Advertisement
E-Paper

পরদায় আড়ি আড্ডায় ভাব

‘পোস্ত’য় আগাগোড়া ওঁদের সংঘাত! আনন্দপ্লাস-এর সঙ্গে কিন্তু তুমুল আড্ডায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও যিশু সেনগুপ্ত শ্যুটিং-এ নাকি দু’জনেই প্রায়ই বকুনি খেতেন ‘পোস্ত’র পরিচালকের কাছে! একজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অন্যজন যিশু সেনগুপ্ত। ‘‘আরে, কাজের ফাঁকে সৌমিত্রজেঠু গল্প বলতেন, কখনও গারফিল্ড সোবার্সের হাঁটুতে বাতের ব্যথা নিয়ে জেঠুকে ওঁর নানান প্রশ্ন। তো কখনও টাইগার পতৌদির দুষ্টুমিষ্টি ক্যারিশমা, তো কখনও’বা ছবি বিশ্বাসের কাছে তাঁর অভিনয় শেখা!

দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৭ ০১:০২

শ্যুটিং-এ নাকি দু’জনেই প্রায়ই বকুনি খেতেন ‘পোস্ত’র পরিচালকের কাছে! একজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অন্যজন যিশু সেনগুপ্ত।

‘‘আরে, কাজের ফাঁকে সৌমিত্রজেঠু গল্প বলতেন, কখনও গারফিল্ড সোবার্সের হাঁটুতে বাতের ব্যথা নিয়ে জেঠুকে ওঁর নানান প্রশ্ন। তো কখনও টাইগার পতৌদির দুষ্টুমিষ্টি ক্যারিশমা, তো কখনও’বা ছবি বিশ্বাসের কাছে তাঁর অভিনয় শেখা! সবই তো ওঁর সামসামনি দেখা। শুনতে শুনতে মনে হত, ধুত্তোর ছবি! আগে তো গল্প শুনি। তাতেই শিবু (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) ধমক দিত, ‘এবার কি একটু শ্যুটিংয়ে আসবে?’’, পরিচালককে নকল করে দেখালেন যিশু। পাশে বসা সৌমিত্রর মুখে তখন দু’কান জোড়া হাসি।

রোয়িং ক্লাব। বেলা সাড়ে এগারো। রবিবার। হেরিটেজ বার-এর ঠিক উল্টো পারে লন-লাগোয়া ‘কোজি’ ঘরটায় ওঁদের মুখোমুখি আনন্দ প্লাস। গোড়াতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শর্ত, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত নাতিকে নিয়ে অফিসিয়ালি কোনও কথা নয়। যদিও ঘরের বাইরে বসে বারবার উঠে এল সেই প্রসঙ্গই! উত্তরও দিচ্ছিলেন তিনি। রেকর্ডার অন হতেই শর্ত লাগু!

শুরু হল শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায়ের নতুন ছবি ‘পোস্ত’ নিয়ে নিরামিষ আড্ডা। তার মধ্যেও আমিষের স্বাদ এল বইকী!

বাঙালি পোস্ত-য় ছিল বরাবরই, এখন আবার কথায় কথায় পোস্টিং-এও!

বরিশালী বাঙাল পরিচালক শিবপ্রসাদ যেমন! এক পোস্টিং-এ দাবি করে বসেছেন, তিনি নাকি এক্কেবারে ঘটি-ঘটি মিষ্টি স্বাদের ‘পোস্ত’ বানিয়ে ফেলেছেন। এ দিকে, সিনেমায় তো ভরপুর ঝাল! বাচ্চার কাস্টডি নিয়ে দাদু-ঠাকুমা বনাম বাবা-মা। শেষে তার কিনারা করতে আইন-আদালত! হাঁ-হাঁ করে উঠলেন সৌমিত্র, ‘‘পোস্তর আবার ঘটি-বাঙাল! শুনিনি তো!’’

সে দিন ওঁরা

‘গার্জেনশিপ’ নিয়ে পরিবারের দু’পক্ষে ডামাডোল! এক কালে কিন্তু এই জাতিটাই ‘মাল্টিলেয়ার’ অভিভাবকত্ব দেখেছে! বা়ড়ির জেঠু-জেঠি, খুড়ো-খুড়ি তো ছিলই, এর পর পাড়ার মাসি-মেসো, এমনকী মাস্টারমশাইও অভিভাবক। তার মধ্যে নো টানাটানি, নো কিস্যু!

সৌমিত্র বললেন, ‘‘এখন আর মাল্টিলেয়ার গার্জেনশিপ কই! বাচ্চাকে নিয়ে সংঘাত, টানাটানির এখন দুটো মাত্র পক্ষ। সেখানেই দর্শক নিজেদের আইডেন্টিফাই করবে। তবে আমি কিন্তু এখানে দাদুর দোষই দেখব। দাদু-ঠাকুমার যেমন নাতির প্রতি ভালবাসা-ত্যাগ থাকে, তেমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অধিকারবোধও তৈরি হয়। গল্পের টিউনটা এটাই।’’ যিশুর কথা অন্য। মিটিমিটি হেসে বলল, ‘‘দোষ কারও নয় গো মা! এটা পুরো সিস্টেমের একটা কুফল!’’

মুকুল, ক্যাপ্টেন স্পার্ক থেকে এই ছবির খুদে বাচ্চা পোস্ত নামের শিশুটি! শিশু-অভিনেতা পেলে আজও যেন সৌমিত্রর শরীরে হান্ড্রেড মিটার রেসের উসেন বোল্ট ভর করে! এত্তো এনার্জেটিক! অন্তত প্রোমোতে তা-ই দেখাচ্ছে! রহস্যটা কী?

‘‘ছোটদের সংসর্গটাই আমার ক্ষমতা দশ গুণ বাড়িয়ে দেয়। আর ওদের আমি বরাবরই বড়দের মতো ট্রিট করি। এটা মানিকদার শেখানো,’’ জবাব সৌমিত্রর। এই ছবিতে বাচ্চা ফোকাল-পয়েন্টে। কিন্তু শুধু মাত্র বাচ্চাকেন্দ্রিক ছবি বাংলা থেকে তো প্রায় উঠেই গেল! কেন বলতে পারেন?

ফেলুদাসুলভ অর্থবহ হাসি সৌমিত্রর ঠোঁটে, ‘‘বাজারমুখিতা! রূঢ় কথা বলে ফেললাম। তবু এটাই সত্যি। ওঁরা কিন্তু বিচারে ভুল করেন। একটা তথ্য দিই, ‘গুপী গায়েন’ চলেছিল ১০০ সপ্তাহর বেশি। সেটা এখনও সম্ভব।’’

‘দাদাঠাকুর’, ‘লালুভুলু’, ‘বাদশা’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’র দিন বাড়ন্ত! অথচ একটা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশও আজ শিশুছবি করে দুনিয়া টলিয়ে দিচ্ছে, ইরান! আর বাংলা ছবির ফর্মুলা নম্বরে এক দিকে বিগ-বাজেট ড্রামা, আর লো-বাজেটে সেই একই সম্পর্কের গল্প! একটা ‘লাঞ্চবক্স’ও তো হতে পারে!

উত্তেজিত সৌমিত্র, ‘‘ধরুন, ‘আমর’, কী ছবি বলুন তো! কিংবা ‘শিপ অব থিসিয়াস’! বাংলায় উদ্যোগটারই বড় অভাব!’’

ম্লান মুখে যিশু বললেন, ‘‘লেখক নেই! স্ক্রিপট রাইটার নেই। নতুন ছেলেপুলে খোঁজার চেষ্টা নেই। উল্টে বাংলায় স্কোপ নেই বলে বহু ছেলেপুলে মুম্বই-এ কাজ খুঁজে ওখানেই সেটলড্ হচ্ছে। আর যে ছবিগুলোর কথা বলছেন, এখানে চার জনের বেশি ডিরেক্টর পাবেন না, যারা ওগুলো ট্যাকল করতে পারবে! ও সব তো ছেড়ে দিন, ভাবুন, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’! অল টাইম গ্রেট কমেডি! আজ কেউ পারবে লিখতে?’’ শুনে চোখ চকচক করে ওঠে সৌমিত্রর, ‘‘আহা, চিত্রনাট্যটা কার? না, নবান্ন-র লেখক বিজন ভট্টাচার্যর! ডিরেক্টর কে? নির্মল দে, যাঁকে নিয়ে মানিকদাও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। অভিনেতা কে? না, তুলসী চক্রবর্তী, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

আক্ষেপে ভাসলেন যিশুও, ‘‘আমরা না নিজেরা পরস্পরের পিঠ চুলকেই শেষ হয়ে যাচ্ছি! নইলে এই ইন্ডাস্ট্রি খরাজ মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে কমেডিয়ান বানিয়ে রেখে দেয়! আমার তো মনে হয়, এই মুহূর্তে আমাদের প্রজন্মের গ্রেটেস্ট অ্যাক্টর ঋত্বিক চক্রবর্তী! আমি বুঝি না, ওকে বড়লোকের ছেলে বানিয়ে কেন ছবি হতে পারে না! সেই টাইপ-কাস্ট রোল ওর জন্য! আধখ্যাপা একটা ভাবুক-ভাবুক কি রিকশাওয়ালা গোছের! কেন? যত্তো স্টুপিডিটি!’’

শিবপ্রসাদ-নন্দিতা কিন্তু ‘হাউসফুল’ দিচ্ছেন। গল্প-বলা সিনেমা করে যাচ্ছেন!

‘‘ওরাই বাংলা ছবির পুরনো ট্র্যাডিশনাল জায়গাটা ধরে রেখেছে। আর মজাটা হল, ওরা একে অন্যের পরিপূরক। একজনের খামতিটা আর একজন ঢেকে দেয়,’’ কথা জোগালেন সৌমিত্র।

ইন্টারভিউ প্রায় শেষ পর্বে। কথার তো়ড়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘‘আপনিও তো দাদু, সংঘাত এড়াতে আইডিয়াল দাদু-নাতি সম্পর্ক কী হতে পারে?’’ সারাক্ষণ চনমনে, উজ্জ্বল থাকা শরীরটা এই প্রথম মিইয়ে গেল যেন, ‘‘প্লিজ! প্লিজ! ওকে নিয়ে কথা নয়!’’ শোনা গেল, ‘পোস্ত’-র শ্যুটিং চলাকালীন নাকি স্ত্রী ‘ফিমার বোন’ ভেঙে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। জানতেও পারেনি কেউ। শ্যুটিং শিডিউল-এ সৌমিত্র যেতেন যথারীতি ঘড়ির কাঁটার আগে আগে! কী বলবেন একে? ডেডিকেশন! ইনভলভমেন্ট! প্রফেশনালিজম! উত্তরে বললেন, ‘‘এটা আমার দায়, ইন্ডাস্ট্রির প্রতি!’’ তিরাশির যুবকের দিকে চল্লিশের যিশু তখন টসটসে চোখে তাকিয়ে, ‘‘এই দায়, এই ডিসিপ্লিন একজনের কাছেই পেয়েছি। ‘কিং লীয়র’ করার সময়। মিস্টার বচ্চন!’’

বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ। কার্টেনের ফাঁক দিয়ে তার উত্তাপটা টের পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে লাল টি-শার্টের খুদে পোস্ত!

Jisshu Sengupta Posto যিশু সেনগুপ্ত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy