Advertisement
২২ মে ২০২৪

আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি

এক সময় মান্নাদার দুটো ঠিকানার মধ্যে যোগসূত্র রচনা করল একটি ছবি। বেঙ্গালুরুর কল্যাণনগর। শেষ জীবনে ছিলেন এখানে। বাড়ির নাম ‘ঋতুগোকুলম’।

মান্না দে।

মান্না দে।

দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:০৮
Share: Save:

এক সময় মান্নাদার দুটো ঠিকানার মধ্যে যোগসূত্র রচনা করল একটি ছবি। বেঙ্গালুরুর কল্যাণনগর। শেষ জীবনে ছিলেন এখানে। বাড়ির নাম ‘ঋতুগোকুলম’। ২০১৩-র জুন মাস নাগাদ খুব অসুস্থ অবস্থায় মান্নাদা ভর্তি হলেন ড. দেবী শেঠির ‘নারায়ণ হৃদয়ালয়’ হসপিটালে। বলছিলাম এই দুটো ঠিকানার কথা। ম্যাডাম সুলোচনা দেবী চলে যাওয়ার পর মান্নাদার মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয়ের কথা আগে লিখেছি। ম্যাডামের একটা ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখা ছিল মান্নাদার ঘরে। ছবির মুখোমুখি রাখা থাকত মান্নাদার বসার চেয়ার। অপলক চেয়ে থাকতেন ওই ছবির দিকে। হাসিমুখ। দু’হাত জড়ো করে নমস্কার করছেন। একেবারে বিদায়ের ভঙ্গি। যেন বলছেন ‘পেয়েছি ছুটি’। মান্নাদা তাকিয়ে থাকতেন আর অঝোরে কাঁদতেন। একদিন ফোনে কথা হচ্ছে, হঠাৎ মান্নাদা কাঁদতে আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘শুধু ওর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। এখনও বিশ্বাস করতে পারি না সুলু নেই।’’

স্ত্রীর স্মরণে মান্নাদা যে গানগুলো গাইবেন কথা ছিল, সেই গান তখন লেখালেখি চলছে। ‘এই সেই ঘর’ গানের সঞ্চারী আমি লিখে পাঠালাম—‘যখন দু’চোখ বুজি, তুমি সামনে দাঁড়াও, দুটি চোখ মেলতেই দেয়ালের ছবিতে কেন ফিরে যাও।’’ গানের কথা পড়তে পড়তে মান্নাদা অঝোরে কাঁদতেন। আমি তাঁকে বলতে পারিনি, কথাগুলো লেখার সময় মান্নাদার কথা ভেবে আমার বুকটা ভেঙে গেছে। যে কথা বলছিলাম, মান্নাদা ভর্তি হলেন হসপিটালে। ডাক্তারদের সঙ্গে গল্প হত নানা বিষয়ে। ঘুরেফিরে দুটো প্রসঙ্গই ফিরে ফিরে আসত। বলতেন, ‘‘আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। স্ত্রীর স্মরণে একটা অ্যালবাম করছি। দেবপ্রসাদবাবু দলবল নিয়ে আসছেন। এখানেই আমি গাইব।’’ আর বলতেন স্ত্রীর কথা। তাঁর ভালবাসা, অমন করে চলে যাওয়া, মান্নাদার একাকীত্ব। ড. শেঠি ডাক্তারদের বললেন, ম্যাডামের একটা ছবি যেন মান্নাদার কেবিনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। ম্যাডামের সেই হাতজোড় করা ছবিটির আর একটি রাখা হয় মান্নাদার ঘরে। জানি না সেই ছবি মান্নাদা কতটা দেখতে পেতেন। কান্না যদি যদি দু’চোখ ভরে থাকে, সবই যে ঝাপসা মনে হয়।

স্ত্রীর স্মরণে অ্যালবামটিতে চারটি নতুন গানের সঙ্গে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেখেছিলেন মান্নাদা। এই দুটি গানের মধ্যে ‘তোমরা যা বলো তাই বলো’ গানটি নির্বাচন করেছিলেন, তাঁর প্রিয় দু’জন মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য—রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সঙ্গীতগুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে। অনেক আগে কৃষ্ণচন্দ্র দে এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন। এত গান থাকতে ‘আনন্দ তুমি স্বামী’ গানটি গাইতে আগ্রহী হলেন কেন? সাঙ্গীতিক কারণ তো আছেই, রবীন্দ্রনাথের একটি অপূর্ব কম্পোজিশন এটি। অথচ খুব প্রচলিত নয়। তানের বৈচিত্র খুব পছন্দ করতেন মান্নাদা। বাংলা গান তো দাদরা বা কাহারবা-র বাইরে খুব একটা বেরোতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ তাল নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। এই গানটি বেঁধেছিলেন নিজ-সৃষ্ট কঠিন অথচ অনবদ্য ‘সুর-ফাঁক’ তালে। মান্নাদার কাছে এটিও অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু মুখ্য কারণ ছিল সুলোচনাদেবী। জন্মসূত্রে মালয়ালি হলেও অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন সুলোচনাদেবী। মান্নাদাও তাকে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান শিখিয়েছিলেন। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, এই বিদুষী রমণী পরিষ্কার বাংলা বলতেন এবং নির্ভুল বানানে বাংলা লিখতেন। মান্নাদার মতোই মুক্তোর মতো ছিল তাঁর হাতের লেখা। ম্যাডামের গানের খাতায় প্রথম যে-গানটি লেখা ছিল, তার প্রথম লাইন—‘আনন্দ তুমি স্বামী’।

মান্নাদা আবেগের কাছে হার মেনেছেন বারবার। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে এমন কিছু নয়, কিন্তু মান্নাদার কাছে অনেক কিছু। মান্নাদার একটা দম-দেওয়া দেওয়াল ঘড়ি ছিল। বহু দিনের পুরোনো বিদেশি ঘড়ি। মান্নাদার বিয়ের আগে কেনা। তার মানে সে-ঘড়ির বয়স এখন ৬০ বছরের বেশি। যতই ব্যস্ত থাকুন, প্রতিদিন সকাল দশটায় মান্নাদা নিজের হাতে সেই ঘড়িতে দম দিতেন। যখন বোম্বে থেকে পাকাপাকি ভাবে বেঙ্গালুরু চলে আসেন, শুধু কয়েকটি প্রিয় জিনিস নিজের হাতে গুছিয়ে নিয়েছিলেন। একটি সাদা সরস্বতীর মূর্তি, কালো ক্যানভাসে একটানে আঁকা সাদা রঙের রবীন্দ্রনাথের ছবি, আর ওই দেওয়াল ঘড়িটা। ওই ঘড়িতে দম দেওয়ার ব্যাপারে অন্য কারও ওপর ভরসা করতে পারতেন না মান্নাদা। দম দেওয়ার একটা বিশেষ কায়দা ছিল। ছোট মেয়ে সুমিতা সেটা রপ্ত করেছিল। যখন মান্নাদা থাকতেন না, দায়িত্ব পড়ত সুমিতার ওপর। হাসপাতালের শেষ দিনগুলিতেও বাড়ির লোকদের মনে করিয়ে দিতেন দুটি কাজের কথা—ঘড়িটায় দম দিও, আর গাড়িটায় মাঝে মাঝে স্টার্ট দিও যেন বসে না যায়।

মান্নাদার দুই প্রিয় বন্ধুর কথা বলি। এরা কেউ কিন্তু সঙ্গীত বা চলচ্চিত্র জগতের নয়। কিন্তু ‘হরিহর আত্মা’ বন্ধু বলতে যা বোঝায়, এরা ছিলেন মান্নাদার তেমনই বন্ধু। শান্তিলাল ভাই শাহ ছিলেন গুজরাতের মানুষ। থাকতেন বোম্বেতে। ভিলে পার্লে-ওয়েস্টে ৮টি বিল্ডিং নিয়ে হাউজিং কমপ্লেক্স। পঞ্চাশের দশকে মান্নাদা সপরিবার এখানে থাকতেন। পাশের বিল্ডিঙে শান্তিভাই। মান্নাদার দুই মেয়ে— সুরমা ও সুমিতা। শান্তিভাইয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে—রাজেশ ও পারুল। সুমিতা তখন এক বছরের। ৮ বছরের বড় পারুল মান্নাদার বাড়িতে সারাদিন পড়ে থাকে। ওর খুব কৌতূহল বাচ্চা সুমিতাকে কেমন করে চান করায়, কেমন করে খাওয়ায়, কেমন করে ঘুম পাড়ায়। রোজ সুমিতাকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে আসে। এ ভাবে আস্তে আস্তে দুটি পরিবারের মধ্যে ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রাখি উৎসব এলেই তখন অন্য আনন্দ। দুটি পরিবার মিলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আর চার ভাইবোনের রাখি পরানোর অনুষ্ঠান। কোনও দিন এর ব্যতিক্রম হয়নি। মান্নাদার কাছে শান্তিভাই শুধু বন্ধুই ছিলেন না, ছিলেন ফিলোজফার ও গাইডও। যে কোনও বিষয়ই হোক শান্তিভাইয়ের পরামর্শ নেবেনই মান্নাদা। সে পারিবারিক ব্যাপার হোক কিংবা ব্যক্তিগত কোনও বিষয়। ১৯৮৫ সালে শান্তিভাই চলে গেলেন। মান্নাদার কাছে সে এক বড় ধাক্কা। দুই পরিবারের সম্পর্ক কিন্তু ছিল প্রবহমান। আজ মান্নাদাও নেই। কিন্তু যে কোনও পরিস্থিতিতে সুমিতার ফোন যায় শান্তিভাইয়ের পুত্র রাজেশের কাছে। বড় নির্ভরতার জায়গা সেটা। বড় ভাইয়ের মতো রাজেশ এখনও স্নেহের বোনটির পাশে আছে।

মান্নাদা ও সুলোচনাদেবীর খুব ইচ্ছা, বোম্বেতে মনের মতো একটা নিজেদের বাড়ি হোক। গানের ঘরটিকে বিশেষ করে সাজাতে হবে। আর থাকবে একটা বাগান, যেখানে থাকবে নানা ধরনের ফুলগাছ।। এর জন্য অনেকটা জমি দরকার। সেটা আবার বোম্বের মধ্যেই হতে হবে। সন্ধান দেবে কে? কে আবার? শান্তিভাই তো আছেন। একদিন দল বেঁধে সবাইকে নিয়ে শান্তিভাই গেলেন জুহু স্কিমে বাড়ির জন্য জমি দেখতে। এখানে ফিফথ কর্নার রোডে শান্তিভাইয়ের জমি, অমিতাভ বচ্চনের টেন্থ কর্নার রোডে। শান্তিভাই মান্নাদাকে যে জমিটি দেখালেন, সেটি হল সেভেন্থ কর্নার রোড। মান্নাদা তো জমি দেখে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।—তুমনে কেয়া পাগল হো গ্যয়া? এ তো ধু ধু ফাঁকা প্রান্তর। মানুষজনই নেই। আসলে তখন তো অত বাড়িঘর হয়নি। খুব কাছেই সমুদ্র। হু হু করে ছুটে আসছে হাওয়া। মান্নাদা বললেন, ‘‘সব সময় এমন প্রচণ্ড হাওয়া। দুদিনেই আমার গানের বারোটা বেজে যাবে।’’ মান্নাদা একটি বিগ নো বলে দিলেন। মান্নাদার কাঁধে হাত রাখলেন শান্তিভাই। মান্নাদার চোখের সামনে ওই জমিটির ভবিষ্যতের ছবি আঁকলেন—এমন তো বেশি দিন থাকবে না। ইতিমধ্যেই সমাজের ক্রিম অব পিপল এখানে জমি কিনতে শুরু করেছে। নতুন নতুন বাড়িও তৈরি হচ্ছে। কিছু দিন গেলে সমুদ্রের হাওয়া এমন ভাবে সরাসরি এসে ধাক্কা দেবে না। মান্নাদা তখনও খানিকটা দোনামোনায় ছিলেন।

ভবিষ্যতের ছবিটা আর একজন কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পেলেন। তিনিই একদিন অনেক স্ট্রাগলারের মধ্যে মান্নাদাকে দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, আজকের পরিস্থিতি যেমনই হোক, ভবিষ্যতে এই মান্না দে-ই হয়ে উঠবেন ভারতবর্ষের সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভবিষ্যৎ দেখতে, তাকে চিনতে তার ভুল হয় না। তিনি মান্নাদার সহধর্মিণী সুলোচনাদেবী। কল্পনায় তিনি একটা ছবি আঁকলেন। মাই সুইট হোম। বোঝালেন মান্নাদাকে। মান্নাদা আর কী করেন! একদিকে প্রাণের বন্ধু শান্তিভাই, অন্যজন তার প্রাণের প্রাণ প্রিয়তমা স্ত্রী। রাজি হয়ে গেলেন মান্নাদা।

তৈরি হল তাঁর স্বপ্নের বাড়ি—‘আনন্দন’। বাড়ির চারদিকটা আস্তে আস্তে ছবির মতো সেজে উঠল। মান্নাদা বলতেন, ‘‘আই মাস্ট সে ইট হ্যাপেন্ড অনলি ফর শান্তিভাই। অফকোর্স সুলু অলসো কনভিন্সড মি।’’

আজ মান্নাদা নেই, শান্তিভাই নেই, নেই সুলোচনাদেবীও। আর নেই ‘আনন্দন’ও।

আছেন ওম সেগান। মান্নাদার আর এক প্রাণের বন্ধু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manna Dey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE