টিকিটাকা
পরিচালনা: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়: পরমব্রত, ঋতাভরী, এমোনা, শাশ্বত, কাঞ্চন, পরান, খরাজ, শান্তিলাল
৫/১০
আরও একবার নিজের পছন্দের খেলা নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তবে ‘লড়াই’-এর মতো শুধুই ফুটবল নয়, এ ছবির আরও অনেক পরত রয়েছে। খেলাটাকে ঘিরে বাঙালির চিরকালীন উন্মাদনা, লাল-হলুদ আর সবুজ মেরুনের তরজা, একটি ‘কমিক্যাল’ ড্রাগ চক্র আর দুই ভিনদেশির অনাবিল এক বন্ধুত্বকে সম্বল করে ২০১৮ সালে পরমব্রত তৈরি করেছিলেন ‘খেলেছি আজগুবি’। এক সর্বভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যা সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘টিকিটাকা’ নামে। গল্পের মুখ্য চরিত্রের নামের পানিং ও ছবিজুড়ে থাকা বহু পাঞ্চলাইনই মাঠে মারা গিয়েছে হিন্দি ডাবড ভার্সনটিতে। তবে মোটের উপর উপভোগ্য ছবিটিতে ‘আজগুবি’র পারদ এতটা না চড়লে হয়তো আরও চালিয়ে খেলতে পারত এই কমেডি অ্যাডভেঞ্চার।
আসলে ফুটবলের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত বাঙালি আবেগকে হাতিয়ার করে একটা গল্প বলতে চেয়েছিলেন পরমব্রত, যার মূল ভিত খেলেছি (এমোনা এনাবুলু) আর রাজুর (পরমব্রত) বন্ধুত্ব। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই সেনেগাল থেকে আসা খেলেছির মোলাকাত হয় ট্যাক্সিচালক রাজুর সঙ্গে। তার সঙ্গে একটি ফুটবল, ভিতরে মাদক। সেটি পৌঁছে দিতে হবে এ শহরেরই এক দুঁদে ড্রাগলর্ড পিকে-র (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) কাছে। এই হস্তান্তরের খেলাতেই যত গোল বাধে, ব্রেকিং নিউজ়ের আশায় সেই গোলমালে জড়িয়ে পড়ে জার্নালিস্ট বনিও (ঋতাভরী চক্রবর্তী)। এর পরের আজগুবি রোলার কোস্টারটিতে ফ্যান্টাসির মাত্রা কিঞ্চিৎ বেশি হয়ে যাওয়ায় গোলমেলে লাগতে থাকে আস্ত ছবিটিই।
আফ্রিকা মহাদেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে এ শহরে আসা বেশির ভাগ মানুষকেই ‘ফুটবলার’ বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে আম-বাঙালির। কিন্তু সেই বদ্ধমূল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কি সাংবাদিকতা চলে? বিন্দুমাত্র যাচাই না করেই খবরের কাগজ, টিভিতে ভুয়ো খবর শিরোনাম হয়ে যাওয়াটা বেশ কষ্টকল্পনা। তা ছাড়া আইএসএলের যুগে ক্লাব ফুটবলকে ঘিরে বাঙালির আবেগেও যে পরিবর্তন এসেছে, তার আভাস পাওয়া গেল না। গুন্ডাদের ভাঁড়ামো, তাদের কিংবা পুলিশের মুখে একই কয়েনেজের পুনরাবৃত্তিও মধ্যমানে আটকে রেখেছে চিত্রনাট্যকে। সংখ্যায় কম হলেও কিছু সংলাপ ও দৃশ্য আবার মনে রাখার মতো। যেমন, রাতে দুই বন্ধুর ছাদে বসে দিলখোলা আড্ডা, ব্যাকড্রপে আলো-ঝলমলে হাওড়া ব্রিজ। রাতের কলকাতা কিংবা ময়দানে শুট করা অংশগুলি লকডাউনের আবহে দমকা অক্সিজেনের মতো। আবার খেলার ময়দানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে যুবভারতীর উল্লাস তৈরি করতে চাওয়া দৃশ্যগুলির নির্মাণ দুর্বল। ক্যালিপ্সো, র্যাপের পাশাপাশি সফট রোম্যান্টিক গানের ব্যবহার— ছবির সঙ্গীতে বৈচিত্র আনার চেষ্টা রয়েছে। যদিও সেগুলি তাৎক্ষণিক ভাল লাগার বেশি কিছু নয়।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের মতো অভিনেতাদের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়া এ ছবির আরও একটি খামতি। সারা ছবিতে তাঁরা হাতেগোনা দৃশ্যে আসেন, গতেবাঁধা সংলাপের পুনরাবৃত্তি করে চলে যান। কাহিনির সব চরিত্রই যেন কপিবুক স্টাইলে কথা বলে, চলাফেরা করে— যে অতিরঞ্জন ছবির স্মার্টনেসকে ক্ষুণ্ণ করে। ছবির এক জায়গায় রাজু বলে, ‘ট্যাক্সি চালাই বলে আন্ডারএস্টিমেট করছেন?’ ঠিক একই রকম ভাবে ট্যাক্সিচালক বলেই তাঁর মেকআপ ও রকম প্রেডিক্টেবল না হলেই পারত। শরীরী ভাষা ও মুখের ভাষায় যদিও রাজু হয়ে ওঠার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন পরমব্রত। বন্ধুত্বের খাঁটি আবেগ ধরা পড়েছে তাঁর অভিনয়ে। ঋতাভরী নিজের চরিত্রে সাবলীল। স্পেশ্যাল অ্যাপিয়ারেন্সে ঋদ্ধি সেন ও সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাল লাগে। পরমব্রতর সঙ্গে এই জুটির দৃশ্যক’টি ‘সমান্তরাল’-এর ট্রায়োকে মনে করিয়ে দেয়।
‘টিকিটাকা’য় কিছু টিপিক্যাল বাঙালি আবেগ নিয়ে খেলা করেছেন পরমব্রত। তা কতটা সর্বজনীন হতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। আজগুবির মাত্রা কমিয়ে সম্ভাবনাগুলি নিয়ে যদি আরও একটু গভীরে ডুব দিতেন পরিচালক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy