Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আগুন নয়, ভালবাসার উৎসব বাংলা ছবির অ্যালবামে

আবহটা যেন তৈরিই হয়ে আছে এই মুহূর্তে। আয়ার্ল্যান্ডে সমকামী বিবাহের স্বীকৃতি মিলছে। মুম্বইয়ে সমকামী ছেলের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন মা। রূপান্তরিতা মানবী কলেজের অধ্যক্ষ হচ্ছেন। সেরিব্রাল পলসিতে ভোগা একটি মেয়ে আর তার বান্ধবীর গল্প পর্দায় সাড়া জাগাচ্ছে। বাংলা ছবিও ‘সাবালিকা’ হচ্ছে। সাবালিকা-ই বলা উচিত। কারণ ঋতুপর্ণ ঘোষ সমকামী পুরুষের গল্প, রূপান্তরকামীর গল্প বলে গিয়েছেন। কিন্তু সমকামী নারীর গল্প মূলধারার বাংলা ছবিতে সে রকম উঠে আসতে দেখা বাকি ছিল। মৈনাক ভৌমিকের ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে চাইছে।

ফ্যামিলি অ্যালবাম ছবির একটি দৃশ্য।

ফ্যামিলি অ্যালবাম ছবির একটি দৃশ্য।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০২:৩৭
Share: Save:

আবহটা যেন তৈরিই হয়ে আছে এই মুহূর্তে। আয়ার্ল্যান্ডে সমকামী বিবাহের স্বীকৃতি মিলছে। মুম্বইয়ে সমকামী ছেলের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন মা। রূপান্তরিতা মানবী কলেজের অধ্যক্ষ হচ্ছেন। সেরিব্রাল পলসিতে ভোগা একটি মেয়ে আর তার বান্ধবীর গল্প পর্দায় সাড়া জাগাচ্ছে।

বাংলা ছবিও ‘সাবালিকা’ হচ্ছে।

সাবালিকা-ই বলা উচিত। কারণ ঋতুপর্ণ ঘোষ সমকামী পুরুষের গল্প, রূপান্তরকামীর গল্প বলে গিয়েছেন। কিন্তু সমকামী নারীর গল্প মূলধারার বাংলা ছবিতে সে রকম উঠে আসতে দেখা বাকি ছিল। মৈনাক ভৌমিকের ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে চাইছে। আজ, শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে স্বস্তিকা আর পাওলি অভিনীত এই ছবি। ইউ়টিউবে তার ট্রেলর ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়। হিটের সংখ্যা ১ লক্ষ ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে।

ঘটনা হল, কলকাতায় সমকামী মেয়েদের সংগঠন স্যাফো তৈরি হওয়ার পিছনেও একটা বড় অনুঘটকের কাজ করেছিল একটা ছবিই। দীপা মেটা-র ‘ফায়ার’। নয়ের দশকের শেষ ভাগে শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাশ অভিনীত সেই ছবিকে ঘিরে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। নিন্দামন্দ-ছিছিক্কার তো ছিলই। আবার একই সঙ্গে ছবির ভাল-মন্দের বাইরে গিয়ে সমকামিতার প্রশ্নটিও আলোচনার বৃত্তে চলে এসেছিল। এখানকার সমকামী মেয়েরা তাই অনেকেই ঘরোয়া আড্ডায় বলে থাকেন, ফায়ার ছবিতে সমকামিতাকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে, তাই নিয়ে আপত্তি-তর্ক অনেক কিছুই আছে। কিন্তু ওই ছবিটাই আগলটা ভেঙেছিল।

স্যাফো-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মালবিকাই বলছিলেন, ফায়ারকে ঘিরে শিবসেনার হুমকির প্রতিবাদটাই কিন্তু সমকামীদের জোট বাঁধার সূত্রপাত। সেখান থেকেই সংগঠনের জন্ম ১৯৯৯ সালে। ছয় থেকে শুরু করে আজ তার সদস্য ছ’শো ছাড়িয়েছে। মালবিকার কথায়, ‘‘ফায়ার ছবি হিসেবে যেমনই হোক, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সে সময় আমরা হল-এ যেতাম শুধু ছবি দেখব বলে নয়, আমাদের মতো আর কারা এসেছে, তাদের খুঁজে নেব বলে।’’

ফায়ার থেকে ফ্যামিলি অ্যালবাম— এত দিন লাগল প্রিয় বান্ধবীদের গল্প আবার পর্দায় আসতে? খানিকটা আশ্চর্যের হলেও ঘটনা এটাই । মাঝের বছরগুলোয় বলিউড ‘মাই ব্রাদার নিখিল’ বানিয়েছে। ‘কাল হো না হো’ বা ‘দোস্তানা’-র মধ্যে সমকামিতা নিয়ে মস্করা গুঁজে দিয়েছে। ‘পেজ থ্রি’ বা ‘ফ্যাশন’-এর মতো ছবিতে সমকামী চরিত্র দেখা গিয়েছে। কর্ণ জোহর সমকামী পুরুষকে নিয়ে শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছেন। কিন্তু মেয়েরা কোথায়? ঈশা কোপ্পিকর-নীতু চন্দ্র অভিনীত ‘গার্লফ্রেন্ড’ নামে একটি ছবি এসেছিল। কিন্তু বক্স অফিসে, দর্শক মনে বা সমালোচকদের কাছে— সে ছবি কোথাও কোনও দাগ কাটেনি। বরং সমকামিতা বিষয়টিকে প্রায় উৎকট পাগলামির মতো করে দেখিয়ে বেশ খানিকটা নিন্দাই কুড়িয়েছিল। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ‘3 কন্যা’ ছবিতেও প্রসঙ্গটি ছিল নেহাত বিক্ষিপ্ত।

সেই তুলনায় সমকামী নারীর গল্প বরং একাধিক বার উঠে এসেছে বাংলার ছোট পর্দায়, টেলি-ছবিতে। তার মধ্যে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘উষ্ণ তার জন্য’য় রূপা এবং চূর্ণি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় অনেকেই ভুলতে পারেননি আজও। শুধু কি তাই? স্যাফো নিজেই উদ্যোগী হয়ে ‘মোর দ্যান আ ফ্রেন্ড’ আর ‘এবং বেওয়ারিশ’ নামে দু’টি শর্ট ফিল্ম বানিয়েছিল দেবলীনার পরিচালনায়। প্রথম ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন ঊষসী চক্রবর্তী এবং মল্লিকা। ঊষসী নিজে এই মুহূর্তে ‘কন্ডিশন অ্যাপ্লাই’ নামে একটি ছবির শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত। সেখানেও মুমতাজের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি সমকামী চরিত্রেই। ঊষসী বলছিলেন, ‘‘আমাদের এখানে মানসিকতা আগের চেয়ে অনেক বদলেছে ঠিকই। কিন্তু ট্যাবু-ও কিছু কম নয়।’’ টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির মধ্যেই কিছু দিন আগে এক অভিনেত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। আরও একটা অনুযোগ রয়েছে তাঁর! ‘‘সমকামীদের নিয়ে ছবি হলেই দুঃখী দুঃখী গল্প আর ভাল লাগে না! এমন ছবি দেখতে চাই, যেখানে সম্পর্কের সেলিব্রেশন আছে!’’

কাকতালীয়ই হবে হয়তো! হুবহু ঠিক এই কথাটাই বলছেন মৈনাক ভৌমিকও। তাঁর মতে, ‘‘আমরা যদি বিশ্বাসই করি যে, সমকামী সম্পর্কের গল্প আর পাঁচটা প্রেমের গল্পের মতোই, তা হলে সমকামী চরিত্রদের নিয়ে আর পাঁচটা গল্পের মতো গল্প হবে না কেন? রোম্যান্টিক কমেডি হবে না কেন?’’ ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’, ‘হ্যাপি টুগেদার’ বা ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’-এর বৃত্ত পেরিয়ে মৈনাকের পছন্দ তাই ‘কিডস আর অলরাইট’-এর মতো ছবি! ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ করার সময় তাঁর মাথায় ঘুরছিল ‘ফায়ার’ নয়! বরং ‘কাল হো না হো’ আর ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’! স্বস্তিকা আর পাওলি যেন প্রীতি জিন্টা আর শাহরুখ খান, স্বস্তিকার মা যেন দিলওয়ালে-তে কাজলের মা! মৈনাক অন্তত ব্যাপারটাকে এ ভাবেই দেখতে চান! তাঁর বক্তব্য, ‘‘যত ক্ষণ অবধি গে-লেসবিয়ান-স্ট্রেট— এই রকম ভাবে খোপ কেটে ভাবতে থাকব, তত দিন কিন্তু বিভাজন ঘুচবে না! একটা মেয়ে আর একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছে, এইটুকুই দেখাতে চাই! ‘লেসবিয়ান’ ছবি নয়, যৌনতা নিয়ে বাক্সবন্দি ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করাই আমার উদ্দেশ্য!’’

আর মালবিকাদের প্রত্যাশা, ‘‘সমকামী মেয়েদের নিয়ে ছবি বানানোর নামে যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া বা বিষয়টা নিয়ে মস্করা যেন করা না হয়! ছবির মধ্যে দিয়ে ভুল ধারণার প্রসার যেন না হয়!’’

মৈনাকের দাবি, তিনি বাজারচলতি ভুল ধারণাকে ভাঙতেই চাইছেন। এই প্রশ্নও ছুড়ে দিতে চাইছেন— একটি ছেলের প্রতি একটি ছেলের, একটি মেয়ের প্রতি আর একটি মেয়ের আকর্ষণকে কি সব সময় সমকামী তকমা দিতেই হবে? তকমা মানেই কি একটা বন্দিদশা নয়? মনোবিদদের একটা বড় অংশ কিন্তু বলেন, বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই খানিকটা সুপ্ত উভকামিতা থাকে। মৈনাক উদাহরণ দিচ্ছেন, ‘‘শাহরুখ খানকে দেখলে একটা মেয়ে যেমন পাগল হয়, আমিও তাই। আবার স্বস্তিকা কত বার আমাকে বলেছে, ওর ক্যামেরন দিয়াজকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে!’’

স্বস্তিকা এ ছবিতে ক্যামেরনকে পাননি, তবে পাওলির সঙ্গে তাঁর জমাটি রসায়ন দেখার অপেক্ষায় দর্শক। ‘সাবালিকা’ নয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE