শুনেছি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ষাট দশকের শেষাশেষি ইংরেজি নাটক রিভিউতে তখনকার জনপ্রিয় কলামনিস্ট লিখেছিলেন, নাটকে অন্যদের পারফর্ম্যান্স যত ভালই হোক না কেন এই অমিতাভ বচ্চনকে খুব সাধারণ মনে হয়েছে। আর যাই হোক, এই তরুণের অন্তত অভিনয়কে পেশা করা উচিত নয়। কে জানত, সেই তরুণই একদিন হয়ে যাবে ভারতের সর্বকালের সেরা স্টার!
কার কথা বলছেন?
কার কথা মানে! আপনার কথা।
ওহ্ (হাসি) থ্যাঙ্ক ইউ।
আপনার মনে নেই কলকাতার স্টেজে আপনার অভিনয়ের রিভিউ সেই সময় শহরের অভিজাত কাগজ কী করেছিল?
রিভিউটা একেবারেই প্রশংসাসূচক ছিল না এটুকু মনে আছে। এর বেশি মনে নেই।
ছবি: সাত্যকি ঘোষ।
এ তো সবে শুরু। এর পরেও জীবনের বিভিন্ন সময়ে আপনাকে অবিরত সমালোচনা সহ্য করে যেতে হয়েছে। অথচ সবচেয়ে রোমহর্ষক হল বাকিদের মতো আপনি কখনও সমালোচনার বিরুদ্ধে পাল্টা আওয়াজ তোলেননি। অসামান্য সেই সংযম। প্রশ্ন হল সেই সংযম দেখানো কেন?
কী হবে পাল্টা আক্রমণ করে! কী পাবেন! নিজের মনকে শুধু ড্যামেজ করবেন। আমি খামোখা সেটা কেন করতে যাব? তার চেয়ে আমি বরং সেটা কাজে লাগাব অন্য কোনও ভাল কাজে। আমি প্রতিহিংসার মোড-য়ে যাওয়াতে বিশ্বাসী নই। উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়।
১৯৮২-তে একটা লেখা আপনার অসুস্থতার সময় বেরিয়েছিল। আপনি পড়েছেন কি না জানি না। এবিপি গোষ্ঠীর ‘সানডে’ পত্রিকায়।
কী লেখা?
তাতে ছিল, বহু বছর আগে যখন আপনি স্ট্রাগলার, সুনীল দত্তের বাড়িতে একটা পার্টিতে জনৈক কপূর আপনাকে যথেচ্ছ অপমান করেছিল! বলেছিল, মিস্টার দত্ত, এলিতেলির সামনে আমরা ড্রিঙ্ক করতে বাধ্য নই। আপনাকে নাকি চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। ‘সানডে’র রিপোর্টার লিখেছিলেন, বহু বছর বাদে মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন ওই কপূর নামের লোকটিকে একটি পার্টিতে আবিষ্কার করেন। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ দ্য এন্ড অব দ্য পার্টি ফর মিস্টার কপূর। লোকটির পার্টির লীলা তখনই সাঙ্গ হয়ে যায়। সত্যি!
মনে করতে পারছি না (গম্ভীর দৃষ্টি)।
আপনি বলেন প্রতিহিংসার মোড-য়ে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আপনার সব চেয়ে প্রতিহিংসামূলক ছবি ‘দিওয়ার’য়ে যখন পিটারের ডেরায় চাবিটা তুলে দিয়ে বলেছিলেন ‘ইসে আপনি জেব মে রাখ লে পিটার। অব ইয়ে তালা ম্যঁয় তেরি জেব সে চাবি নিকল কর হি খোলুঙ্গা।’ তখন কি এত এত বছরের ধূমায়িত আক্রোশ আর এত দিনকার অপমান কাজ করেনি?
মনে হয় না, সচেতন ভাবে শটটা দেওয়ার সময় কেউ অপমান করেছিল বা বঞ্চনা করেছে সেই সব স্মৃতি ভিড় করে এসেছিল বলে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ন্যাচারাল অ্যাক্টিংয়ে বিশ্বাসী।
কিন্তু অনেক অভিনেতা তো মেমরি ব্যাঙ্কের কথা বলেন। বলেন জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ব্রেনে স্টোর করে রাখতে হয়। উপযুক্ত শটে সেই আবেগটা গিয়ে কাজে লাগে।
আমি সত্যি জানি না, হোয়াট হ্যাপেনস্ টু দ্য মাইন্ড অ্যাট দ্যাট পার্টিকুলার টাইম। ঠিক ওই শট দেওয়ার মুহূর্তটায় গিয়ে ট্রিগার টেপাটা কী ভাবে ঘটে! এই জায়গাটায় একটু ধোঁয়াশা আছে। সত্যি কি আমাদের অবচেতনে ‘স্টোর’ করা দৃশ্যগুলো পটাপট বার হতে শুরু করে? নাকি পুরোটাই ন্যাচারাল? ঠিক ওই মুহূর্তে রাইট এক্সপ্রেশনটা একটা মানুষ কী ভাবে দেয়? গোটাটাই স্বতঃস্ফূর্ত? নাকি সহজাত দক্ষতা? আমি জানি, অভিনয় শিক্ষার একটা ঘরানা বলে, মেমরিতে স্টোর করো। মেথড অ্যাক্টিংয়ের এটা একটা ধাপ। কিন্তু আমি তো কোনও দিন অভিনয় শিখিনি। গোটাটাই স্বতঃস্ফূর্ত। কাজেই আজও এর উত্তর বার করতে পারিনি।
ছবি: সাত্যকি ঘোষ।
অথচ সেই সময়কার কিছু ছবিতে আন্ডারডগ চরিত্রগুলোয় আপনার অভিনয় এমন জীবন্ত যে মনেই হয় না আপনি ব্যক্তিগত অপমান বা হতাশা ব্যবহার করেননি। যেমন ‘দিওয়ার’।
আমার মনে হয় কৃতিত্বটা পুরোটাই প্রাপ্য সেলিম-জাভেদের। অসাধারণ স্ক্রিপ্ট লিখেছিল ওরা ‘দিওয়ার’য়ের। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শক্তিশালী স্ক্রিন-প্লে।
কিন্তু এই যে রাগী, জীবনযন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত সব চরিত্রগুলো ওঁরা লিখতেন। তার সঙ্গে নিজেকে কোথাও আইডেন্টিফাই করতেন না? মনে হত না, এ সব তো কত আমার জীবনেও ঘটতে দেখেছি?
না, না, কোনও দিন সেটা নিয়ে ভাবিনি। আমি অভিনেতা। খুঁটিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়েছি। তার পর নিজের সাধ্য অনুযায়ী সেটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে গিয়েছি।
‘দিওয়ার’য়ের সেই বিখ্যাত নীল গিট্টি বাঁধা ড্রেসটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়েছে?
না তো।
সে কি?
ওটা নিশ্চয়ই যশরাজে রয়েছে।
জানেন জিত্ ওই পোশাকে রিসেন্টলি একটা ফিল্ম করেছেন—‘বচ্চন’?
হ্যাঁ জানি (একটু লজ্জিত ভাবে)। ইউ টিউবে দেখলাম। আসলে আমার ফ্যানরা লিঙ্কটা পাঠিয়েছিল। জিত্ আমার কাছে এসেওছিল। এই ছেলেপুলেরা যে কী সব করে না। বড় বেশি আমার পক্ষে প্রশংসাসূচক।
‘বিজয়’ উনিশটা ছবিতে আপনার নাম। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে উথালপাথাল করে দেওয়া একেকটা হিট। পর্দায় বিজয় নামটা প্রতিবার বলতে গিয়ে কি নিজের এক কালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিজয় কৃষ্ণ-র কথা মনে পড়ত?
না না তা কেন? ‘বিজয়’ নামে অনেকেই তো আমার বন্ধু। বিজয় সিংহ, যাকে আমি কলকাতা থেকে চিনতাম।
বিজয় অমৃতরাজ।
হ্যাঁ, অনেক বিজয় আছে।
তবু আপনার জলদগম্ভীর গলায় ‘বিজয়’ শব্দটা বাড়তি মাত্রা পেয়ে এসেছে। এটার কি আরও কারণ নামের প্রথমেই ‘ভি’ শব্দটা থাকা। আপনার ব্যারিটোনে নাভি থেকে নিয়ে উচ্চারণ করেছেন ‘ভি-জ-য়’।
না না তেমন কিছু নয়। (হাসি) নামটা তো অভিনেতা হিসেবে আপনাকে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু নয়।
বহু বছর আগে পড়া ঘটনা। ‘কসমে ওয়াদে’র সাকসেস পার্টি আয়োজন হয়েছে খুব ধুমধাম করে। আপনি অন্য ছবির শ্যুটিংয়ে। রণধীর কপূর ডাকতে এলেন আপনাকে। আপনি বললেন, ‘রণধীর, বেরোনো যাবে না। যেটার শ্যুটিং করছি সেটাও তো নতুন ছবি!’
হ্যাঁ, সত্যি। এ ধরনের ঘটনা তো হয়েইছে। আপনি যদি একটা কাজ নিয়ে ফেলেন তখন তো সবার আগে তাকে সম্মান জানাতেই হবে।
এতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে টিবি-র উপর আপনার অ্যাড ফিল্মের শ্যুটিং দেখছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম এই বাহাত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে পরিচালক ‘কারেক্ট’ বলার পরেও কী ভাবে পরের পর রিহার্সাল করেই যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আপনার জীবনের বুঝি প্রথম টেক চলছে। এত বছর পরেও একটা বিজ্ঞাপনী ছোট শটের জন্য নিজেকে উদীপ্ত করতে সমস্যা হয় না?
প্রোফেশনাল হিসেবে আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যে, আপনাকে ঠিক শটটাই দিতে হবে। কোনও পরিস্থিতি সমান নয়। নিত্যদিন এক একটা ভিন্নধর্মী ভূমিকা। এক একরকম রোল। এক একরকম পরিবেশ। আইডিয়া হল পেশাদার হিসেবে দিনের পর দিন নিজের সেরাটা উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো। এখানে কোনও আপসের ব্যাপারই নেই।
কিন্তু আপনার মতো বডি অব ওয়ার্ক নিয়ে নিজেকে ঠেলতে একটু সমস্যা তো হতেই পারে?
না, বডি অব ওয়ার্কের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। আমি ও সব নিয়ে ভাবি না। আমার চেতনাতেও আসে না। আমার ভাই সাফ কথা, আপনি যদি কোনও দায়িত্ব নিয়ে থাকেন, তা হলে তার প্রতি আপনাকে সুবিচার করতে হবে। এটা যে আপনাকে কাজ দিয়েছে তার আপনার কাছে হক পাওনা। অন্যরা কী মনে করে জানি না। তবে আমার প্যাটার্ন হল, শট হওয়ার আগে ন্যারেশন শোনা, ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলা। যা যা প্রশ্ন করার রয়েছে সেটা করে ফেলে তার পর কাজটায় ডুবে যাওয়া।
টি ২০ দুনিয়ায় একটা এক্সপ্রেশন খুব চলছে গেম চেঞ্জার। যে লোক এসে খেলাটা বদলে দেয়। ব্যাপকার্থে যে পেশাদার এসে তার পেশার মোড়টাই অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। আপনি যেমন বলিউডে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন! আপনি আসার আগে হিরো মানেই শর্ত ছিল তার গায়ের রং হবে ফর্সা, টকটকে। সে কিছুতেই টাইম মেনে সেটে আসবে না। আর হুইস্কি ঢালবে পাটিয়ালা পেগে।
আমি এ সব এক্সপ্রেশনের অতিনাটকীয়তায় বিশ্বাস করি না। এগুলো মিডিয়ার দেওয়া নাম। আমি বুঝি আমার কাজটাকে নিয়ে আমায় তরতর করে দাঁড় বাইবার চেষ্টা করতে হবে। আমি এ ভাবে কখনও সচেতন ভাবে ভাবিনি যে এই জায়গাটা আমি চেঞ্জ করব। এত দিনকার সব কিছু বদলাব। আমাদের প্রত্যেকেই নানা রকম পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে। নানা রকম অভ্যেস নিয়ে। নানা রকম সাংসারিক জীবনের মধ্যে থেকে। অন্যরা কে কী ভাবে ছোটবেলা কাটিয়েছে জানি না। তবে দিস ইজ দ্য ওয়ে আই অ্যাম। আমি এরকমই। এর বাইরে অন্য রকম কিছু ‘বিহেভ’ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আপনি যতই বিনয় করুন, আপনার ওয়ার্ক এথিকটা বিশাল বদল এনেছে তো বটেই। অজয় দেবগণ থেকে মিঠুন চক্রবর্তী। বিভিন্ন প্রজন্মের নায়কেরা বলেছেন আপনি মর্যাদাবোধ আর শৃঙ্খলার এমন একটা মাত্রা যোগ করেছেন যে পরের প্রজন্মের তাতে প্রভাবিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না।
তাই?
হ্যাঁ, মিঠুন একাধিক বার বলেছেন আপনার পেশায় ‘ডিগনিটি’ যোগ করার ব্যাপারটা। অজয় দেবগণ বলেছেন ক্লান্ত শরীরে একদিন শ্যুটিং ফাঁকি মারবেন ঠিক করে ফেলেছেন। হঠাত্ মনে হল অমিতজি তো এই অবস্থাতেও কাজে যেতেন। তা হলে আমি কী করে শুয়ে থাকব? এর পর কাজে গেলেনও।
মিঠুন আর অজয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ। সম্মানিত লাগছে ওদের প্রশংসা শুনে। আমার মনে হয়, শৃঙ্খলার যে কথাটা উঠছে সেটা বরাবরই আমার ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা। এটা আমার অভ্যেসের মধ্যে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি কাউকে যদি সময় দিয়ে থাকো তা হলে সেই কমিটমেন্টটা রাখা উচিত। যদি কোনও কারণে লেট হয়, তা হলে অবশ্যই জানাবে যে অনিবার্য কারণে দেরি হচ্ছে। আমি বরাবর এভাবেই শৃঙ্খলার অনুশাসন মেনে জীবন কাটিয়েছি। মনে হয় এটা আমার নৈনিতালের বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষা।
যেমন?
যেমন বড়দের মান্য করা। শিক্ষককে সম্মান। সময়জ্ঞান ঠিক রাখা। জীবনের বেসিক ভ্যালুগুলোকে ঠিক রাখা।
একেবারে গোড়ার মূল্যবোধগুলো!
নিশ্চয়ই। আমার তো মনে হয় আমাদের দেশে প্রধান যে সমস্যাগুলো তার পিছনে এটাই আসল কারণ শৃঙ্খলার অভাব। আমি তো যে কোনও দেশের এয়ারপোর্টে নামা মাত্র তাদের বোঝার চেষ্টা করি। সিঙ্গাপুরে যেমন। ওখানে পা দেওয়া থেকে আপনি বুঝতে শুরু করবেন যে এই দেশটা অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ। কোথাও একটা ময়লা নেই। মিনিটে সব সাফসুতরো হয়ে যাচ্ছে। লন্ডনে যান। রাত দু’টোর সময়ও একটা সাইক্লিস্ট লাল আলোর সামনে অবনত অপেক্ষায়। কী অসাধারণ! আর আমরা সেখানে সারাক্ষণ ট্রাফিক অমান্য করছি। মুম্বইয়ের বিএসটি বাসগুলো কী ভাবে চলে দেখেছেন! অহরহ আমাদের দেশে গভর্মেন্ট ভেহিকেলগুলোও আইন ভাঙছে! কেউ দেখেও না। কেউ কেয়ারও করে না।
কখনও মনে হয়েছে আমাদের দেশের এই শৃঙ্খলার অভাব কাটাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?
সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। অন্তত তিন মাস করে প্রত্যেক নাগরিককে আর্মিতে পাঠানো উচিত। আর্মি ট্রেনিং এমন একটা ব্যাপার যা শরীর আর মনকে একটা কমন রেখায় এনে দাঁড় করাতে পারে। এমন যদি একটা নিয়ম নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করা যায় তা হলে এই বয়সেও আমি তিন মাসের কোর্স করতে রাজি।
শুনেছি স্কুলজীবনে আপনি অ্যাথলেটিক্সে খুব ভাল ছিলেন। আর প্রাইজটাইজও পেতেন। অথচ স্কুলজীবনে আপনার চূড়ান্ত হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অভিনয়ের জন্য দেওয়া কেন্ডল কাপ টানা দ্বিতীয়বার জিততে না পারা। আর বক্সিং ফাইনালে উঠে হেরে যাওয়া। টিন এজ-য়ের ওই দু’টো গভীর ব্যর্থতা কি পরের জীবনে ফুঁসে ওঠার টার্নিং পয়েন্ট ছিল?
আমার মনে হয় না ওই ব্যর্থতার কাহিনিগুলো আমাকে বাউন্স ব্যাক করিয়েছিল বলে। জীবনের পুরো কাহিনি হল কখনও আপনি নীচে পড়ে যাবেন। কখনও উপরে উঠবেন। এলাহাবাদে একেবারে প্রথম জীবনে আমি অ্যাথলেটিক্সে দুর্দান্ত ছিলাম। প্রাইজ পেতাম। কিন্তু নৈনিতালে এসে আবিষ্কার করলাম ও রকম ভাল অ্যাথলিট আমার স্কুলে পঞ্চাশ জন আছে। জীবনটা এ রকমই। হঠাত্ করে কেউ আসবে আর পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেবে। কাজেই আপনি জিতুন-হারুন যাই হোক না কেন ভাল করার চেষ্টা সব সময় চালিয়ে যেতে হবে। বক্সিং রিংয়ের আরও একটা শিক্ষা ছিল। পালিয়ে না যাওয়ার। স্কুলে আমার হাইটের জন্য দুর্ভাগ্যবশত সব সময় এমন গ্রুপে পড়ে যেতাম, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার থেকে অনেক শক্তিশালী। আমি যে বার বক্সিং ফাইনালে উঠি, উল্টো দিকে যে পড়েছিল সে এতটাই বড়সড় আর স্ট্রং ছিল যে প্রিন্সিপাল আর স্কুলের কয়েকজন স্টাফ আগের রাতে আমার বাড়ি এলেন। এসে বললেন, তুমি ওয়াক ওভার দিয়ে দাও। তা হলেও তুমি রানার্স আপ কাপ পেয়ে যাবে। লড়াই করাটা তোমার পক্ষে ভীষণ বিপজ্জনক। অথচ আমাদের যিনি পিটি ইন্সট্রাক্টর ছিলেন তিনি এর পর আমায় বলেছিলেন, তুমি যদি ওয়াকওভার দিয়ে দাও তোমাকে আমি কোনও দিন স্পোর্টসম্যান হিসেবে মানব না। রিয়েল স্পোর্টসম্যানরা কখনও মাঠ ছেড়ে পালায় না।
কাজেই পরের দিন আপনি লড়লেন। আর মুখচোখ ফেটে রক্তারক্তি হল। আপনার জীবন খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয়, বলিউডকে বক্সিং রিংয়ের মতোই ব্যবহার করেছেন। রক্তপাতের ভয় কখনও পাননি।
সচেতন ভাবে কিছু করিনি। যখন যা চ্যালেঞ্জ সামনে পড়েছে জাপটে ধরে তার মোকাবিলা করেছি। কখনও পড়ে গিয়েছি। কখনও মনে হয়েছে পুরো শরীরটা দরজার বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। বড়জোর গোড়ালিটা ঢুকতে পারে। তখন শুধু গোড়ালিটা ঢুকিয়ে ওয়েট করেছি পরিস্থিতি ভাল হওয়ার জন্য। আমার মতে সব ঝোড়ো পরিস্থিতিতেই বিশাল উচ্চাশা না রেখে নিজের লক্ষ্যকে ছোট ছোট ভাগে কেটে নেওয়া উচিত।
আমার জীবনে এ সব হতাশার মুহূর্ত অনেক বার হাজির হয়েছে। এমন সব ঝঞ্ঝা যেখানে আমি পুরো বেসামাল হয়ে বসে কুল পাইনি যে কী করব? কোন পথে যাব? আমি যখন এবিসিএল নিয়ে অন্তহীন মামলা-মকদ্দমায়, একশোটার উপর কেসে জড়িয়ে। ইনভেস্টরদের টাকা ডিউ। ব্যাঙ্ক হুমকি দিচ্ছে বাড়ি ক্রোক করে নেবে।
এ অবস্থায় একটা রাত্তিরে আমি বসে বসে ভাবলাম আমি কী করে এখান থেকে বেরোব? তার পর মনে হল আমি অভিনেতা। আমার আদত কাজ অভিনয় করা। আমার উচিত অ্যাক্টিংয়ের সুযোগ খোঁজা। তাই করলাম। আমার বাড়ির পিছনেই যশ চোপড়ার অফিস। আমি গেলাম সেখানে পায়ে হেঁটে। গিয়ে বললাম, বেকার। কাজ করতে চাই।
ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিনে পড়েছি যে আপনি পায়ে হেঁটে নিজে যশ চোপড়ার কাছে কাজ চাইতে গিয়েছিলেন। কখনও বিশ্বাস করিনি। তার মানে ঘটনাটা সত্যি?
কাজ চাইতে যাওয়াটা তো খারাপ কিছু নয়। সে তো সব সময়ই আমরা বলে থাকি অমুকের সঙ্গে কাজ করতে পারলে ভাল লাগবে। আর সত্যি তখন আমার কোনও কাজ ছিল না।
এবিসিএল আপনার জীবনে অবশ্যই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু পিছন ফিরলে কি মনে হয় না কোনও দিন ইতিহাস বলবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কর্পোরেট অন্তরঙ্গ আর বহিরঙ্গের রূপান্তরের জন্য এটার প্রয়োজন ছিল? আর এই লোকটাই সেটা প্রথম ভেবেছিল!
তারও আগে আমাদের মেনে নেওয়া উচিত হবে যে এবিসিএল-এ আমরা কাজ করার যোগ্য ঠিকঠাক লোকই জোগাড় করতে পারিনি। আমাদের সেই সামর্থ্যই ছিল না। জানতাম না কী করে ম্যানেজ করতে হবে। পরে ঠেকে শিখেছি। সে সময় দুশো লোক ছিল আমার কোম্পানিতে। আজকের দিনে কমতে কমতে কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র এক। যে কি না আমার সিএ।
গড়পড়তা মানুষের জীবনে এ রকম একটা বিপর্যয় বাকি জীবনের আহ্নিকগতি থামিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। অথচ আপনি সেগুলো থেকে দিব্যি উঠে পড়েন। আপনার জীবনে একটা কেবিসি চলে আসে। এই রক্ষা পাওয়ার উপায়টা কী?
আমি একটা সহজ কথা বুঝি যে ব্যর্থতা জীবনের একটা অবশ্যম্ভাবী উপাদান। প্রায় প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছুতে ব্যর্থ হই। যেটা করতে চেয়েছি সেটা হয়তো হয়নি। যার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি সেটা হয়তো পারিনি। এই রকম কত কত। জীবনে টানা চলতে চাইলে রোজকার কাটাছেঁড়া অনিবার্য। বড় বড় চোট আসবে। জখম হতে হবে। কিন্তু তার মধ্যেও রাস্তা করে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে।
সেই একটা লাইন আছে না, এগুলো যে ঘটেছিল সেগুলো খুব মঙ্গলজনক কারণ ওটা আপনাকে ভেতর থেকে চাবুক করে দিয়েছে।
শুনেছি আপনার বাবা হরিবংশ রাইয়ের লেখালিখি আপনাকে বরাবর খুব উদ্বুদ্ধ করে এসেছে।
বাবার লেখাগুলো ভীষণ বিপ্লবী।
খুব পাওয়ারফুল। মানুষটার মন কত গভীর ছিল তা ওই লেখাগুলো থেকেই আন্দাজ করা যায়। প্রতিদিন ওঁর লেখার সঙ্গেই বাঁচি। উনি যখন প্রথম লিখতে শুরু করেন ওঁকেও কত বিরূপ সমালোচনা শুনতে হয়েছে।
এটা নিয়ম যে জীবনে ‘ফ্রেশ’ কিছু করলেই সমালোচনার ঢেউ আসবে। যে-ই আপনি চলার পথের বাইরে যাবেন উগ্রপন্থীরা আপনাকে ড্যামেজ করার চেষ্টা করবে। রবীন্দ্রনাথ তো তাই বলে গিয়েছেন, একলা চলো রে। ‘আইকনিক’ গান। যে কোনও ভাষার, যে কোনও সঙ্গীতে আপনি গানটা গাইতে পারেন। টিউনটা এতই ভাল।
‘কহানি’তে আপনার গাওয়া ‘একলা চলো রে’ এমনই সুপারহিট যে আজও অনেকের কলারটিউনে রয়েছে। আপনারও নিশ্চয়ই আছে?
আরে না না (খুব লজ্জিত)।
আপনার কলারটিউন তা হলে কী?
নর্ম্যাল নর্ম্যাল। যেটা বলছিলাম গানটা অসামান্য। আমার বাংলা বেশ খারাপ বলে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছিলাম। সুজয়কে ভাগিয়ে দেওয়ার প্রচুর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও এত নাছোড়বান্দা ছিল যে পারিনি।
একলা চলো রে-র ফ্লো-টা অবিশ্বাস্য। যখন গাইছেন, তখন মনে হবে সত্যিই আপনি দৃঢ় ভাবে একলা হাঁটছেন। সাউন্ডটাই এত ভাল যে শব্দের মানেটাকে অসাধারণ ফুটিয়ে তুলেছে। এমনিতে শব্দের মানেকে সাউন্ডের সঙ্গে ম্যাচ করানো এত কঠিন। কিন্তু এখানে কী অসামান্য দু’টোর সমাহার। শেক্সপিয়রেরও এ রকম বহু লাইন আছে, যেখানে শব্দই ফিজিক্যাল অ্যাকশনকে ফুটিয়ে তোলে।
আর?
কেন মানিকদা! ‘চারুলতা’তে ওঁর অবিশ্বাস্য মিউজিক দেওয়া। বিশেষ করে ওই যে দৃশ্যটা, যেখানে মাধবীজি (মুখোপাধ্যায়) জানালার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর একটা সিঙ্গল বাজনা শুধু সেতার বাজছে। তা-রা-রা-আ-রা-রা-রা। কী অসাধারণ সে মুহূর্তটা! অথচ এত সহজ। এমনকী আমিও সেতার বা পিয়ানোতে ওটা বাজাতে পারি।
অথচ ওই সিম্পল একটা সেতারের টান বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কত নিঃসঙ্গ। তার মনের মধ্যে কত হতাশা! সে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। আর তার নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে কলকাতার জীবন। এক্সট্রাঅর্ডিনারি! এটাই জিনিয়াসের বিউটি।
এ রকম আরও কিছু টিউন আছে কি যা মনে গেথে গিয়েছে উদ্বুদ্ধ করার জন্য?
আছে তো। আমার বাবার কিছু লেখা আছে। যার মূল সুরটা একলা চলো রে-র মতোই। যার সারমর্ম, একটা রাস্তাই নিজের জন্য বেছে নিয়ে চলতে থাকো। কিপ গোয়িং। কিপ গোয়িং। যদি মাঝপথে বিভ্রান্তি হয় কোন দিকে যাব? লেফ্ট না রাইট? তা হলে কবি বলে দিয়েছেন আপনাকে কী করতে হবে। বলে দিয়েছেন ডাইনে বাঁয়ে কোনও দিকে যাওয়ার দরকার নেই। যে রাস্তাটা ধরেছ সেটাতেই হাঁটতে থাকো। ঠিক গন্তব্যে পৌঁছবে। ‘মধুশালা’য় বাবার একটা লাইন আছে। ‘রাহু পকড় তু এক চলাচল/ পা যায়েগা মধুশালা’। কলকাতা থেকে প্রথম যখন মুম্বই আসি, আর এদিক ওদিক স্ক্রিন টেস্ট দিয়ে বেড়াচ্ছি, তখনই উনি ডেকে নিয়ে বলেন বাড়িতে তোমার ঢুকতে না পেরে দমবন্ধ লাগছে তো। এমন লাফ দিও যাতে পাঁচিল টপকে যেতে পারো।
মুম্বইতে স্ট্রাগলিং পিরিয়ডে আপনি নাকি মেরিন ড্রাইভের ধারে বেঞ্চে রাত কাটিয়েছেন। আপনার এক বন্ধু ছিলেন আনোয়ার। শোনা যায় আপনারা মাঝরাত্তির অবধি শহরের নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে কোনও ক্রমে মাঝরাতটা কাবার করে দিতেন। তার পর খাবার কিনতে যেতেন। কারণ তখন কম দামে খাবার পাওয়া যেত।
ঠিক কথা। এই তো কমলিস্তান স্টুডিয়োর কাছেই একটা খুব ভাল খাবারের দোকান ছিল। সিটি বেকারি। সেখানে রাত বারোটা বাজলে খাবারের দাম অর্ধেক হয়ে যেত। তখন আমরা খেতে যেতাম। নইলে সাধ্য ছিল না।
সেই হাড়হিম করা অভিজ্ঞতাগুলো কোথায় কি আজকের খ্যাতির বৃত্তের মধ্যেও আপনার সঙ্গে থেকে গিয়েছে?
এটা খুব জরুরি জানা যে, আপনি কোথা থেকে উঠে এসেছেন। আর যে কোনও দিন সেখানে ফেরত যেতে পারেন। কাল আমার যা আছে সব যদি হারিয়ে ফেলি আবার আমি ওখানেই ফেরত যেতে পারব। আবার বেঞ্চে শুতে পারব। আমি তো নিজেকে বলি গুদরি-কা লাল। গুদরি হল রুক্ষ কাপড়। যেটাতে জড়িয়ে টাঙায় করে আমায় বাড়িতে আনা হয়েছিল।
অভিষেককে আমি বলেছিলাম যে আমি এসেছি ওই রুক্ষ, সস্তার কাপড়ে জড়িয়ে। আর তোমাকে বাড়ি এনেছি মার্সেডিজ করে। কিন্তু যে কোনও দিন আমি গুদরি-কা লালে ফিরে যেতে পারি। সেখান থেকে লড়াই করার জন্য তৈরিও থাকব। বোফর্স বিতর্কের সময় রোজ কাগজে আমার বিরুদ্ধে খবর বেরোত। নেতারা অভিযোগ করছিলেন আমি নাকি দেশদ্রোহী। বাবা অবধি একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মুন্না চারদিকে যা সব পড়ছি, আশা করব তুমি কোনও অন্যায় করোনি।
আমি তখন ওঁকে বলেছিলাম, আমি কোনও ভাবে জড়িত নই। আর তার জন্য আইনি ব্যবস্থাও নিচ্ছি। ওরা যদি আমাদের শেষ করে দেওয়ারও চেষ্টা করে, যদি রাস্তায় নামিয়েও দেয়, বাবুজি আমি ছাড়ব না। ওই রাস্তা থেকে আবার লড়াই শুরু করব। আবার ফিরে আসব!
একটা কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করি?
হুঁ...
ভি পি সিংহকে আপনি ক্ষমা করে দিয়েছেন?
শুক্রবার সেকেন্ড হাফ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy