Advertisement
E-Paper

আমির সিংহ ফোগত

মাঝারি উচ্চতা। হরিয়ানভি উচ্চারণ। পর্দায় প্রাক্তন জাতীয় কুস্তিগিরের চরিত্রে এ বার বলিউডের ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ আমির খান। হরিয়ানার আখড়ায় মহাবীর সিংহ ফোগত-এর কাছে ‘দঙ্গল’য়ের নেপথ্য কাহিনি শুনলেন সায়ন আচার্যতাই বলে, আমির খান? সামনে যে ভদ্রলোক হাজির হচ্ছেন তিনি কোনও মতেই আমির খান হতে পারেন না! টানটান মেদহীন শরীর, গালে বেশ কয়েক দিনের না-কাটা দাড়ি। একনাগাড়ে হরিয়ানভিতে কথা বলে যাচ্ছেন।

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৩৯

তাই বলে, আমির খান?

সামনে যে ভদ্রলোক হাজির হচ্ছেন তিনি কোনও মতেই আমির খান হতে পারেন না!

টানটান মেদহীন শরীর, গালে বেশ কয়েক দিনের না-কাটা দাড়ি। একনাগাড়ে হরিয়ানভিতে কথা বলে যাচ্ছেন। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে, হাত নেড়ে দেশওয়ালি ভাষায় অনুবাদ করতে বলছেন। তিনি স্বচ্ছন্দে কোনও প্রাক্তন কুস্তিগির হতে পারেন, কিংবা বডিবিল্ডার।

ইনি মহাবীর সিংহ ফোগত। মুম্বইয়ের পালি হিলের বাসিন্দা। আমির খান যত বড় অভিনেতাই হোন, গ্রামের কুস্তিগির তিনি হতে পারেন না!

কাট টু অক্টোবর, ২০১৬।

… ‘দঙ্গল’। গত দু’ দিনে ইউটিউবে ট্রেলরটা দেখেছেন প্রায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। কেউ বলছেন, ‘লগান’কেও ছাপিয়ে যাবে এই ছবি। আবার কারও মতে ‘সুলতান’, ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’কে টপকে এটি হতে চলেছে বছরের সেরা ব্লকব্লাস্টার। আসলে ২৩ ডিসেম্বরের সকালে ‘দঙ্গল’ নিয়ে পর্দায় ফিরতে চলেছেন এক ‘ওস্তাদ’, যাঁর শেষ মাসের মারের অপেক্ষায় দিন গুনছে গোটা দেশ।

আর হ্যাঁ, সবাই একমত। হুবহু মহাবীর সিংহ ফোগত হয়ে উঠেছেন তিনি।

পালি হিলের আমির খান!

…গত কয়েক মাস দিনে ঘুমিয়েছেন মেরেকেটে ঘণ্টা চারেক। দিন শুরু হতো ভোর চারটেয়। আর শ্যুটিং সেরে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা। ভোরবেলা উঠে সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পঞ্জাব ও হরিয়ানার অলিগলি। নিজের ওজন করেছেন ১২০ কেজি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়েছেন কুস্তির আখড়ায়। যা দেখে পরিচিতদের ইতিউতি কৌতূহল, “আরে, এ তো পুরো কুস্তিগির!”

আসলে তাই-ই। গত কয়েক মাসে বলিউডের সুপারস্টার যেন ভুলেই গেছিলেন নিজের আসল নামটা। গ্রামের চা-ওয়ালা হোন, বা শ্যুটিং ইউনিটের মেক আপ ম্যান সবার কাছেই তিনি — মহাবীর সিংহ ফোগত। প্রাক্তন কুস্তিগির, যিনি হরিয়ানার বালালি গ্রামে নিঃশব্দে ‘মহিলা পালোয়ান’ তৈরি করেছেন বছরের পর বছর!

— ফাইল চিত্র।

তাঁর মেয়ে — গীতা, ববিতা অলিম্পিয়ান। ভাইঝি ভিনেশও। আরও দুই মেয়ে সঙ্গীতা ও ঋতুও আন্তর্জাতিক স্তরের কুস্তিগির। তবু গোটা গ্রামে তিনি ছিলেন প্রায় ‘একঘরে’। কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে কুস্তি লড়বে, এটা মানতে পারেননি গ্রামবাসীরা। তাই এত দিন কেউ মহাবীরকে বিশেষ পাত্তা দেননি।

দিলেন যিনি, তাঁকে বলিউড চেনে ‘পারফেকশনিস্ট’ হিসেবে। প্রাক্তন কুস্তিগিরের এই লড়াইয়ের গল্প প্রথম শোনার পরেই আমির ঠিক করেন বড় পর্দায় তাঁকে নিয়ে আসবেন। সিনেমা জগতে অনেকে তখন সংশয়ে ছিলেন এই বৃদ্ধের গল্প শুনতে আদৌ কেউ আগ্রহী হবেন কি না!

ইউটিউবে যখন ‘দঙ্গল’-এর ট্রেলর সুপারহিট, বাস্তবের মহাবীর সিংহ ফিরে যাচ্ছেন এ বছরের জুন মাসের এক দুপুরে।

লুধিয়ানায় শ্যুটিং স্পটে মুখোমুখি বসে আমির আর তাঁর বাস্তবের চরিত্র মহাবীর। দু’জনের গালেই কয়েক দিনের না-কাটা দাড়ি, পরনে পাঠানি স্যুট। দেখে বোঝা দায়, কে বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক, আর কেই বা বাস্তবের কুস্তিগির! “এটাই আসলে আমির। শ্যুটিং শুরুর আগে থেকেই নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন আমার সঙ্গে। জানতে চেয়েছেন প্রতিটা গল্প। কাজ নিয়ে এত খুঁতখুঁতে মানুষ আমি এর আগে দেখিনি,” আনন্দplusকে বলছিলেন মহাবীর।

দিল্লির বিখ্যাত চাঙ্গিরাম আখড়ায় তাঁর হাতেখড়ি। বছর ষোলো আগে মেয়ে গীতা ও ববিতাকে নিয়ে পৌঁছে যেতেন গ্রামের আখড়ায়। মেয়েদের লড়তে শেখাতেন পুরুষ পালোয়ানদের সঙ্গে। মহাবীরের দুনিয়ায় আমির খান তখনও ‘এক ভিন্ দেশি তারা’। পরিচিতদের সব অপমান, গ়ঞ্জনা অতিক্রম করে মহাবীরের লড়াই—গল্পটা যেন সিনেমার আদর্শ চিত্রনাট্য।

এবং ঠিক এ কারণেই, ছবিটা করতে রাজি হন আমির। “আসলে, মহাবীরের গল্পটা ভীষণ ইন্সপায়ারিং। এটা আমাদের দুনিয়াকে জানাতেই হতো...” আনন্দplusকে বলছিলেন ‘দঙ্গল’‌য়ের পরিচালক নীতেশ তিওয়ারি। ছবি ফ্লোরে যাওয়ার এক বছর আগে, নীতেশ আর প্রাক্তন কুস্তিগির কৃপাশঙ্কর বিষ্ণোইকে সঙ্গে নিয়ে পঞ্জাব ও হরিয়ানার প্রতিটা আখড়ায় ঘুরেছেন আমির।

কখনও আবার সোজাসুজি ফোন করেছেন মহাবীরের মেয়ে গীতা, ববিতা কিংবা সাক্ষীকে।


পারফেকশনিস্ট: এই ছবির জন্য নিজের ওজন ১২০ কেজি করেছেন আমির

অবশ্য মহাবীর একা নন। তাঁর যুদ্ধের শরিক স্ত্রী দয়া কৌরও। মহাবীর যতটা একরোখা, দয়া ঠিক ততটাই নরম। গীতা বা ববিতা মনে করেন, ‘বাউজি’ আর আম্মির এই কেমিস্ট্রিটাই তাঁদের সাফল্যের নেপথ্যে।

এই ব্যাপারটা আমিরের দৃষ্টি এড়ায়নি। বাস্তবের সেই কেমিস্ট্রিটাকে পর্দাতেও নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। এবং সে জন্য পর্দার দয়া কৌর — সাক্ষী তনোয়ারের সঙ্গেও দিনের পর দিন কথা বলেছেন হরিয়ানভিতে, যাতে রিয়েল এবং রিল সহজেই মিশে যায়!

সে কারণেই বোধহয় আমির নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা নস্টালজিক মহাবীর স্বয়ং। মহিলাদের ‘পালোয়ান’ তৈরি করার জন্য এ বছর দ্রোণাচার্য পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু এক সময় গ্রামের লোকেদের মনে হয়েছিল যে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নইলে মেয়েদের কুস্তি শেখায়!

‘‘আমাকে ওরা প্রায় একঘরে করে দিয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল মেয়েরা যদি পুরুষের সমান হয়, তা হলে কুস্তিতেই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এই লক্ষ্যেই ঠিক করি ববিতা আর গীতাকে নিয়ে দঙ্গলে যাব। ওদেরও শেখা উচিত জীবনের জটিলতাগুলো,” বলছিলেন মহাবীর।

ট্রেলরে আমির খান ভোরবেলা ফতিমা সানা শেখ আর সানা মলহোত্রকে নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন ‘দঙ্গল’-য়ে। বাস্তবের মহাবীরও বছর পাঁচেকের দুই মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত পৌঁছে যেতেন ধুলোবালির দঙ্গলে। ভোর চারটে থেকে সকাল সাতটা। ববিতা, গীতা-কে নিয়ে গ্রামের এক প্রান্তে ট্রেনিং দিতেন তাঁদের ‘বাউজি’। ছুটি ছিল না একদিনও। “বাউজি চাইতেন না আমরা কারওর সঙ্গে বেশি কথা বলি। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভাল কুস্তিগির হওয়া,” বলছিলেন মহাবীরের বড় মেয়ে গীতা।

এত দিন পরেও মহাবীর পাল্টাননি। মনেপ্রাণে তিনি এখনও তরুণ। নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে চলে যান গ্রাম থেকে শহরে। ভোর চারটেয় কচিকাঁচাদের নিয়ে ছোটেন দঙ্গলে।

“এখন যখন সবাই ছবিটা নিয়ে হইচই করছে, পুরোনো দিনের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। এক সময় লোকে বলত বাবা নাকি অন্যায় করছে,” কথা বলতে বলতেই নস্টালজিক গীতা।

শুধু গীতা, ববিতা নয়। ধীরে ধীরে স়ঙ্গীতা, ঋতু, ভাইঝি ভিনেশ, এবং ছোট ছেলে দুষ্মন্তকেও মহাবীর নিয়ে আসেন আখড়ায়। মেয়েরা যখন সবে জেলাস্তরে নাম করা শুরু করেছে, মহাবীর বাড়িতেই শুরু করলেন আখড়া। কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে নিয়ে এলেন সরঞ্জাম। লক্ষ্যে তিনি তখনও অবিচল—মেয়েদের বড় কুস্তিগির বানাবেনই।

তাঁর উদ্দেশ্যে সফল। ২০১০ সালে দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতেন বড় মেয়ে গীতা। পদক না পেলেও, মেয়ে ববিতা এবং ভাইঝি ভিনেশ রিও অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।

মেয়েদের এই লড়াই-ই মুগ্ধ করেছে আমিরকে। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে নিয়মিত তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, জানতে চেয়েছেন কী ভাবে তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘‘আমির যে আমাদের নিয়ে ভেবেছেন এটাই বড় ব্যাপার,’’ বলছিলেন আপ্লুত ভিনেশ।

যদিও কখনও গ্রামে আসেননি, লুধিয়ানায় যে দিন প্রথমবার ফোগত পরিবারের সঙ্গে আলাপ করেন আমির তখনই মহাবীরকে জানিয়েছিলেন যে, শ্যুটিং চলাকালীন তিনি যেন ইউনিটের সফরসঙ্গী হন। তাতে নাকি ম্যানারিজমগুলো রপ্ত করা সহজ হবে।

এখানেই আমির আর মহাবীরের মিল। দু’জনেই পারফেকশনিস্ট। মহাবীর যেমন আজও ভোর চারটেয় পৌঁছে যান আখড়ায়, শ্যুটিং চলাকালীন আমিরও নিয়ম করে ক্লাস নিয়েছেন প্রাক্তন জাতীয় কোচ কৃপাশঙ্কর বিষ্ণোইয়ের কাছে। ভোরে উঠে জগিং, তারপর কুস্তির মহড়া, হাল্কা শারীরিক কসরত — আমিরের রুটিন দেখে অনেকে রসিকতা করে নাম দিয়েছেন ‘অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন’।

গল্পের সূত্রপাত বছর পাঁচেক আগে। আমির তখন ছোট পর্দায় ব্যস্ত ‘সত্যমেব জয়তে’ নিয়ে। এমন সময় জানা গেল হরিয়ানার বালালি গ্রামের ফোগত পরিবারের কথা।

সেই শুরু। তখন থেকেই মহাবীরকে নিয়ে ফিচার ফিল্ম করার ইচ্ছে আমিরের। প্রাথমিক ভাবে ঠিক ছিল ২০১৩-র মাঝামাঝি শুরু হবে শ্যুটিং, কিন্তু আমিরের হাতে তখন প্রচুর কাজ। ‘ধুম থ্রি’ শেষ হতে না হতেই ‘পিকে’। যখন সবাই বলতে শুরু করেছে, এটিও বোধহয় ভাবনার স্তরেই রইল, প্রোডাকশন টিমকে আমির জানালেন ২০১৫-য় ফ্লোরে যাবে ‘দঙ্গল’।

ছবি শুরুর আগে মাসখানেকের ব্রেক নিয়েছিলেন আমির। “সবাই জানত কাজ শুরুর আগে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান সুপারস্টার। কিন্তু আমরা জানতাম ভেতরে ভেতরে আসলে মহাবীরের চরিত্রটাকে স্টাডি করছেন আমির,” বলছিলেন কৃপাশঙ্কর, যাঁর কাছে কুস্তির ক্লাস নিয়েছেন বছর একান্ন-র সুপারস্টার!

তবে ট্রেলর-য়ে সাফল্যের পরেও সতর্ক আমির। টুইটারে কয়েকটি ছবি আপলোড করলেও, ছবি নিয়ে তাঁর মুখে কুলুপ। বলিউড-এর ‘দঙ্গল’-য়ে তাঁর লড়াইটা যে সবে শুরু হল...

dangal Mahavir Singh Phogat amir khan আমির খান
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy