তিনি নন আতসকাচের সঙ্গীতবেত্তা। চেনা কিসিমের ‘ক্রাউড-পুলার’ও তিনি নন। তিনি নন শ্রোতা-কম অভিমানে মঞ্চ ছাড়ার মানুষও। তিনি অসাধারণ ভাবে সাধারণ।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে প্রথম দেখা খড়দহে বাড়ির গা-ঘেঁষা চারুবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এলাকার ছোট নাটকের দলের ছোট্ট অনুষ্ঠানে। সাদামাঠা নামঘোষণা— ‘এখন একটু গান শোনাবেন আমাদের প্রতুলদা’। সেই ‘একটু’ যে অমন অবিশ্বাস্য হতে পারে, তার আন্দাজ সে-বয়সেও ছিল না, আজও নেই। প্যারিসে জন্মাইনি, যাইওনি। কাজেই, জানি না রাস্তাঘাট, ব্যস্ত মোড় বা কফিশপকে কী ভাবে নন্দনকলার অমরাবতী করে তোলা যায়। কিন্তু ‘সাতটি অমরাবতী’কে ভর করতেই দেখেছিল নির্জন মফস্সলের সেই প্রাথমিক স্কুল।
কোনও দ্বিধা ছিল না শিল্পী-শ্রোতার আত্মীয়তার নির্মাণে। মনে হয়েছিল, নিরলঙ্কার ভঙ্গির যে কীর্তনীয়া বা গাজন-সন্ন্যাসী ভরা-বসন্তে দোর থেকে ‘সিধে’ নিয়ে গান অসমাপ্ত রেখে চলে গিয়েছিলেন, তিনি যেন ফিরে এসেছেন একই অসীম-সাধারণত্বে গান সম্পূর্ণ করতে। তিনি অনুনয় করছেন— ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি/বেচো না, বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি’। তাঁর অনুনয় শুধু সুরে নয়, তাঁর চোখ-মুখ-সর্বাঙ্গ উপচে ঝরে পড়ছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন! গোটা শরীর দিয়ে গান গাওয়া কিংবা তুমুল রাজনৈতিক বক্তব্য, যা অনেক সময় তথাকথিত কাব্যময়তার ধারেকাছে না থাকা নির্দেশের মতোই, তাকেও প্রসন্নতার পরজে বেঁধে হাসিমুখে পেশ করা— অবিশ্বাস্য।
পরে যখন পরিচয় ঘন হল তাঁর গানের সঙ্গে— জুটমিলে-বন্ধ কারখানায়-সমাবেশে-বইমেলায়— তা এক রকম বিনা-চিঠির নেমন্তন্ন করেই টানল। এটাই জাদু প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের। আকর্ষহীন আকর্ষণ। সে-নিমন্ত্রণ যেন নিজেই নিজেকে করা। যেন আমার ভাষাই, আমাদের-আমার মুখর-প্রকাশোন্মুখ গদ্যপদ্য-ভাষই সুর হয়ে গলছে, গান হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবলা-তানপুরোর বেঁধে ওঠা নেই, আছে হঠাৎ হয়ে ওঠা। যন্ত্রানুষঙ্গ নেই, আছে যন্ত্রণানুষঙ্গ। ‘টেনর’-গন্ধী সেই কণ্ঠে মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যায় অর্থগাম্ভীর্যের রং। গায়কির সেই নানা গন্ধের রং তাঁর প্রেমে পড়তে বাধ্য করল। সেখানে দেশি মায়ের ঘুমপাড়ানি গুনগুঞ্জরণের সঙ্গে মিশে যায় বিদেশি মায়ের ‘হামিং’। হ্যাঁ, তাঁর কণ্ঠকে ‘মেয়েলি’ তকমা দিয়ে কিছু ‘পুরুষত্ব’ দেখিয়েছে হাতেগোনা বাঙালি, কিন্তু দু’বাংলার লাখো-কোটি নারী-পুরুষ সে-কণ্ঠে নিজের স্বর শুনতে পেয়েছেন। কণ্ঠের পেলবতাকে ঐশ্বর্য করে তোলা যে ‘আর্ট’, শাস্ত্রীয় গানের মার্গভূমি বঙ্গের বা শচীনকর্তার গানে পাগলোন্মাদ বাংলার তা কখনওই অজানা ছিল না। মাঠেঘাটে-ময়দানে তাঁর সেই একক-চিকন কণ্ঠেই জনগর্জন শোনা যেত। ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’র সে গর্জন, যাতে মনসামঙ্গল কাব্যের শ্রমজল লেগে, যাতে লেগে পাশ্চাত্যের শ্রমগন্ধও। সুরস্নাতক কবিমনের নিত্য-নিরীক্ষা ছাড়া এ সম্ভব নয়।
তিনি বাংলায় গান গান। তিনি বাংলার গানই গান। তবে তাঁর সুরপাত্রের জলদর্পণে পৃথিবীর মুখচ্ছবি প্রতিফলিত। তাই তাঁর গানের চ্যাপলিনকে আপনার-আমার পাড়ায় ভ্রাম্যমাণ ভবঘুরের মতো দেখতে, তাই সে গানের ‘প্রেম-প্রেম-প্রেম’ আমার-আপনার সবার আশ্লেষ। তাই অমন ‘সাপের মাথায় পা দিয়ে’ নাচে তাঁর সুর-সাপুড়ে শ্রীকণ্ঠ।
গদ্যে সুর দেওয়ার বীরত্ব রবীন্দ্রনাথ বিস্তর দেখিয়ে গিয়েছেন। বলা হয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও গদ্যে সুর দিতে পারতেন। সে দিক থেকে হেমন্তের মতোই একই উত্তরাধিকার বহন করছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। কেউ কখনও ভেবেছিলেন, অরুণ মিত্রের কবিতা ‘আমি এত বয়সে গাছকে বলছি’ তুমুল গান হয়ে উঠতে পারে! নিজে লিখেছেন, অন্যের কবিতায়-গদ্যে সুর দিয়েছেন। সদ্য-নয়া লেখা শুনেই প্রথমে শিশুর মতো উচ্ছ্বল হয়ে ওঠা আর সঙ্গে-সঙ্গেই সুর বসিয়ে দেওয়ার জাদু, তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আসলে, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান এক সদাপ্রস্তুত নাট্যাভিনয়ের নাম, যেখানে সুর প্রকাশভঙ্গিরই জাতক। তিনি সব মিলিয়ে চেনা সব ছকের বাইরে আলাদা ‘ফর্ম’।
এ-লেখায় ‘তিনি ছিলেন’ গোছের অতীত-আঙ্গিক ইচ্ছাকৃত ভাবেই বর্জিত। কারণ, তিনি আছেন। নানা ভাবে থাকবেনও। হয়তো বড় কথা বলা হয়ে যাবে, কিন্তু-তবু, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘আমার সোনার বাংলা’ বা ‘মোদের গরব মোদের আশা’র মতো ঐতিহাসিক গানের পাঠশালাতেই কি জন্ম নয় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ রচনার বিনম্র শ্লাঘার? এ-পৃথিবী এমন আত্মবিশ্বাস, এমন স্লোগান-গান, এমন জাতিসত্তার নিশান গানশিল্পে খুব বেশি কি সত্যিই পেয়েছে?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)