Advertisement
E-Paper

এই ছবি আপনাকে দেখতেই হবে, কেন জানেন?

নিজের ব্যাটিং মানচিত্র যেমন প্রথাগতভাবে না চলে অদ্ভুত সব রাস্তা আর অ্যাডভেঞ্চারের মাইন পেতে রাখে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি-কে ঘিরে সিনেমাটাও তাই। গৌতম ভট্টাচার্য দোনামনায় পড়লেন। হলে আছেন, না প্রেসবক্সে?নিজের ব্যাটিং মানচিত্র যেমন প্রথাগতভাবে না চলে অদ্ভুত সব রাস্তা আর অ্যাডভেঞ্চারের মাইন পেতে রাখে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি-কে ঘিরে সিনেমাটাও তাই। গৌতম ভট্টাচার্য দোনামনায় পড়লেন। হলে আছেন, না প্রেসবক্সে?

সৌরভরা বিশ্বকাপ ফাইনালে। ধোনি খড়গপুরে টিকিট কালেক্টর

সৌরভরা বিশ্বকাপ ফাইনালে। ধোনি খড়গপুরে টিকিট কালেক্টর

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৫
Share
Save

২০১১-র এপ্রিল না। ওয়াংখেড়ের মায়াবী রাত না।

২০০৬-র নভেম্বর। ডারবানের এক গতানুগতিক বিকেল।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনির হোটেল রুমের লোকেশনটা এখনও হুবহু মনে রয়েছে। লিফট থেকে নেমে ঠিক বাঁদিকে। ঘরের সাইজ? স্ট্যান্ডার্ড ডাবল রুম যেমন হয় তার চেয়েও ছোট। তখন ক্যাপ্টেন্সি দূর অস্ত। সহ অধিনায়কত্ব নিয়েও ভাবার সময় হয়নি। নিছক টিমের জুনিয়র ক্রিকেটার। তাতেও অবশ্য যা মনোভাব, প্রমাদ গুনে ওঁর ঘনিষ্ঠ একজন আমাকে পাঠিয়েছেন হার্ট টু হার্ট কিছু কথা বলতে। যদি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অংশের ফিডব্যাক পেলে ধোনির সামান্য চৈতন্য হয়।

ভারতীয় ক্রিকেট মিডিয়া আর মহেন্দ্রবাবুর মধ্যে এখনকার চিনের প্রাচীর তো সেই সময় তোলা ছিল না। সরাসরি কথা বলা যেত। ঘরে ঢুকে শুরুতেই বললাম, আজ সাংবাদিক নয়। শুভানুধ্যায়ী হয়ে দু-চারটে কথা বলতে এসেছি। তিনি কি শুনবেন?

ধোনি বললেন, নিশ্চয়ই। এর পরের কথোপকথন হুবহু তুলে দিচ্ছি। দশ বছর আগের ঘটনা হলেও মনে হয় না একটা শব্দ ভুল হবে বলে।

ধোনি কিছু মনে করবেন না, আপনি ইরফান পাঠানের সঙ্গে এত মিশছেন কেন?

‘‘মানে?’’

মানে এটাই যে আমাদের মনে হচ্ছে এখনকার ইরফানের নেগেটিভ মাইন্ড সেটটা কোথাও আপনার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ইরফান প্রতিনিয়ত মিডিয়ার সমালোচনা করছেন তো তাল ধরে আপনিও করছেন। কেন বুঝছেন না যে ইরফানকে ক্রমাগত গ্রেগ চ্যাপেলের তিন নম্বরে পাঠানো নিয়ে ক্রিটিসিজমটা হচ্ছে। ইরফান ক’টাতে রান পাচ্ছে বলুন তো যে মিডিয়া ভাল লিখবে?

‘‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। মিডিয়া মোটেও ইরফানের ব্যর্থতা নিয়ে লেখার মধ্যে থেমে নেই। টিভি চ্যানেলগুলো নিত্যদিন ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছে। এদের কী এক্তিয়ার আছে আমায় বলুন তো?’’

কী দরকার আছে ধোনি আপনার এ সবে ঢোকার? আপনি যাদের গালাগাল করছেন সেই এনডিটিভি, আজ তক, এবিপি নিউজ দেশের সব বড় বড় চ্যানেল। অত্যন্ত প্রভাবশালী। আপনি যতই ব্যক্তিগত মহলে সমালোচনা করুন কথাগুলো তো কানে চলেই আসছে। আর মিডিয়া তত অবাক হচ্ছে। কোথাও তো কেউ আপনাকে খারাপ বলেনি। বরং সবাই প্রশংসা করে। ধোনি, আপনি হচ্ছেন উঠতি নক্ষত্র। ইরফান পড়তির দিকে। কেন ওর জন্য খামকা নিজের স্বার্থ বলি দিচ্ছেন?

‘‘এগুলো কোনও কথাই নয়। অন্যায়টা অন্যায়। আর টিভি চ্যানেলগুলো যা করছে তাতে এদের সমর্থনের কোনও জায়গা নেই।’’

ধোনি এ বার গম্ভীর হতে শুরু করেছেন। বললেন, ‘‘আরও অভিযোগ নিশ্চয়ই আছে? পরেরটায় চলুন।’’

বললাম, কতটা সত্যি জানি না। শুনলাম সুনীল গাওস্করকে আজ পর্যন্ত আপনি হ্যালো বলেননি। সত্যি?

‘‘ইয়েস, বাট এর মধ্যে বিশাল করে দেখার কী আছে? তেমন কোনও অপরচুনিটি আসেনি। যে দিন আসবে নিশ্চয়ই বলব।’’

কী বলছেন বলুন তো! আমি তো আপনাকে বলার সময়ও ভাবছিলাম নির্ঘাত কথাটা মিথ্যে শুনেছি। এখনও অবিশ্বাস্য লাগছে! আপনি দেশের হয়ে দু’বছরেরও বেশি ক্রিকেট খেলছেন। আর গাওস্করের সঙ্গে কিনা আপনার আলাপ নেই।

‘‘বললাম তো তেমন কোনও পরিস্থিতি হয়নি। আমি যখন মাঠের মধ্যে ওঁকে দেখি, হয় উনি কাউকে ইন্টারভিউ করছেন। বা ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোনও দিকে দৌড়়চ্ছেন। তখন গিয়ে হ্যাংলার মতো ঝাঁপাব, বলব হ্যালো স্যর আমি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। হয় নাকি কখনও?’’

আরে আপনি তো শুধু মাঠে ওঁর সঙ্গে কথা না বলা নয়। গাওস্করের কোম্পানি গতকাল যে ক্যাস্ট্রল অ্যাওয়ার্ডটা এখানে অর্গানাইজ করল সেই ফাংশনেও যাননি।

‘‘না, যাওয়া হয়নি।’’

কী বলছেন যাওয়া হয়নি! তেন্ডুলকর গেছেন। দ্রাবিড় গেছেন। চ্যাপেল গেছেন। আপনার জন্য সেখানে একটা অ্যাওয়ার্ডও ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারের। এমন নয় যে অ্যাওয়ার্ডটা দূরে কোথাও হচ্ছিল। এই হোটেলেই ছিল।

‘‘আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’’

ধোনি, আপনি খুব বেশি দিন ইন্ডিয়ার হয়ে খেলছেন না তো। তাই জানেন না ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের পাওয়ার মিটারে গাওস্কর ঠিক কোথায়! ওঁর বিভূতি ছাড়া কিছু হয় না। আপনি না যাচ্ছেন তাঁর ফাংশনে। না তাঁকে হ্যালো বলছেন। বিপদ তো নিজেই ডেকে আনছেন।

এর পর উঠে পড়ি। মনে হয়েছিল এই লোককে কিছু বোঝাতে যাওয়ার মানে হয় না। তখন কী করে জানব লোকটা শুধু ক্যাস্ট্রল অ্যাওয়ার্ড নয়। ২০০৯-তে পদ্মশ্রী পেয়েও সেটা নিতে যাবে না। বহু মাস বাদে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যসচিব তাঁকে অনুরোধ-টনুরোধ করে ওটা হাতে তুলে দিতে পারবেন।

সেদিন দরজা অবধি এগিয়ে দিতে এসে ধোনি বলেছিলেন, ‘‘ইরফানের ব্যাপারটা যেটা বললেন সেটা ভেবে দেখব। করব কিনা জানি না। তবে মিস্টার গাওস্করের ইস্যুতে আমি এখনও অনড়। উনি ব্যস্ত থাকলে নিজে থেকে হ্যালো বলতে যাব না।’’

যিনি ধোনির সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন তাঁকে সেদিন রাতেই জানিয়ে দিই এই মনোভাব নিয়ে চললে আপনার প্রিয় ছাত্রের ইন্ডিয়া ক্যাপ দ্রুতই চলে যাবে। গ্রেগ চ্যাপেলের মুখে তখন নিয়মিত ধোনির ওয়ার্ক এথিকের প্রশংসা শুনছি। তবু মনে হয়েছিল এত গোঁয়ারগোবিন্দ মনোভাবকে নিরাপত্তা দেওয়ার পথে সেটাও যথেষ্ট হবে না।

কাট টু। ওয়াংখেড়ের দোসরা এপ্রিল। একটা লোক গোটা টুর্নামেন্ট রান না পেয়ে কোথায় ভিতু, জড়সড় থাকবে কাপ ফাইনালে। তা নয় টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ইন ফর্ম প্লেয়ারকে পিছনে পাঠিয়ে বিপজ্জনক মুরলিধরনের বিরুদ্ধে নিজে নেমে পড়ল ব্যাট করতে। জয়সূচক বিশাল ছক্কাটা মেরে জাস্ট ব্যাটটা একবার গদার মতো ঘোরালো। তারপর শান্ত হয়ে গেল। পরের দিন ভোরে বেমালুম ন্যাড়া হয়ে চলে এল।

যা দেখে দেব আনন্দের মতো মানুষ হাঁ হয়ে গেছিলেন। ‘‘একটা লোক এ রকম চাপের মুখে বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতিয়ে দিয়ে কিনা পরের দিন ন্যাড়া হয়ে গেল। কী অসম্ভব সিনেমাটিক।’’

মাসকয়েক আগে নাইট শো-তে আজহারের বায়োপিক দেখতে গিয়ে হাফ টাইমের পরে ঘুমিয়ে পড়ি। মেরি কম-য়েরটাও আহামরি কিছু লাগেনি। ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ দেখতে গিয়ে মনে হল কেন আরও একটু লম্বা হল না? বিস্ময়কর সততার সঙ্গে নিজের জীবনকে পেশ করেছেন ধোনি। ফিল্মটা দেখতে দেখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পৌঁছে যাই। প্রেস বক্সে আছি না হল-য়ে? রুপোলি পর্দায় রাঁচির অনামী ছেলেটার জীবনকাহিনি দেখছি? নাকি স্বয়ং ধোনি এক হাতের মধ্যে বসা?

ধোনির ঘনিষ্ঠরা জানতেন জীবনের প্রথম প্রেমে মৃত্যুর আচমকা আবির্ভাব তাঁকে কেমন ডিপ্রেশনের মোডে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটির সঙ্গে প্লেনে আলাপ হয় তাঁর। নাম প্রিয়াঙ্কা। এক-দেড় বছর ধরে প্রেম ক্রমশ ঘন হচ্ছে এমন অবস্থায় আচমকা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান প্রিয়াঙ্কা। ফিল্মে দেখানো হয়েছে একা ড্রাইভ করছিলেন। বাস্তবে বিয়েবাড়ি থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ফিরছিলেন। ফিল্ম দেখাচ্ছে মাটিতে শুয়ে পড়ে ধোনির কান্না। বাস্তব হল প্রকাশ্যে আছড়ে পড়ে না কাঁদলেও যন্ত্রণায় সাময়িক পাথর হয়ে যান তিনি। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিস্ময়, এত বছর বাদে সেই সম্পর্ককে খোলাখুলি মানুষের সামনে নিয়ে আসতে ইতস্তত বোধ না করা।

রেলওয়েজের ট্রায়ালে যে তাঁকে মাত্র এক ওভার কিপিং আর তিনটে বল ব্যাট করতে দেওয়া হয়েছিল তা তো সিনেমা নয়। সত্যি ঘটে ছিল উঠতি ধোনির জীবনে। তাঁর বাবা পান সিংহ তো ব্যক্তিগত জীবনে পাম্প অপারেটরই। ধোনিরা দু’ভাই এক বোন। বড় দাদাকে ফিল্মে দেখানো হয়নি। কিন্তু গোটা রাঁচির পরিবেশ আর ব্যক্তিগত বন্ধুরা সবাই তো হাজির। সচিনের যেমন অজিত, ধোনির তেমনি এই চার বন্ধু। ফিল্মে দেখাল দু’হাজার তিন বিশ্বকাপ ফাইনাল বন্ধুদের সঙ্গে বসে দেখছেন। সচিন আউট হতেই টিভির সামনে থেকে উঠে গেলেন। সত্যি তাই ঘটেছিল। তিনি তখন খড়গপুরের টিকিট কালেক্টর। একটা সময় ক্রমাগত বিরক্তিকর রুটিন। আর ট্রেন ডিউটি করতে করতে তাঁর সত্যিই মনে হয়েছিল আমার বাড়িতে চূড়ান্ত দারিদ্র। চাকরিটা দরকার। সবই ঠিক। কিন্তু আমি চালিয়ে খেলব। আমি আমার স্বপ্নের সঙ্গে বাঁচব!

‘ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ দেখতে গিয়ে অনেকেই যে সফলতম অধিনায়কের ক্যাপ্টেন্সি পাসওয়ার্ড দেখতে পাচ্ছেন না তার কারণ খুব পরিষ্কার। এটা অধিনায়ক ধোনির কাহিনি নয়। এটা সেই ছেলেটির মনের অন্দরমহলের গল্প যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে তুবড়ে দেওয়ার মতো বুকের ছাতি দেখিয়েছিল। যে ক্রিকেটের জীবজগতে অপাঙক্তেয় রাঁচি শহর থেকে উঠে এসে বিশ্ব শাসন করে গেছে স্রেফ স্বপ্নের ময়ূরপঙ্খী নৌকোয় অদম্য ভেসে গিয়ে। সেই অনুপ্রেরণাটাই যেন ফিল্মের থিম সমালোচকদের ল্যাপটপের কোনও তোয়াক্কা না করে। ধোনির বাঁ চোখের নীচে যে তিলটা তাঁর ট্রেডমার্ক সেটা থেকে শুরু করে তাঁর হাঁটাচলা, চুলের স্টাইল, ব্যাট নিয়ে দাঁড়ানো, কিপিংয়ের ধরন অবিশ্বাস্য কপি করেছেন সুশান্ত সিং‌হ রাজপুত। এ বছরের প্রত্যেকটা বেস্ট অ্যাক্টর নমিনেশনে তিনি না থাকলে মনে হবে ধোনির পেস বোলিংয়ে ভয় পাওয়ার মতো চরম অস্বাভাবিক কিছু ঘটল।

তাঁর বাঙালি কোচ চঞ্চল ভট্টাচার্যের ভূমিকায় রাজেশ শর্মা। সেই কোচ যিনি খুদের গোলকিপিংয়ে দক্ষতা দেখে ফুটবল থেকে সরিয়ে উইকেট কিপিং করানো শুরু করেন। কোচের স্ত্রী মিঠু চক্রবর্তী থেকে শুরু করে স্ত্রী সাক্ষী — সবক’টা চরিত্র কী অসম্ভব জীবন্ত। ধোনি নিজে বসে চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে সিটিংয়ের পর সিটিং করেছেন বলেই রিল আর রিয়াল লাইফ এভাবে মিশে যাওয়া সম্ভব।

বায়োপিক-য়ে মুখ্য চরিত্র নিজে ভয়ঙ্কর বাস্তবসম্মত। সেটা একরকম। তাঁকে ঘিরে যে চরিত্রগুলো তারাও যে ভীষণ বাস্তব। কিরণ মোরে-প্রণব রায়েরা নির্বাচক হিসেবে স্বভূমিকায় রয়েছেন, সেটা বাদ দিচ্ছি। একটা চরিত্র রয়েছে যে ভারতীয় বোর্ডের প্রধান কর্তা। মাঝারি হাইট। চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। সাফারি স্যুট পরে। ট্যালেন্ট রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট উইং নামে অনুন্নত শহর থেকে প্লেয়ার তুলে আনার প্রকল্প চালু করতে চায়। সে যাকে চেয়ারম্যান হতে ডাকল সে লম্বা। গোঁফ আছে। নাম দিলীপ। ক্রিকেট অনুগামীদের আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সাফারি স্যুট জগমোহন ডালমিয়া। আর গোঁফওয়ালা — দিলীপ বেঙ্গসরকর। শুনেছি টি আর ডি এ স্কিমে ধোনিকে প্রথম স্পট করেন প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক প্রকাশ পোদ্দার। ফিল্মেও প্রকাশ বলে কেউ ধোনি নামক প্রতিভাকে খুঁজে পাওয়ার খবর প্রথম জানাচ্ছে দিলীপকে।

আজহার বায়োপিক সময় সময় হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটা জায়গায় যেমন আজহার সাফাই দিয়েছেন টিমের অন্যদের গড়াপেটাওয়ালাদের থেকে বাঁচাতে তিনি পুরো টাকাটা নিয়ে নিয়েছিলেন। ‘ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরি’-র সেরা দিক হল কোনও সাফাই নেই। আমি এরকম। আমাকে নিতে হলে এভাবেই নাও। অথবা নিও না।

নইলে সৌরভ-দ্রাবিড়কে বাদ দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে অবিকল ছবিটা দেখালেন কী করে? কুম্বলের টিম অস্ট্রেলিয়া সফর চলাকালীন সৌরভ-রাহুল যে ওয়ান ডে দল থেকে বাদ হয়ে যাবেন কেউ ভাবতেই পারেনি। ধোনি স্কাইপ-য়ে সিলেকশন মিটিং চলাকালীন সাফ বলেন, দুই সিনিয়রকে বাদ দিতে চাই তার কারণ এদের যোগ্যতা নয়। ফিটনেসের অভাব।

ভারতীয় ক্রিকেট মহল এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায় সেই সিদ্ধান্তে। দু’দিন পরে টিম ফ্লাইটে পারথ যাচ্ছিল। সিকিউরিটি লাইনে ধোনির সঙ্গে দেখা হতে বললেন, ‘‘শুনলাম আপনি খুব বিদ্বেষমূলক লিখছেন টিম সিলেকশন নিয়ে। ফোনে আমার কলকাতার বন্ধু বলল।’’ এর পর ধোনি প্রস্তাব দিলেন তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার। শুনে তাজ্জব লেগেছিল। ধোনি নিজে থেকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি — হলটা কী? পরের দিন ঘরে বসে ব্যাখ্যা করলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইদানীং আমরা কোন মার্জিনে হারছি দেখেছেন? কখনও ১৫ রানে। কখনও ১২ রানে। কখনও দু’ উইকেটে। মার্জিন কখনও বেশি নয়। সৌরভদের মতো স্লো ফিল্ডার অস্ট্রেলিয়ার বড় মাঠে থাকা মানে যেটার সিঙ্গলস হয় না সেটা ১ হবে। যেটা ১ হওয়ার কথা ছিল সেটা ২ হবে। মনে করুন গিলক্রিস্ট কী হেডেন টেলএন্ডার নিয়ে ব্যাট করছে। যে ওভারে সিঙ্গলস হওয়ার নয় সেটায় হয়ে যাবে। পরের বলটা গিলক্রিস্ট তুলে দিল ছক্কা। তার মানে একটা ভুল = ৭ রান। এমন দুটো ভুল হলেই তো সেই ডিফারেন্সটা ১৪/ ১৫ রানে চলে গেল। অনেক হয়েছে, আমি চাই ফিল্ডিংয়ে এই রান লিক হওয়াটা বন্ধ করতে।’’

সেবার ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারত যে প্রথম অস্ট্রেলিয়ার বুকে চ্যাম্পিয়ন হয় তার কারণ যত না ধোনির নেতৃত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি তেন্ডুলকরের বিক্রম। কিন্তু সিদ্ধান্তটা অসম্ভব বিতর্কিত হয়ে থেকেই গিয়েছিল। আট বছর পর নিজের প্রযোজনায় তৈরি ফিল্মে নির্বাচকদের ওপর কোনও দায়টায় না চাপিয়ে পুরোটাই নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন ধোনি। সাহস -সাহস-বন্য সাহস ছাড়া — এ জিনিস হয় না!

ক্রিটিক নয়, নিছক ক্রিকেট অনুসারী হয়ে ফিল্মটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ধোনিকে একেবারে ঠিকভাবে তুলে ধরা হল। অদ্ভুত ব্যতিক্রমী একটা মনন। সাফল্যে একমাত্র নিজের মধ্যে কাউন্টার খুলব। ব্যর্থতাতেও তাই। আমার মধ্যে যখন যা-ই ঘটুক পূর্ণিমা বা অমাবস্যা বাইরের কাউকে কুপন দেব না।

ধোনির ম্যানেজার অরুণ পাণ্ডে বলে থাকেন খেলা ছাড়ার পর ধোনিকে আপনারা খুঁজেই পাবেন না। ‘থ্রি ইডিয়টস’-য়ের গানটা তখন গুনগুন করে মনে আসবে —

বেহতি হাওয়া সা থা ওহ

উড়তি পতঙ্গা সা থা ওহ

কহা গয়া উসে ঢুন্ডো

নির্মাতারা যে টাকায় ক্রিকেটের রিয়াল ফুটেজ কিনেছেন তাতে তিনটে বাংলা সিনেমা হয়ে যায়। কিন্তু ধোনি হলেন ধোনি! সব কিছুতে লক্ষ্য ওপরে। বিশাখাপত্তনমে তাঁর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই দুর্ধর্ষ ১৪৮ রানের আগের সন্ধ্যায় একটা ফোন কল রয়েছে ছবিতে। যেখানে ফোনে ক্যাপ্টেন বলছেন, মাহি ইউ আর প্লেয়িং টুমরো। ধোনি জবাবে বলছেন থ্যাঙ্ক ইউ দাদা। সত্যি এমন কথোপকথন হয়েছিল? সৌরভ মনে করতে পারলেন না। ‘‘হয়তো বলেছি, ইউ আর গোয়িং অ্যাট নম্বর থ্রি। খেলার ব্যাপারে কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না। টিমে একটাই কিপার ছিল।’’

এটা না হয় বোঝা গেল সিনেমাটিক লাইসেন্স। কিন্তু দু’ হাজার সাত বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ আর বাড়ি আক্রমণ দেখা গেল ভোলেননি ধোনি। বাবা-মায়ের সামনে তাঁর কুশপুতুল জ্বালানোই তো শুধু নয়। গোটা দেশে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য হয়ে গেছিলেন ধোনি। বাধ্য হয়ে রাঁচি না ফিরে কলকাতার টালিগঞ্জ ক্লাবে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বললে গাড়ি করে বেরোতেন। তাও চোখে থাকত সানগ্লাস। ঘুরতেন ভিক্টোরিয়া অঞ্চলের আশেপাশে। সেই মানুষটাই কি না বিশ্বকাপে উইনিং হিট মারল ছক্কায়। ভাগ্য কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল।

যাঁর পাশাপাশি হাঁটছিল পুরুষকার। নইলে আগের বিশ্বকাপের বিদায়ী ম্যাচে যাঁর বিষাক্ত ডেলিভারিতে শূন্য রানে বোল্ড হয়েছিলেন। তাঁকে আক্রমণে আসতে দেখে কিনা কোচকে বললেন, মুরলি এসেছে। আমি যাই। তারপর বেধড়ক মারলেন। প্রতিহিংসার এর চেয়ে বড় স্ক্রিপ্ট সেলিম-জাভেদও লেখেননি।

ধোনির উত্থানের সময়কার ক্রিকেট সাংবাদিকেরা অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবেন ফিল্মটা দেখলে। জীবন আর সিনেমা মিলেমিশে যেন একটা অদ্ভুত বুদবুদ তৈরি করে দেয়। যার এক একটা ফেনায় ধোনির জীবনের এক একটা গাঢ় রং।

ফিল্মের টাইম লাইন ওয়াংখেড়ের বিশ্বকাপজয়ী রাত পর্যন্ত। তার পরেও চিত্রনাট্যের কত উপাদান এসেছে ধোনির জীবনে। অনেক সাফল্য। ০-৮ সিরিজ হারের ব্যর্থতা। অনেক বিতর্কও। এই ফিল্মে যাঁর ছবি ঘরে টাঙিয়ে রেখেছেন সেই সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গেও তো লাগল। তপ্ত সময় আর তীব্র গড়াপেটা কাণ্ডের অভিযোগের মধ্যে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলেন। সন্দেহ নেই বায়োপিকের সিক্যুয়েল হলে একই রকম চমকপ্রদ হবে।

কিন্তু প্রথমটা তো অসামান্য। চেতন ভগতের গল্পের ক্যাচ লাইনের মতো। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ড্রিম’। মাঠের ধোনি যথেষ্ট প্রভাবশালীই ছিলেন। এ বার সেলুলয়েডের সাক্ষ্য অনুন্নত শহর থেকে উঠে আসা তাঁর মশালকে যেন ২৪x৭ জ্বালিয়ে দিয়ে গেল ভবিষ্যতের জন্য। হে যুব খেলোয়াড়়, অন্তত প্রতিকূলতায় সাহস হারিও না। ধোনির আলোয় রাস্তা দেখে উঠে এসো পাহাড়ে।

কেন নির্মাতারা ভারত থেকে অস্কার নমিনেশনে আগ্রহী, সিনেমাটা দেখে বোঝা খুব সহজ। ছবির খুঁটিনাটি উচ্চাঙ্গের কিনা নিকুচি করেছে। নিশ্চিতভাবে এটা ‘স্লাম়ডগ মিলিওনেয়ার’-এর ক্রিকেটীয় সংস্করণ!

M.S. Dhoni: The Untold Story Ananda Plus Gautam Bhattacharya Movie Reviews

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}