Advertisement
E-Paper

তিন দু’গুণে ৩

অর্থাৎ বচ্চন থেকেও ছবিটা জমল না। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় না। হাত কচলে ‘ইয়ে মানে একটু ট্রিবিউট...’ না। সোশ্যাল মিডিয়াকে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও সুযোগই দিচ্ছেন না সুজয় ঘোষ আর ঋভু দাশগুপ্ত। ছবির গোড়াতেই গোটা গোটা করে লিখে রেখেছেন, আমরা কোরিয়ান ছবি ‘মন্তাজ’য়ের রিমেক বানাইতেছি। ঝামেলা চুকে গেল।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৬ ০৬:২৬

কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় না। হাত কচলে ‘ইয়ে মানে একটু ট্রিবিউট...’ না। সোশ্যাল মিডিয়াকে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও সুযোগই দিচ্ছেন না সুজয় ঘোষ আর ঋভু দাশগুপ্ত। ছবির গোড়াতেই গোটা গোটা করে লিখে রেখেছেন, আমরা কোরিয়ান ছবি ‘মন্তাজ’য়ের রিমেক বানাইতেছি।

ঝামেলা চুকে গেল।

দর্শক তার মানে আপনা থেকেই দুটো দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা ‘মন্তাজ’ দেখেছেন এবং যাঁরা দেখেননি। যাঁরা দেখেননি, তাঁরা ‘তিন’ দেখবেন কোনও রকম তুল্যমূল্য বিচার ছাড়াই। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ‘তিন’ দেখবেন তুল্যমূল্য বিচার করবেন বলেই। অনেকটা চেনা ইংরেজি উপন্যাস বাংলা অনুবাদে পড়ার মতো। অনুবাদটা কেমন হল, সেটার আস্বাদ নেওয়াই সেখানে উদ্দেশ্য।

দু’দল দর্শকের জন্যই অবশ্য এ বাদেও ‘তিন’-এ আর একটা ‘দে জা ভ্যু’র জায়গা থেকে যাচ্ছে। কলকাতার বুকে হিন্দি থ্রিলার, অমিতাভ বচ্চন-নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি-বিদ্যা বালন একসঙ্গে, পরিচালক না হলেও প্রযোজকের আসনে সুজয় ঘোষ...! ফলে ‘কহানি টু’-এর আগেই আর একটা ‘কহানি টু’ দেখতে পাওয়ার প্রত্যাশা ঠেকায় কে? সুতরাং ‘তিন’-এর জন্য শুধু ‘মন্তাজ’ নয়, ‘কহানি’র সঙ্গে তুলনাও প্রতি পদে অপেক্ষা করছে।

এত রকম তুলনার পাহাড় মাথায় নিয়ে চলাটা একটু মুশকিল। তরুণ পরিচালক ঋভু দাশগুপ্ত সবটা সামলাতে পারেননি। রহস্যভেদী তিনটি চরিত্রকে সমান ভাবে বিকশিত হয়ে ওঠারও সুযোগ দেননি। ফলে অমিতাভ এবং নওয়াজকে দেখার জন্য গেলে ঠিক আছে। বিদ্যার ভক্তরা কিন্তু খানিকটা হতাশ হতেই পারেন। বিদ্যা এখানে পুলিশ। কিন্তু তাঁর বিরাট কিছু করার নেই, নওয়াজের সঙ্গে একটি দৃশ্য ছাড়া। আশা করেছিলাম, ছবির শেষে ওঁরা আর একবার একান্তে মুখোমুখি হবেন। হলেন না।

এবং তুলনার প্রশ্নে এটা বলা যেতেই পারে, ‘মন্তাজ’‌য়ে এই রকম কোনও অসম্পূর্ণতার জায়গা ছিল না। সেখানে ছিল এক মায়ের গল্প (এখানে অমিতাভ)। এক গোয়েন্দা অফিসারের গল্প (এখানে নওয়াজ)। আর গোটা পুলিশ টিম (মূলত বিদ্যা)। অর্থাৎ ঋভু অনেকটাই নিয়েছেন, হুবহু নিয়েছেন। আবার অনেক কিছু পাল্টেওছেন। প্রধান তফাতটা গড়ে দিয়েছেন স্বয়ং অমিতাভই। তাঁর অসহায়, ভারাক্রান্ত দুমড়োনো মুখই ‘তিন’-এর সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

অতএব আমরা কোরিয়া ছেড়ে কলকাতায় আসি। আট বছর আগে অমিতাভর নাতনিকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওই অবস্থাতেই সে মারা যায়। আট বছরেও ধরা পড়েনি অপরাধী। অমিতাভ প্রতিদিন নিয়ম করে থানায় গিয়ে ধর্না দেন। যদি কোনও সূত্র মেলে! মেলে না অবশ্যই। ফলে বৃদ্ধ আবার তাঁর পঙ্গু স্ত্রীর কাছে, ভাঙাচোরা সংসারে ফিরে আসেন। আট বছর আগের তদন্তকারী অফিসার মার্টিন পুলিশের উর্দি ছেড়ে পাদ্রি হয়ে গিয়েছেন। অমিতাভ অর্থাৎ জন বিশ্বাস তাঁকেও নিয়মিত জিজ্ঞেস করেন, কিছু কি করার নেই?

করার ছিল। আর সেটা করে দেখানোর দায়িত্বটা অমিতাভই নেন। এবং সমান্তরাল ভাবে ঠিক একই সময় শহরে আরও একটি বাচ্চা একই ভাবে অপহৃত হয়। পুলিশ অফিসার বিদ্যা আর ‘প্রাক্তন’ অফিসার নওয়াজ সেটার গিঁট খুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক বৃদ্ধ এবং দুই অফিসার, এই তিন জনের অনুসন্ধান কী করে একটা মোড়ে এসে মেলে, সেটাই গল্প। থ্রিলারের চুম্বক এর চেয়ে বেশি বলে দেওয়াটা অপরাধ। যাঁরা ‘মন্তাজ’ দেখেননি, তাঁদের জন্য তো বটেই।

কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না। ‘তিন’-এর একটা বড় সমস্যা হল, গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে একটি মাত্র কোইনসিডেন্স-এর উপরে। অমিতাভ যদি বাজারে গিয়ে নাতনির টুপিটি মাথায় দেওয়া এক মেয়েকে দেখতে না পেতেন, তা হলে কিছুই ঘটত না। এত প্রত্যন্ত একটি কোইনসিডেন্স-এ ভরসা করে গল্প এগোলে সেটা খুবই আরোপিত বলে মনে হতে বাধ্য। ‘কহানি’তে মিলন দামজির ঘরে ঢুকে চায়ের গেলাস পাওয়া এবং সেই সূত্রে চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করে ক্লু পাওয়াটাও একটা কোইনসিডেন্স। তবে অতি স্বাভাবিক কোইনসিডেন্স! কিন্তু কলকাতা শহরে হঠাৎ এক দিন মাথায় টুপি পরে ক্লু নিজে এসে আপনার সামনে দাঁড়াবে, এটা প্রায় অলৌকিক নয় কি? এই গাঁথনিটা দুর্বল বলেই ছবিটা জায়গায় জায়গায় অনাবশ্যক এলায়িত বলে মনে হয়। আবার দ্বিতীয়ার্ধে ক্লাইম্যাক্স তার প্রত্যাশিত ধাক্কা দিতে পারে না। একসঙ্গে অনেক কিছু হুড়োহুড়ি করে এসে গেল বলে বোধ হতে থাকে।

থ্রিলার-এর প্রধান উপাদান যে সাসপেন্স, সেটা ‘তিন’-এ আছে। কিন্তু সেটা তেল-নুন-লঙ্কা সহযোগে আরও মাখোমাখো হওয়া দরকার ছিল। ছবি জুড়ে রহস্যের অলিগলিতে অনেকগুলো মুখ এসে দাঁড়ায় বটে। কিন্তু কেউ নিজেকে স্মরণীয় করে তোলার জায়গা পায় না। এমনকী সব্যসাচী চক্রবর্তীও না। এ ছবিতে ফেলুদা না হয়েও তিনি চারমিনার খাচ্ছেন দেখে পুলকিত হলুম। কিন্তু তাঁর জম্পেশ অভিনয় দেখার সুযোগ পেলুম কই? ‘মন্তাজ’য়ে তাঁর চরিত্রটি কিন্তু এর চেয়ে বেশি জায়গা পেয়েছিল।

‘তিন’-এ অভিনয়ের সুযোগ যা পেয়েছেন, অমিতাভ আর নওয়াজই পেয়েছেন। অমিতাভর কাছে অবশ্য এই অভিনয়টা জলভাত বলেই মনে হয়। ইনসাফের খোঁজে জনৈক বৃদ্ধের ভূমিকায় তাঁকে আগেও দেখেছি। ‘বিরুধ’ ছবিটার কথা যাঁদের মনে আছে, তাঁদের কাছে ‘তিন’ খুব চমকপ্রদ নাও লাগতে পারে। আর অমিতাভ অভিনয় করলে কোনও জনৈকই তো জনৈক থাকেন না। আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো জন বিশ্বাসরা, পাড়ার পাঁচুবাবুরা এমনিতে ‘নোবডি’ হলেও অমিতাভ যখন তাঁদের ধারণ করেন, তাঁরা নিমেষে ‘সামবডি’ হয়ে ওঠেন! সেখানেই তারকার দ্যুতি! ভাঙা টেপ রেকর্ডার, ভাঙা স্কুটার সম্বল করেই তিনি যোদ্ধা। আর সবার উপরে তিনি অমিতাভ বচ্চন। দৈবাৎ তাঁর হাত কেটে রক্ত বেরিয়ে গেলে গোটা হল সমব্যথায় ইশশ বলে ওঠে! অমিতাভর সঙ্গে নাসিরউদ্দিনের স্টুপিড কমন ম্যান এইখানে আলাদা হয়ে যায়।

আলাদা হয়ে যান নওয়াজউদ্দিনও। নওয়াজ যে চরিত্রাভিনেতা! যে পাত্রে রাখা হবে, সেই পাত্রের আকার নেবেন। ঠান্ডা, স্বল্পবাক মার্টিনকে দেখলে ইনস্পেক্টর খানের দোসর বলে মনেই পড়ে না।

‘তিন’-এর আর একটি সম্পদ তার চিত্রগ্রহণ। তুষারকান্তি রায় কোথাও কলকাতা এবং তার আশপাশকে আলাদা করে গ্ল্যামারে মোড়েননি। আলাদা করে রহস্যময়ও করে তোলেননি। গঙ্গা, ভিক্টোরিয়া, ট্রাম, দুর্গাঠাকুর...সবই আছে। কিন্তু খুব দৈনন্দিনের মতো করে আছে। এরা কেউ ছবির শো-স্টপার নয়। নিজেকে জাহির না করার এই ঝোঁকটা সঙ্গীতেও থাকলে ভাল হত। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে ক্লিন্টন সেরেজো বড্ড বেশি উপস্থিত। অতিকথন কিন্তু রহস্য বাড়ায় না। ‘তিন’-এর পরে চারের দানে আশা করব, ঋভুর টিম আরও ভাল খেলবে।

TE3N
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy