকেশেও তিনি। তিনিই নতুন ব্যোমকেশ এখন থেকে।

হাওড়া পেরোলে ছবিটা বদলায়নি

নানা ধরনের চরিত্র করার সাহস, সঙ্গে বক্স অফিস সাফল্য— এই যুগলবন্দির জোরেই এই ফ্যাব ফাইভ পিছনে ফেলে দিচ্ছেন ‘খোকা’, ‘রোমিও’ আর ‘বস’‌কে।

জানুয়ারি মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত অঙ্কুশের ‘রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট’‌য়ের রিপোর্ট ভাল হলেও ছবি চলেনি। দেবের ‘হিরোগিরি’র অবস্থাও এক। আর ‘বচ্চন’‌য়ের পর জিৎ একটা ছবিরও শ্যুটিং করছেন না। শোনা যাচ্ছে এক কোটি টাকা দর হাঁকছেন বলে বেশ কিছু প্রোডিউসর তাঁর সঙ্গে কাজ করতে খুব ইচ্ছুকও নন।

তবে ফ্যাব ফাইভ যে দেব-জিৎকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছেন একেবারেই মানছেন না অশোক ধানুকা।

‘‘হ্যাঁ, আবির, পরম, যিশু, ঋত্বিক আর শাশ্বত খুবই ভাল। আমিও প্রযোজক হিসেবে ওরা যে রকম ছবি করে, তেমন ছবি করতে চাইছি। তা সত্ত্বেও বলছি এই পাঁচজনের অ্যাপিল শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ। হাওড়া পেরোলেই কিন্তু ছবিটা অন্য। ওখানে দেব, অঙ্কুশ, জিৎদের রমরমা। শহরতলির হলগুলো বাঁচাতে কিন্তু আমাদের দেব-জিৎ-অঙ্কুশকে লাগবে। শুধু মাল্টিপ্লেক্স এই ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে পারবে না,’’ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলছেন অশোক ধানুকা।

লগ্নি আনুমানিক ৩০ কোটি

অন্য দিকে মৈনাক ভৌমিকের মতো পরিচালক বলছেন এই পাঁচজনের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ দর্শক এই পাঁচ জনের সঙ্গে ‘আইডেন্টিফাই’ করছেন বেশি।

‘‘পরম, ঋত্বিক, যিশু, শাশ্বত, আবিরকে দেখলে ইন্টেলিজেন্ট মনে হয়। ‘বয় নেক্সট ডোর’ মনে হয়। দূর গ্রহের কোনও নায়ক মনে হয় না। সেটাই ওদের ইউএসপি। নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে ফ্যাব ফাইভের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে ইন্ডাস্ট্রি,’’ নিজের পরের ছবি ‘চলচ্চিত্র সার্কাস’‌য়ের শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বলছিলেন মৈনাক। এবং নির্ভর যে এঁদের উপর কতটা করছে টলিউড, তা এই পাঁচজন অভিনেতার হাতে ছবির সংখ্যা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

এই মুহূর্তে পরমব্রতর হাতে ছ’টা ছবি। শাশ্বতর হাতে আটটা। ঋত্বিক আর যিশুর হাতে পাঁচটা করে ছবি। আবির করছেন চারটে। টলিউডের নামীদামি প্রযোজকদের মতে শুধু এঁদের পাঁচজনের উপরেই লগ্নি রয়েছে আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা।

অন্য দিকে দেবের হাতে এখন দু’‌টো ছবি, জিতের হাতে কোনও ছবি নেই আর অঙ্কুশের হাতে দু’টি ছবি।

তা হলে এই পাঁচজনের হাত ধরে কি নায়কের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেল টলিউডে?

‘‘অবশ্যই পাল্টালো। বাণিজ্যিক বাংলা ছবি এখন ‘চতুষ্কোণ’, ‘অপুর পাঁচালি’, ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ আর ‘এবার শবর’‌য়ের মতো ছবিগুলো। আমাদের এটা এ বার মেনে নেওয়া উচিত,’’ আইফোন সিক্সে অ্যাপ ডাউনলোড করতে করতে সে দিন বলছিলেন প্রযোজক রানা সরকার।

তারপর যোগ করেন, ‘‘আর দেখুন এই পাঁচ হিরোর অভিনয়- ক্ষমতা বিতর্কের উর্ধ্বে। এদের বাংলা উচ্চারণেও কোনও অস্পষ্টতা নেই। সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট, এদের কোনও তামিল বা তেলুগু ছবির উপর ভরসা করতে হয় না। আগামী বেশ কিছু বছর এই পাঁচজনই ভরসা।’’

আজও রোববার মাংস-ভাত

ভরসাটা এতটাই যে আজ প্রায় সব প্রোডিউসর এঁদের ডেট পাওয়ার জন্য মরিয়া। জনপ্রিয়তা যদি একটা কারণ হয়, তা হলে তার বাইরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে, এমনটাই মনে করছেন অনেকে।

‘‘দেব-জিৎরা একটা ছবি করতে ৬০-৭০ লাখ বা তার বেশি টাকা নেয়। কিন্তু এই পাঁচজনের একজনেরও যদি স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়, তা হলে তারা মাত্র ৫ লাখেও ছবি করতে রাজি। এদের কাছে রোলটা ইম্পর্ট্যান্ট, টাকাটা সেকেন্ডারি। এই ফ্লেক্সিবিলিটিটা প্রোডিউসররা পছন্দ করছে। আর তা ছাড়া, দেব-জিতের ছবি না চললে লসটা অনেক বেশি। সেই তুলনায় এই পাঁচজন অনেক ‘সেফ’,’’ বলছেন নামী এক প্রযোজক।

মুখে না বললেও এই পাঁচজন ‘সেফ’ অভিনেতার জনপ্রিয়তা মেনে নিচ্ছেন কমার্শিয়াল ‘সুপারস্টার’রাও। ভিতরের খবর অনুযায়ী জিৎ নাকি এখনই একটা ছবি করার কথা ভাবছেন যেখানে ভিলেনের রোল তিনি চাইছেন পরমব্রত করুন। অপর্ণা সেনের পরের ছবিতেও দেবের পাশাপাশি রয়েছেন যিশু।

পরমব্রতরা কী বলছেন?

‘‘এটুকু বলতে পারি, আমাদের রেসপনসিবিলিটি অনেক বেড়ে গেল। আরও ভাল কাজ করার চেষ্টা করব আমরা পাঁচজন,’’ খানিক লজ্জা পেয়ে বলছেন পরম। একই অবস্থা বাকি চারজনের।

সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, আজকের টলিউডে অন্তত শহরের বিশিষ্ট তারকা এঁরাই। কিন্তু সুপারস্টার হওয়া সত্ত্বেও আজও তাঁরা পাড়ার ছেলে। আজও বিরাট কোহলি রান না করতে পারলে তাঁদের দুঃখ হয়। আজও লেক মার্কেটে পমফ্রেট মাছের দাম হঠাৎ কেন বেড়ে গেল তা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। আজও বাড়ি আর গাড়ির ইএমআই দেন। এবং রোববার দুপুরে মাংস-ভাত খান।

আবির, শাশ্বত, ঋত্বিক, যিশু আর পরমব্রত।

টলিউডের ফ্যাব ফাইভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fav five indranil roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE