Advertisement
E-Paper

কণায় কণায় কেয়া হয়ে উঠলেন পাওলি

সিনেমা থিয়েটারের এ যেন এক অদ্ভুত মেলামেলির খেলা। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়সিনেমা থিয়েটারের এ যেন এক অদ্ভুত মেলামেলির খেলা। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

প্রসাদ কি হুবহু রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত? অমিতেশের মতোই ছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়? খেয়া কতটা কেয়ার মতো?

’৭৭ সালে অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যুরহস্য ঘিরে তৈরি ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন-এর প্রযোজনায় দু’ঘণ্টার এই ছবি ‘নাটকের মতো’ দেখার মাঝে, পরে, হয়তো’বা আগেও, প্রশ্নগুলো বুদবুদ কাটবেই। তক্কাতক্কি থাকবেই। কিন্তু প্রশ্নাতীত ভাবে নির্ভেজাল সত্যিটা হল এই, ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমলগান্ধার’-এর পর এত বড় থিয়েট্রিকাল জার্নি বাংলা সেলুলয়েডে আসেনি।

ষাট-সত্তর দশকের মানুষজনের কাছে কেয়া চক্রবর্তী সময়ের এক ধারালো মুখ। সেটা শুধু তাঁর থিয়েটারের কাতরতার জন্য নয়। তাঁর যাপনের ধরনের কারণেও। অল্পেতে কেয়ার চোখে জল আসত, বেচাল দেখলে তিনি রুখে দাঁড়াতেন। তাঁর কাছে ভালবাসা মানে জীবনটাও দিতে পারা। সতীত্ব তাঁর কাছে ঘৃণ্য ট্যাবু। অধ্যাপনা, দাম্পত্য, অনুভবের প্রতিটি কণায় কণায় তিনি দলছুট। সিনেমার খেয়ার মতোই। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যখন আন্তিগোনে হয়ে বলেন, ‘জীবন সম্পর্কে তোমার যে ধারণা তাতে আমি থুতু ফেলি।’ কিংবা বিনোদিনী হয়ে বলে ওঠেন, ‘আমার সারাজীবনের পুঁজি আমি তুলে দিয়েছি আপনাদের হাতে, কিন্তু ভালবাসা পাইনি। শান্তি নেই ভালবাসা নেই। সংসার নেই। এ ভাবেই চলবে সারাজীবন?’— কোথায় যেন প্রাণধারণের অবসন্নতা, নিরুচ্চারিত যন্ত্রণা ঠিকরে ঠিকরে বেরোয়। রক্তপাত ঘটায়। পর্দা থেকে তার ছিটে লাগে দর্শকের মনে।

এমনই বহমানতায় উড়ান দিয়ে সিনেমার খেয়া যেন কেয়ার ছায়ায় বড় হয়েও, এক সময় অতিক্রমও করে যান তাঁকে। হয়ে ওঠেন এক দল মাথা ঝাঁকানো, ঘরে বাইরে অস্বীকার করা নারীকণ্ঠের কোরাস। এমনই একটি চরিত্র নির্মাণ-বিনির্মাণের রাস্তাটা কব্জা করতে জীবনের প্রথম ছবি করতে যাওয়া পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে ছিল অল্প কয়েকটি তাস। কেয়ার নিকটজনদের বয়ান, লেখালেখি, কেয়ার নিজের গল্প ‘মিসেস আর পি সেনগুপ্ত’, ‘মেটলে’, তাঁরই ব্রেখটের কবিতার অনুবাদ ‘মারী ফারারের ভ্রূণহত্যা সম্পর্কে’।

এই প্রত্যেকটি তাস ঠিক ঠিক সময়ে বের করে যে খেয়াকে তিনি গড়েছেন, তাতে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করা পাওলি দামকে দেখে মনে হয়, খেয়া যেন ওঁর জন্যই তৈরি। খেয়ার মধ্যে যে আস্ফালন, দমক, অন্তরাত্মার ক্ষয়ের পাশাপাশি প্রণোচ্ছল স্পন্দন বয়ে যায়, তার প্রত্যেকটি স্বর এত সুচারু ভাবে লাগালেন পাওলি, বোবা কান্না উঠে আসে বারবার।

পরিচালকের এই এক্সটেনশন খেলা করে প্রসাদের মধ্যেও। দখলদারি মন, উদ্ভট সব ঈর্ষাকাতরতা, সন্দেহপ্রবণতা নিয়ে ক্রমশ দূরত্ব বাড়িয়ে চলা পুরুষের গন্ধ পাওয়া যায় যাঁর সারা শরীরে। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রসাদ জীবনের মধ্যেও আদ্যন্ত সাজানো সংলাপ বলা দেখনদারি একজন পুরুষ। শিক্ষা, চর্চার পরিশীলন যাঁদের মানুষ না করে ‘দড় অভিনেতা’ বানায়। অভিনয়ের মধ্যে অভিনয়! এই কঠিন লড়াই-এ শাশ্বত এখানে বব বিশ্বাসের চেয়েও অনেক গুণ বেশি ঠান্ডা মাথার সংহারক।

ব্রাত্য বসুর অমিতেশও তেমন যত না অজিতেশ, তার চেয়ে ঢের বেশি বহুধাদীর্ণ, খ্যাপাটে, স্বপ্নালু, থিয়েটার অন্তপ্রাণ এক সাধক।

গল্প গড়ায় গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া অভিনেত্রী খেয়ার মৃত্যু রহস্য নিয়ে তদন্ত করতে নামা ভবদুলাল রায়ের (রজতাভ দত্ত) সঙ্গে সঙ্গে। ভবদুলাল কখনও পৌঁছে যান খেয়ার মা অনন্যার বাড়ি। কখনও খেয়ার নাট্যদল ‘নটকার’-এর ঘরে। ফ্ল্যাশব্যাকে
উঠে আসে খেয়ার ছেলেবেলা, বড়বেলা, কান্না, রাগ, পাগলামি, ছেলেমানুষি।

রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অনন্যা’ এত মায়ায় মাখা, ভাঙনের শব্দের বিচ্ছুরণে, উৎখাত হওয়া জীবনের দমবন্ধ করা আর্তনাদে ঠাসা— সরাসরি ধাক্কাটা এসে লাগে হৃৎপিণ্ডে।

আর থিয়েটার থেকে বহু দূরে থাকা ভবদুলাল যে ভাবে রজতাভর শরীরী ভাষায় পাল্টাতে পাল্টাতে নাট্যপ্রেমী হয়ে ওঠেন, মন জুড়িয়ে যায় দেখতে দেখতে। ঊষসী চক্রবর্তীর অভিনয়ে রেডিয়ো প্রযোজিকা সবিতা সিংহও ছবির আরও এক জিয়নকাঠি। অধ্যাপক মনোর়ঞ্জন ঘোষ-এর চরিত্রে নীল মুখোপাধ্যায়ও নির্মেদ, স্পর্শকাতর। খেয়ার বাবার ভূমিকায় ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা বন্ধু হৈমন্তীর চরিত্রে সায়নী ঘোষও তাই।

সিনেমা-থিয়েটারের এক অদ্ভুত মেলামেলির খেলা চলে এই ‘নাটকের মতো’য়। থিয়েটারি সংলাপ মিলে যায় জীবনের গদ্যে। নাটকের সেট, প্রপস ঢুকে পড়ে ছবির আলোয়, ছায়ায়।

ব্যাকড্রপে গান ভাসে সারাক্ষণ, মান্না দে-মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-লতা মঙ্গেশকর-সলিল চৌধুরী। অনেকটা রেডিয়ো-দিনের অনুরোধের আসরগুলোর মতো। সঙ্গীত হয়ে ওঠে চরিত্র। ভায়োলিন, ভিয়েলো, চেলো, ট্রাম্পেটের অর্কেস্ট্রেশন সারাক্ষণ গুনগুন করে। তুখড় মিউজিক দেবজ্যোতি মিশ্রর। মৌসুমী ভৌমিকের গানের সংযোজন ছবিকে আকাশের প্রসারতা দিয়ে যায়। তেমনই ক্যামেরা ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের।

তবে কোথায় যেন একটু তাল কাটল খেয়া-প্রসাদের প্রেমপর্বের দৃশ্যায়নে। এ ছবি ত্রুফো-গদার-ফেলিনিতে অভ্যস্ত চোখের জন্য নয়, পুরোদস্তুর গড় সংবেদনশীল মানুষের। তবু শেযে এসে মনে হয়, ষাট-সত্তর দশকের সময়ের উত্তাপ কতটুকুই বা ধরা পড়ল? জীবন থেকে নাটকে তার চলাচল তো পুরো উল্টেপাল্টে যাওয়ার গল্প। তাই’বা কোথায়?
কিংবা খেয়ার হয়ে ওঠা জুড়ে যেতেও তো পারত জর্জ সাঁদ কী সিমন দ্য বোভেয়ার বা কোনও এক যাজ্ঞ্যবল্কের নাছোড় শিষ্যা গার্গীর প্রশ্নবাণে। সমাজ-সংসার-সম্পর্ক নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা তাঁদের উচ্চারণের সঙ্গে। এক্সটেনশন, আরও এক উত্তরণ! পরক্ষণেই মনে হল, না থাক, এই বেশ। তা হলে বোধ হয় আবার করে হারিয়ে যেত ফুটন্ত কেয়ার লোপাট হওয়া ধারাপাত। তাঁর বর্ণপরিচয়। এই হারিয়ে ফেলাটা যে তাঁর পাওনা নয়।

আনাচে কানাচে

ঝাক্কাস: ‘ওয়েলকাম ব্যাক’‌য়ের প্রোমোশনে অনিল কপূর।

কামব্যাক: ‘জজবা’র ট্রেলার লঞ্চে ইরফান খান ও ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন।

ছবি: বীরেন্দ্র চাওলা।

natoker moto like drama keya chakraborty biopic paoli dam paoli dam cinema movie natoker moto paoli dam acting debshankar mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy