Advertisement
০১ মে ২০২৪
Review of Mujib

না আছে নুন, না রইল ধার! সাল-তারিখ বলা সেকেলে ইতিহাস ক্লাস প্রাপ্য ছিল না মুজিবের

বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন নিয়ে ছবি বানিয়েছেন শ্যাম বেনেগল। মুখ্যচরিত্রে আরিফিন শুভ। কেমন হল সেই ছবি?

Review of 2023 Bengali film Mujib: The Making of a Nation directed by Shyam Benegal

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবিতে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। ছবি: সংগৃহীত।

সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৩৯
Share: Save:

কোনও কোনও ছবি ইতিহাসভিত্তিক হতে পারে। তবে ‘ইতিহাস’ হয়ে ওঠা সহজ নয়। ইতিহাসের নানা দিক থাকে। প্রেক্ষিত বিশেষে ঘটনার বিশ্লেষণ নানা প্রকার হয়। ২ ঘণ্টা ৫৮ মিনিটের ছবির পরিসর ততটাও বড় হওয়া সম্ভব নয়। সে ছবি শ্যাম বেনেগলের মতো বড় নামের গুণী হাতে তৈরি হলেও নয়।

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবিটি। বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন নিয়ে ছবিটি তৈরি করেছেন শ্যাম। পূর্ববঙ্গের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মানো তরুণ ছাত্রনেতা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার যাত্রাপথ ধাপে ধাপে তুলে ধরা হয়েছে। তবে যে নেতাকে একটি নতুন দেশের ‘জনক’ বলে থাকেন অধিকাংশ, ভাষা আন্দোলনের প্রাণদাতা বলে বহু মুখে পরিচিত যিনি, তাঁর জীবন তো একমাত্রিক হতে পারে না। কিন্তু ক্যামেরায় ধরা জীবনীটি বড়ই আলুনি হয়ে রইল। সাল-তারিখ-সময়ের ঘেরাটোপে সেই পুরনোপন্থী ইতিহাসের ক্লাস হয়ে রইল শ্যামের ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পর্যন্ত না পৌঁছল ইতিহাসের ব্যাখ্যা, না মুখরোচক হল গল্প বলার মারপ্যাঁচ। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ধরে রাখা গেল না আবেগও।

Review of 2023 Bengali film Mujib: The Making of a Nation directed by Shyam Benegal

ছবিতে আরিফিন শুভর অভিনয় রীতিমতো তাকলাগানো। ছবি: সংগৃহীত।

ইতিহাস বলার ভঙ্গিতে ফাঁক থাকলেও আবেগঘন একটি ছবি তৈরির রসদ ছিল যথেষ্টই। প্রথমত, মুখ্যচরিত্র মুজিবুরের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। একটি দেশের মুখ তিনি। তাঁকে ঘিরে কৌতূহল থাকেই। তার উপর একটি গোটা জাতির ইতিহাস বলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ছবির নাম। কত সহজ ছিল নানা প্রান্তের বাঙালিকে এক আবেগে ভরে রাখার। তার উপর নাম ভূমিকায় আরিফিন শুভর অভিনয় রীতিমতো তাকলাগানো! যাঁরা ইতিহাস বইয়ে মুজিবুর রহমানের ছবি দেখে অভ্যস্ত, মাঝেমাঝে তাঁদের মনে হতেই পারে যে, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই দাঁড়িয়ে আছেন পর্দায়। মুজিবুরের স্ত্রী বেগম ফাজ়িলাতুন্নেসার ভূমিকায় নুসরাত ইমরোজ় তিশার অভিনয়ও দেখার মতো। এ ছাড়াও নুসরত ফারিয়া, ফজলুর রহমান বাবু, রিয়াজ, চঞ্চল চৌধুরীর মতো অভিনেতারা নিজ নিজ দায়িত্ব সযত্নেই পালন করেছেন। আছে শান্তন মৈত্রের সুর। এ ছবির গান বাংলার আবেগ অনেকটা বেঁধে রেখেছে। গ্রামবাংলায় মুসলিম বিয়ের গান হোক বা ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের ব্যবহার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। শমা জ়ইদির মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তি অতুল তিওয়ারির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চিত্রনাট্য লিখেছেন। আকাশদীপ পাণ্ডের ক্যামেরাও দু’-এক জায়গা ছাড়া মোটের উপর চেষ্টার ত্রুটি নজরে পড়তে দেননি। ফলে যত্নের অভাব ছিল বলা চলে না। তবু যেন নুন পেল না রান্না। ত্রুটি রয়ে গেল গল্পের চলনে। ধার রইল না ইতিহাস দেখানোর পক্ষপাতিত্বে।

Review of 2023 Bengali film Mujib: The Making of a Nation directed by Shyam Benegal

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবিতে আরিফিন শুভ। ছবি: সংগৃহীত।

জীবনীমূলক ছবি হোক বা উপন্যাস, তাতে পক্ষপাতিত্ব থাকবে। সেটা স্বাভাবিক। এমন সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রের দিক থেকেই ইতিহাসকে দেখা হয়ে থাকে। ‘মুজিব’ ছবিতেও তা-ই হয়েছে। কিন্তু পক্ষ নেওয়া আর ব্যাখ্যায় ত্রুটি থাকার মধ্যে এক মহাসাগর ফারাক আছে। সাল-সময়-তারিখ বলে দায়সারা ইতিহাস পাঠ এখন স্কুল পর্যায়ও আর চলে না। যে সব ইতিহাস ক্লাসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পণ্ডিতমশাইরা দাঙ্গার সময়ের বর্ণনা দিতেন, এমন ভাবে যাতে দাঙ্গা কী, তার ন্যূনতম ধারণা ছাড়াই দশ ক্লাসের পরীক্ষায় ‘স্টার’ নিয়ে পাশ করে যেত অনেকে। শ্যামের ইতিহাস ক্লাস খানিকটা তেমনই।

Review of 2023 Bengali film Mujib: The Making of a Nation directed by Shyam Benegal

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

এ উপমহাদেশের ইতিহাস বলা সহজ নয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরি, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্ম অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার কাহিনি হজম করেই হয়েছে। কলকাতার প্রেক্ষিত থেকে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার ইতিহাস দেখলে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা যেমন শোনাবে, ভিন্ন ক্ষেত্রে তা অন্য রকম শোনাতেই পারে। তা তো স্বাভাবিক। সে কারণেই ইতিহাসচর্চা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুজিবুরের মতো এক নেতা, যাঁকে একটি জাতির পথপ্রদর্শক বলে মানেন এত জনে, তাঁর জীবনী পর্দায় তুলে ধরতে গিয়ে এত হাত কাঁপবে কেন? কর্পোরেট অ্যাপ্রেজ়ালের খাতায় কাজের হিসাব লেখার মতো করে বলা গল্পটি আবেগ বাদ দিয়ে চলতে থাকে। মুজিবুরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সাল-তারিখ জানার জন্য এত সময় সিনেমা হলে ব্যয় না করে উইকিপিডিয়ায় চোখ রাখলেই যথেষ্ট ছিল।

সাল-তারিখের বেড়াজালে না পড়ে সাবলীল গল্প বলায় ভয় কোথায়? তাতে যদি অন্য কোনও নেতার নামে দু’টি কুবাক্য উঠে আসেও, তাতে ক্ষতি কী? রাজনীতিকদের নিয়ে ছবি বানালে রাজনীতি তো অন্তত থাকতে হবে তাতে। গা বাঁচিয়ে গল্প বলে সত্যি কি সম্মান জানানো যায় কোনও বাধাকে ভয় না করা মুজিবুরের মতো নেতাকে?

অন্য কেউ করলেও এক কথা ছিল। শ্যামের মতো অভিজ্ঞ চোখ এ সকল ত্রুটি এড়িয়ে গেলে প্রশ্ন থেকেই যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE