Advertisement
E-Paper

আমার গলার সঙ্গে মেলে এমন হিরোইন টালিগঞ্জে নেই

গায়ক জীবনের কুড়ি বছর। সুখের পাশাপাশি উত্তেজিত লোপামুদ্রা মিত্র। শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় ভ্যালেন্টাইন শব্দটা শুনলে আমি প্রচণ্ড রেগে যাই। আমি ডাকাবুকো, তেড়েমেড়ে কথা বলি, আমাকে কেউ গোলাপ দিয়ে ভালবাসা জানানোর সাহসও পায় না। বারাসতে রূপঙ্করের সঙ্গে শো করলাম। ভালবাসার যেটুকু বেঁচে আছে, সবটাই গানের মধ্যে।

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৩

ভ্যালেন্টাইন্স ডে কেমন কাটল?

ভ্যালেন্টাইন শব্দটা শুনলে আমি প্রচণ্ড রেগে যাই। আমি ডাকাবুকো, তেড়েমেড়ে কথা বলি, আমাকে কেউ গোলাপ দিয়ে ভালবাসা জানানোর সাহসও পায় না। বারাসতে রূপঙ্করের সঙ্গে শো করলাম। ভালবাসার যেটুকু বেঁচে আছে, সবটাই গানের মধ্যে।

জেন ওয়াই ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে মেতে আছে। আপনি যদি ভ্যালেন্টাইন্স ডে-কে এভাবে দূরছাই করেন তা হলে নতুন প্রজন্ম আপনার গান কেন শুনবে?

না শুনলে নাই শুনবে। শুনুন, বড় হিসেবে আমি চাইব আজকের ছেলেমেয়েরা যেন ভালবাসার জন্য বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা না দেয়। আমি তো বড়। আমার কোনও দায়িত্ব নেই?

আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যে লোপামুদ্রা কবিতার গান গেয়ে বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোপামুদ্রা এখন কোথায়?

কুড়ি বছর আগে ‘বেণীমাধব’ গাওয়া লোপামুদ্রা আজ আর নেই।

নেই মানে?

সে ভিতু হয়ে গিয়েছে। শো ধরে রাখার জন্য তাকে ইচ্ছে না করলেও ‘হরি হে দীনবন্ধু’ গাইতে হয়। আমার ওপর আমার মিউজিশিয়ানরা নির্ভর করে আছে। সেটা কী করে ভুলে যাই বলুন?

নিজের বাজার ঠিক রাখতে সেই জন্যই আপনি কবিতার গান ছেড়ে ফোক গাইতে শুরু করেছেন?

অগত্যা। ‘হৃদমাঝারে’ অসম্ভব জনপ্রিয় হল। এই শীতকালেই তো রোজ শো-শো আর রোজ একঘেয়ে গানের অনুরোধ ‘ছাতা ধরো গো দেওরা’, ‘ধা ধিন না, না তিন না’, ‘আয় আয় কে যাবি’। নিজের পছন্দ মতো গান গাইতেই পারি না।

বাংলা গানের দর্শকও বদলে গিয়েছে তা হলে?

দেখুন, আগে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষের গান গাইতাম। অফিসের অনুষ্ঠানে, ব্যাঙ্কের অনুষ্ঠানে লোকে এই ধরনের গানই শুনত। এখন সে সব কই? এখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার থেকে অফিসের বড় কর্তা, বাঙালি ক্লাব— সবাই পয়সা ঢালে মুম্বইয়ের আর্টিস্টের জন্য। আর পয়সা কম থাকলে ফ্যামিলি পিকনিক, সস্তার ডিজে আর মদ খাওয়া। বাংলা গানের জন্য পয়সা, মনোযোগ কিছুই তো আর নেই। গত পরশুর শো-তেই ‘পাগলু’ গাইতে বলছিল। ‘লুঙ্গি ডান্স’-এরও রিকোয়েস্ট আসে...

কী করেন তখন?

আগে খুব রাগ হত। এখন ভাবি সেই কবিতার লাইন—‘এও ভারি আশ্চর্য, গা বাঁচানোর নাম দিয়েছে সহ্য’। কবিতার জন্য আলাদা পাঠক দল আছেন, তাঁরাই আমার প্রথম গানের শ্রোতা ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়েই ‘বেণীমাধব’ সকলের গান হয়েছিল। কিন্তু আজ কবিতার গান শোনার মনঃসংযোগ তো কারও নেই।

কারও কারও মতে অনুপম রায়ের গানও তো কবিতাধর্মী। সেগুলো এত জনপ্রিয় কী করে হচ্ছে?

অনুপম রায়ের নির্দিষ্ট শ্রোতা আছে। আমি যে সব জায়গায় শো করতে যাই, সেখানে কিন্তু অনুপম রায় বা রূপম ইসলাম কেউ শো করতে পারবে না।

কেন?

সদ্যই আমডাঙা পুলিশ স্টেশনে গান গাইতে গিয়েছিলাম। সেখানে লুঙ্গি পরা, বিড়ি খাওয়া জনতা। আমি যদি কবিতার গান গাইতাম, তা হলে মোটেই সেটা লোকে শুনত না। যেহেতু আমি ‘শুনা বন্দে’, ‘ধা ধি না না তি না’, ‘ছাতা ধরো হে’র— মতো ঝিমপরাক্কা গান গাই, লোকে সেটা শোনে। কথার ধার ধারে না, কেবল তালে তালে নাচে।

কিন্তু ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’র জনপ্রিয়তা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।

(উত্তেজিত) শুনুন, ওই গানটা সকলের গান। আমি অনুপমের অন্য গানের কথা বলছি। সেগুলো সব শ্রোতার জন্য নয়। আমাকে যেমন ‘বসন্ত এসে গেছে’ গাইতে বলা হয়। লোকে কিন্তু জানে না, ওটা আসলে কার গান! ‘সারেগামাপা’র দৌলতে এখন সবাই সব গান গাইছে। কারও মধ্যে আর কোনও নিজস্বতা নেই। মুম্বইতেও দেখছি অরিজিৎ সিংহর গলার মতোই সব পুরুষের গলা। কে কোন গান গাইছে, আলাদা
করে বোঝা যায় না। এই বছর
লেক ক্লাবে আকৃতি কক্কর গান গাইল। ও দারুণ গায়। জয়কে ‘দাদা দাদা’ করে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, ও কি টানা ছ’বছর লেক ক্লাবের অনুষ্ঠানে ডাক পাবে? আমরা কিন্তু কুড়ি বছর
আছি। আমরা বেসিক গানের লোক। টিভি-রেডিয়ো কোথাও কিন্তু আমাদের গান বাজছে না। গান হিট হবে কোথা থাকে?

আপনি তো এখন সিনেমার গানেও নেই।

আমি ডাকাবুকো, আমার এই স্বভাব গানের মধ্যেও ফুটে বেরোয়। আমার গলার সঙ্গে মেলে এমন হিরোইন টালিগঞ্জে কোনও দিনই ছিল না। এই রকম মেয়েকে কেউই পছন্দ করে না। তবে আমি আজও চলছি অনুপমের ‘আমার মতে তোর মতোন কেউ নেই’ গানে। গ্রামে শো করেও এই গানের প্রচুর অনুরোধ পাই। ‘বুনো হাঁস’য়ের গানও ভাল হয়েছিল, কিন্তু ছবিটা চলেনি।

মুম্বইতে এখন ভাঙা কণ্ঠস্বর, দরাজ গলার কদর। মনে হয়নি মুম্বই যাই?

আমি দেখেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে-র পরেই আমার সমসাময়িক যাঁরা কলকাতা থেকে মুম্বই গিয়েছিলেন, প্রত্যেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন।

যেমন?

শ্রীকান্তদা গিয়েছিল, রাঘব, রূপঙ্কর— সকলেই ফিরে এসেছে। আর আমি একদম ব্যর্থতা নিতে পারি না। আমি আসলে রাতের সেই ভিখিরিটার মতো, যে ভিক্ষা করে রোজ দশ টাকা পায়। তাতেই খুশি থাকে। তাকে আমেরিকা নিয়ে যেতে চাইলে সে যাবে না। কলকাতার মধ্যে গান গেয়ে প্রচুর সম্মান পেয়েছি। মুম্বইয়ের শ্রেয়া, অরিজিৎ, আকৃতি সবাই বাড়ি এসে আড্ডা মারে। কিন্তু আমি কোনও দিন ওদের সঙ্গে শো করতে পারব না। মুম্বই যেতে হলে খাটতে হত, হিন্দি শিখতে হত। আর কত স্ট্রাগল করব?

কেন, আগে কি স্ট্রাগল করতে হয়েছে?

আমার বাবা আজ অবধি আমার শো শুনতে যাননি। রবীন্দ্রনাথের বাইরে গিয়ে আমার অন্য গান গাওয়া বাবার পছন্দ ছিল না। আমাকে প্রচুর ফাইট করতে হয়েছে। এই জায়গাটাকেই ধরে রাখতে চাই। আর নতুন কোনও ফাইট চাই না। রিস্ক নেওয়ার সাহস নেই।

আপনি ফোক গানও আধুনিকের মতো করে গান। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যারেঞ্জমেন্ট পাল্টে দেন...

আমি তো আমার মতো করেই গাইব। কালিকাপ্রসাদ আমায় বলেছিল, ‘‘তুমি ভাওয়াইয়া গাওয়ার সময় গলা ভেঙে নকল করে গাইবার চেষ্টা কোরো না।’’ এই যে সোমলতা ‘মায়াবনবিহারিণী’ নিজের মতো করে গেয়েছে—তা ওর মনে হয়েছে ও গেয়েছে।

(হঠাৎই আড্ডায় জয় সরকার হাজির। সে দিকে তাকিয়ে লোপা বললেন, ‘‘ দেখুন জয় খুব টেনসড। আমি সাক্ষাৎকারে সব সত্যি কথা বলে দিচ্ছি তো, ও আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে।’’)

আচ্ছা অনুপমের বিয়েতে ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো?

কৌশিকদার (গঙ্গোপাধ্যায়) একটা ছবির গানে আমার গলার সঙ্গে কিছুতেই স্কেল মিলছিল না। ওই গানটা বাদ যায়। অনুপমের বিয়েতে কৌশিকদার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমি বললাম, কৌশিকদা, বেশ করেছ গান বাদ দিয়েছ। পরের ছবিতে কিন্তু প্লিজ ডেকো। সেটা শুনে জয় লজ্জায় মরে গেল।

(‘আবার আরম্ভ হল’ বলে জয় বেরিয়ে গেলেন)

জয় সরকার ও লোপামুদ্রা মিত্র। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

আপনি জয়ের প্রেমিকাদের নিয়ে টেনশন করেন না?

জয়ের ক্ষেত্রে একটা সময় খুব পজেসিভ ছিলাম। তাতে দেখেছি সংসারের অশান্তি বাড়ে। এখন আমি চাই ও আরও একটা বিয়ে করুক। তবেই আমার কদর বুঝতে পারবে।

কুড়ি বছরে পা দিয়ে বারো বছরে মুগ্ধ হয়ে যা ওয়া সেই লোকটার কথা বললেন না তো?

ওঃ! আমার কাকা সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলছেন? ওঁর জন্যই আমার কবিতার গান এত জনপ্রিয়। হুটহাট ট্রেক করেছি। ওর বাইকে করে কত জায়গায় বেড়াতে চলে গিয়েছি। আমি যে এই সময়ের মতো হতে পারলাম না তার কারণ উনি। কোনও দিন মিডিয়ার সামনে আসেননি। আমাকে আজও বলেন, ‘‘তুই আজকের সময়ের মানুষ নয় বলে, তোর মধ্যে বিষাদ আছে বলেই তুই গলা খারাপ থাকলেও দারুণ গান গেয়ে দিতে পারবি।’’ দিনের শেষে এটাই পাওয়া।

কুড়ি বছরে জয়ের সঙ্গে কিছু কাজ করবেন না?

জয়ের সঙ্গে কাজ করলে এত ঝগড়া হয়.... তবে ইচ্ছে আছে অরিজিৎ যে ভাবে অর্কেস্ট্রা নিয়ে শো করে, সেই রকম শো করার। দেখি বাংলা গানে এই রকম শো-এর জন্য কেউ পয়সা দিতে রাজি হয় কি না।

বাংলা গানের বাজার তো খুব খারাপ। রূপঙ্কর তেলেভাজার দোকান দেবেন বলছেন...

(উত্তেজিত) শুনুন, এটা প্লিজ লিখবেন রূপঙ্করের মতো গায়ক যদি এই কথা বলে, তা হলে বাংলা গান বন্ধ হয়ে যাবে। কত হিট গান ওর। সব রকম গান গাইতে পারে। রোজ দু’টো করে শো করে। ওর জায়গায় থাকলে কলকাতায় আমি দেড় লক্ষ টাকা চাইতাম। অনুপমও দারুণ মুভ করছে। ওকে তো বলি ওর জায়গায় থাকলে আমি পাঁচ লাখ টাকা চাইতাম। আমাদেরও অনেক দোষ আছে।

কী রকম?

এখন গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে প্রচুর হিংসে। আমরা যদি সকলে মিলে একটা মিউজিক কোম্পানি করতাম, তা হলে বাংলা গান কোথায় চলে যেত। আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। ভাবছি আমার দুটো সিডি বিক্রি হচ্ছে, রূপঙ্করের চারটে। এই সংখ্যাটা
তো সবাই জেনে যাবে। সেই কারণে আমরা কোনও দিন এক সঙ্গে হব না। আমি নাম করেই বলছি নচিকেতা চক্রবর্তী—তাঁর মতো শিল্পী কেন যেমন-তেমন করে শো করবেন? তিনি কেন কৈলাস খেরের মতো ব্যান্ড তৈরি করতে পারবেন না? কেকে-র মতো স্টেজ শো করতে পারবেন না? আমরা যদি কোয়ালিটি শো করি, তা হলে মুম্বই আর্টিস্টরা এখানে শো করে পয়সা নিয়ে চলে যেতে পারবে না।

আপনার প্ল্যানটা কী?

লোকে আমার কাছ থেকে আর নতুন কিছু শুনবে না। আমি
আমার মতো করে আর পাঁচ-ছ’বছর গাইতে পারলেই খুশি। তার পরে ঘুরে বেড়াব। আমার বুটিক ‘প্রথা’র জন্য কাজ করব। আর কী? কোনও দিন তো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতো বাড়ি করব ভাবিনি। আমার ছোট সংসার নিয়েই আমি তৃপ্ত।

Tollygunge Lopamudra mitra entertainment song
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy