আগে রকের আড্ডায় বন্ধুরা তাঁর মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিত না। আজ পাড়া থেকে প্রেম — যে কোনও বিষয়ে রকের বন্ধুরা সৌম্য চক্রবর্তীর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। আগে গানের অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হত। এখন ম়ঞ্চ থেকে নামতে নামতেই সামনের পনেরো দিনের শো ডেট ফিক্স হয়ে যাচ্ছে সৌম্যর। সারেগামা-র ৯জন ফাইনালিস্টের মধ্যে তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন সেরার শিরোপা। আগের মতো জীবনে ল্যাদ খাওয়া ভুলে গিয়েছেন দুর্নিবার সাহা। লাইট ক্ল্যাসিকালে টপার হওয়ার পর শো করতে গিয়ে গার্লফ্রেন্ডদের সময় দিতে পারছেন না! লোকাল ট্রেনে মবড্ হয়ে যাচ্ছেন গঙ্গাধর-তুলিকা। কেউ গানের অনুরোধ, কেউ বা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে হাজির। আর টিফিন ব্রেকে দীপনকে ঘিরে ধরছে স্কুলের জুনিয়র স্টুডেন্টরা। অটোগ্রাফের জন্য।
এক সপ্তাহ হল সারেগামাপা–র গ্র্যান্ড ফিনালে শেষ। তবুও বাউলবেশে গঙ্গাধর তুলিকা। সদ্য আলিপুরদুয়ার থেকে শো করে ফিরেছেন দীপন। হাজির সৌম্য। দুর্নিবার আড্ডায় যথারীতি লেট।
পুরস্কার পাওয়া লাল গাড়িতে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে লংড্রাইভ হল?
সৌম্য: (খুব লজ্জা পেয়ে) লাল মাটির ছেলে হতে পারি, কিন্তু লাল গাড়ি পাব জন্মেও ভাবিনি। আর গার্লফ্রেন্ড, লং ড্রাইভ—এই সব তো আরও দূরে।
দীপন: এই! মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা। ও খুলে বলছে না। যাদবপুরের জামাই হবে খুব শিগগির!
সৌম্য: তা হলে আমিও বলি। আমার পাওয়া সোনার দুল দুটো কোথায় গেল?
নাটকীয় ভাবে দুর্নিবারের এন্ট্রি।
একগাল হেসে বললেন, ‘‘সরি একটু দেরি হয়ে গেল। দুলের সমস্যা আমি বলছি। দুল তো দীপন নিয়েছে। নীলাঞ্জনার জন্য। (সকলের প্রচণ্ড হাসি)
দীপন: ( ভীষণ রেগে) সব সময় বাজে কথা বলা। কথার মাঝে কথা বলা বন্ধ করো কিন্তু। আমি মোটেও দুল নিইনি। কেন নেব?
ওটা রূপসার।
রূপসা কে?
দীপন: সৌম্যর গার্লফ্রেন্ড।
চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন তো তাইল্যান্ড যাবে। সেটা কি রূপসার সঙ্গে?
সৌম্য: না না, আগে বিয়ে হোক।
দুর্নিবার: এ বাজারে কেউ বিয়ে করে? পুরো লস!
গঙ্গাধর-তুলিকা অনেকক্ষণ চুপচাপ। এখন কৃষ্ণনগর না কলকাতা?
গঙ্গাধর: কলকাতায় আমাদের কোনও ঠিকানা নেই। যাতায়াত করছি। মুশকিল হচ্ছে লোকাল ট্রেনে। সবাই ঘিরে ধরছে, তুলিকাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে, সই চাইছে! সেই যে ‘সারেগামাপা’য় সবাই দিদি-জামাইবাবু বলত, এখন সকলেই এই নামে ডাকছে।
দুর্নিবার, লাইট মিউজিক থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে এখন বন্ধু-বৌদির সমীকরণটা কোথায় পৌঁছল?
দুর্নিবার: ওই সমীকরণেই চলছি। গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যাটা বেড়েছে। আর বিভিন্ন জায়গায় ‘সারেগামাপা’ টিমের সঙ্গে হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত। প্রচুর ঘুমোচ্ছি। দীপনের মতো কিন্তু শুধুই শো করে বেড়াচ্ছি না (প্রচণ্ড হাসি)।
সৌম্য: মোদ্দা কথা যা বলতে চাই, ‘সারেগামাপা’-য় হারজিতটা কিন্তু বড় কথা নয়। দিল্লিতে আমি শো করলাম, তীর্থ করল। লোকে এত এক্সাইটেড, আমাদের গান বন্ধ করতেই দিচ্ছিল না। শেষে পুলিশ ডেকে শো বন্ধ করতে হল। নম্বরের বিচারে তীর্থ হেরেছে। কিন্তু আসলে ও-ও জয়ী।
গঙ্গাধর-তুলিকা তো একমাত্র প্রতিযোগী, যাঁরা প্রতিযোগিতায় দু’দুবার পারফর্মার অব দ্য মান্থ হয়েছেন। তার পরেও সৌম্য জয়টা ছিনিয়ে নিলেন... (প্রশ্নটা করতেই দুর্নিবার আর সৌম্য সজোরে হেসে উঠে বললেন, এই রে, ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছে)
গঙ্গাধর: (সৌম্যর দিকে তাকিয়ে) ও আমার ভাইয়ের মতো। ওর জিত নিয়ে মনখারাপের প্রশ্নই ওঠে না। দেখুন, আমরা ভাল গান গাইতেই এসেছিলাম। বরং ভাল গান না গাইলে মনকেমন করত।
সৌম্য, গঙ্গাধর-তুলিকার মতো আপনি লোকগানের শিল্পী ছিলেন না। লোকগানের শিক্ষা আপনার রিয়েলিটি শো-এর মঞ্চে। কিন্তু এবার আপনি কী করবেন? ওঁদের মতো লোকগানের স্টক তো আপনার নেই।
সৌম্য: আমাকে প্রচুর শিখতে হবে। লোকগানের যা কিছু, আমি এই রিয়েলিটি শোয়ের মঞ্চ থেকেই শিখেছি। আসলে আমি এখনও ভাবতে পারছি না আমি টপ করেছি।
দুর্নিবার: দীপনও ভাবতে পারছে না। ও তো ফাইনাল শেষ হওয়ার পর স্টেজ থেকে নামতে নামতেই বলেছিল, এটা কী হল?
দীপন: উফ্ দুর্নিবারদা, আবার তুমি শুরু করলে?
রিয়েলিটি শো-এর একটা রিয়েলিটি আছে। রিয়েলিটি শো-এর শেষে প্রতিযোগীরা আসল ডেঞ্জার জোনের মুখোমুখি হন...
দুর্নিবার: দেখুন, এই হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা আমি নিতেই চাই না। আমি কগনিজেন্ট-এ ফিরছি না। চুটিয়ে গান গাইব। নিজের পিআর নিজে করব। তবে গাওয়ার মাধ্যমটা বদলাতে হবে।
কী রকম?
দুর্নিবার: এটা শেয়ারিংয়ের যুগ। ভাল কিছু দেখলে, শুনলে, পাঁচশো থেকে পাঁচ হাজার হতে খুব একটা সময় লাগে না। আমার ইচ্ছে আছে ইউটিউবে চ্যানেল করার। ব্যান্ড তৈরি করার।
আপনার দরাজ গলা। আপনি ‘মুসকুরানে কী ওয়াজা’র চেয়ে ‘সূর্য ডোবার পালা’, গাইতে বেশি ভালবাসেন। কিন্তু এখন চড়াপর্দার গলা ভেঙে যাওয়া নেজাল ভয়েসের কদর। কী করবেন?
দুর্নিবার: আমি পুরনো রোম্যান্টিক গান গাইব। লোকে আমার কাছে সেটাই শুনতে চাইবে। ভাল গান শোনালে লোকে যে নেয়, সেটা তো এই রিয়েলিটি শো প্রমাণ করে দিয়েছে। নয়তো কীর্তন এত জনপ্রিয় হত না। অঞ্জন দত্ত একটা কথা বলেছিলেন আমাদের সবাইকে। ‘‘মঞ্চে যখন গান গাইতে উঠবে, জানবে তুমি যে গান গাইবে, সেটাই বেস্ট। আর লোকে সেটাই শুনবে।’’
সৌম্য: রোম্যান্টিক সং! দুর্নিবারের এমনিতেই ফিল্ড তৈরি করা আছে।
গঙ্গাধর-তুলিকা, আপনাদের মনে হচ্ছে না, এবার সত্যিই ডেঞ্জার জোনে চলে এসেছেন?
তুলিকা: আমি গান ছাড়া আর কিছু বুঝি না, (গঙ্গাধরের দিকে তাকিয়ে)তুমি বলো।
গঙ্গাধর: ঠিকই, ডেঞ্জার জোন। তবে আমাদের জীবনটাই তো গানের। ইচ্ছে আছে গ্রামে আখড়ায় লালনের গান চর্চা করার। আর দেশে-বিদেশে যেখানেই লোকে ডাকুক, গান গেয়ে যেন লোকের মন ভরাতে পারি। সৌম্য: ওই যে বলেছিলাম আমাকে লোকগানের স্টক বাড়াতে হবে। গঙ্গাধরদার বাড়ি চলে যাব।
দুর্নিবার ছা়ড়া আর কেউ কি ডিজিটাল মিউজিক লঞ্চের কথা ভাবছেন?
সৌম্য: (প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে) তুলিকাদিকে দুর্নিবার ‘টুলস্’ বলে ডাকে। কিন্তু ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কোনও টুলস-ই ওর অ্যাকটিভ নয়।
গঙ্গাধর: আমরা অতশত বুঝি না বাবা। এই বেশ আছি।
তুলিকা, লোকগানে আপনার কোনও ট্রেনিং কোনও দিন ছিল না। আর শান্তনু মৈত্র ভবিষ্যতেও আপনাকে কোনও ট্রেনিং নিতে বারণ করেছিলেন…
তুলিকা: কী বলব! আসলে আমাদের কাছে এই মঞ্চ একটা স্বপ্নের মতো! কোটি কোটি মানুষ আমার গান শুনেছেন! আর কী চাইব? তবে খুব মন দিয়ে গান গেয়ে যেতে চাই।
রিয়েলিটি শোয়ের মঞ্চে তুলিকার গান বেশি শোনা গেল। অথচ ‘কালো বেড়াল’ গেয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন গঙ্গাধর। গঙ্গাধর কম গাইলেন কেন?
তুলিকা: ও আমাকে এগিয়ে দিয়েছে।
গঙ্গাধর: না, না, এমন গানগুলোই বাছা হয়েছিল, যেগুলো বেশি তুলিকার গলাতেই মানায়।
দুর্নিবার: আসলে প্রথম বার স্টুডিয়োতে গান গেয়ে গঙ্গাদা হিরোশিমা ফেলেছিল। আর ফাইনালে গেয়ে নাগাসাকি ফেলল। ওটাই গল্প।
ভেবেছিলেন, কোনও রিয়েলিটি শো-তে আপনাদের বিয়ে হবে?
তুলিকা: জানেন তো, বাস্তবে বাবা-মা আমাদের এ ভাবে বিয়ে দেননি। আমাকে তুলতে দুর্নিবারের খুব কষ্ট হয়েছিল (প্রচণ্ড হেসে)। তবে দুর্নিবার, তোমার মতো চমকাতে আমরা কেউই পারি না।
সেটা কেমন?
সৌম্য: আরে ‘দাদাগিরি’র শ্যুট। ভোর সাড়ে ছ’টা থেকে দুর্নিবারকে ফোন করা হচ্ছে। ও ফোন তুলছেই না। চারদিকে হুলস্থূল। দাদা (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) ফ্লোরে ঢুকে গেছেন। সকাল দশটায় দুর্নিবার ফোন তুলে বলল, ওহ্, আমি তো ‘দাদাগিরি’র কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের ফাইনাল এপিসোডের শ্যুট হচ্ছে। সকাল থেকে ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা গেল ও স্টেজের পিছনে ড্রেসিং রুমে ঘুমোচ্ছে। ও তো সারারাত জাগে। আর সকালে ঘুমোয়।
দুর্নিবার কি এতটাই ক্যাজুয়াল? সৌম্যর চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা কেমন ভাবে নিলেন তা হলে?
দুর্নিবার: সৌম্যর চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আমার কাছে যেমন খুব এক্সাইটিং নয়, আবার খুব ইমোশনালও নয়। সৌম্য বরাবরই এই প্রতিযোগিতায় খুব ভাল স্কোর করে এসেছিল। স্কুলের ফার্স্ট বয়ের মতো। প্রি-টেস্ট থেকে ফাইনাল— সবেতেই ফার্স্ট। তবে যিশুদাকে একটা কথা বলেছিলাম। এই ফাইনালে ন’জন ফাইনালিস্টের প্রত্যেকেই একই সংখ্যক গান গেয়েছেন। কেউ এর মধ্যে একটা গিফ্টের বক্স পেয়েছে। কেউ তিনটে। কিন্তু প্রত্যেকেরই বাকেট ফুল।
এত তাড়াতাড়ি বাকেট ফুল হলে চলবে? পারফর্ম করার খিদেটা তো মিটে যাবে। মুম্বই যাওয়ার প্ল্যান আছে কোনও?
গঙ্গাধর: ইচ্ছে আছে।
তুলিকা: ভাল গান শোনানোর জন্য নিশ্চয়ই যাব।
দুর্নিবার: মুম্বই? বেড়াতে যাব।
দীপন: প্লেব্যাক করার ইচ্ছে তো থাকবেই।
সৌম্য: যেখানে বাঙালি, যেখানে গান, সেখানেই পৌঁছে যাব।
ছবি: কৌশিক সরকার।
(সাক্ষাৎকার শেষ। বেরোনোর আগে সবাই সবাইকে উইশ করলেন। হ্যাপি সরস্বতী পুজো!)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy