Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ছ’টা=সাড়ে ছ’টা=সাতটা

কাকের ক্যাকোফোনি কানে তোলেনি বাঙালি। নইলে শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে তো কবেই সেই ভারী প্রশ্নটা করে ফেলেছিল— ‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?’ কিন্তু ‘কাকস্য’ পরিবেদনা! বঙ্গালি বং হল, ট্যাঁকঘড়ি থেকে মোবাইলে শিফ্ট করল, তবু তার জীবনদর্শন রয়ে গেল একই— লেট্স বি লেট! দেরি করতে সে কক্ষনও দেরি করেনি। প্রেমিকা থেকে পাওনাদার, যে কোনও কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সে আর জায়গা পায়নি— রেলাভরে রেলস্টেশনের বড়ঘড়ির তলাকেই বেছে নিয়েছে। ঘাড় তুলে গোন পাগলা, কত ক্ষণ লেটে আসছি আমি!

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সুস্নাত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৮
Share: Save:

কাকের ক্যাকোফোনি কানে তোলেনি বাঙালি। নইলে শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে তো কবেই সেই ভারী প্রশ্নটা করে ফেলেছিল— ‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?’ কিন্তু ‘কাকস্য’ পরিবেদনা! বঙ্গালি বং হল, ট্যাঁকঘড়ি থেকে মোবাইলে শিফ্ট করল, তবু তার জীবনদর্শন রয়ে গেল একই— লেট্স বি লেট! দেরি করতে সে কক্ষনও দেরি করেনি। প্রেমিকা থেকে পাওনাদার, যে কোনও কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সে আর জায়গা পায়নি— রেলাভরে রেলস্টেশনের বড়ঘড়ির তলাকেই বেছে নিয়েছে। ঘাড় তুলে গোন পাগলা, কত ক্ষণ লেটে আসছি আমি! তাবৎ বাঙালির আইকনিক ওয়েটিং রুমটির মাথায় ছাদ দিয়েছে হাওড়ার বড়ঘড়ি।

ঘড়ি চিরকালই বাঙালির কবজিতে শ্রেষ্ঠ অর্নামেন্ট। দেওয়ালে সেরা শো-পিস। বাঙালির কাছে সে টোটাল হেরে গিয়েছে। নইলে কি প্রতুলচন্দ্র সরকারের সেই জাদুটির কথা বার বার বাঙালি সগর্বে স্মরণ করে! মঞ্চে পৌঁছতে সে দিন বেশ বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল পি সি সরকার সিনিয়রের। অতঃপর স্রেফ সম্মোহনের কৌশলে সময়কেও বশ করলেন তিনি। ঘড়ির কাঁটা যেন উলটো দিকে ছুটল। খানিক আগেও যারা পাংচুয়ালিটি নিয়ে সোচ্চার লেকচার ঝাড়ছিল, তাদেরও হতভম্ব হয়ে গুনগুন সলিলকি— না হে, সময় তো দেখছি এখন ঠিকই আছে! এই ম্যাজিক বাঙালি হেবি খেয়েছিল, আজও আপিসে-ইস্কুলে শুরুর ঘণ্টা বেজে গেলে নানা বাহানায় বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর সে ভরপুর তোলে। লেট মার্ক খেয়েও বেহেলদোল স্মার্টনেসে ভাবখানা তার এমন— সে যখন মাঠে নামে, তখনই কিক-অফ! আসলে সময়কে মান্য করা নয়, মহৎ-পাতি নির্বিশেষে বাঙালি চির কাল সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। বেলা পড়ে এলেও বোকাসোকা গোপীনাথ ওস্তাদকে ভৈরবী রাগিণী গাওয়ানোর জন্য বাঙালি তার ‘স্বকাল’ নির্মাণ করে নিয়েছে। গাঁয়ের মাতব্বরদের সেই আড্ডা আসলে গড় বাঙালির মনের কথাই বলে— ‘আমার এই যষ্টির ছায়া... যত ক্ষণ না পর্যন্ত ওই প্রস্তরখণ্ড স্পর্শ করছে, তত ক্ষণ সকাল।’ আবার বেয়াড়া সুরের তাড়নায় সমবেত মশকরা পরক্ষণেই ঘোষণা করে দেয়— ‘সকাল ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল...’! ঠিক যেমন আজকের কবিয়াল গেয়ে ওঠেন— ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনও কাজ নেই... ধরা যাক আজ রোববার কোনও তাড়া নেই...’। ক্যালেন্ডারকে তুড়ি মেরে, আপনার উইক-এন্ড বাঙালি আপনি রচনা করে। বাঙালি জাতির কাছে যদি ধরা হয় সরা, তবে রাত হবে দিন, এ আর কী কঠিন! এই ঘড়ি ধরে মারো টান ল্যাদ কি বাঙালির বাপের সম্পত্তি নয়?

বাঙালি জানে, ‘পাংচুয়ালিটি’র বাংলা ‘সময়জ্ঞান’। ‘পাংচুয়ালিটি’ মানে যে আসলে ‘দায়িত্বজ্ঞান’, তা বাঙালিকে কে শেখাবে? ঔপনিবেশিক খোঁয়াড়ি তার শিরায়-স্নায়ুতে আজও নানা রূপে বহমান, কিন্তু এই জিনিসটি সে লালমুখোদের থেকে দুশো বছরেও শিখতে পারেনি। এক ‘ইউরোপীয় বাঙালি’র কাছে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত এক বাঙালি সাংবাদিক। পটভূমি বিলেত। হোটেল থেকে বেরিয়ে সেই বাঙালির বাড়িতে পৌঁছতে পাঁচ মিনিট মোটে লেট হয়েছিল সাংবাদিকের। নক করার পর, সে দিনের মতো নক আউট হয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল— দরজার ও-পারে যাওয়ার আর অধিকার মেলেনি। আবার পর দিন। এ বার আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছে উনত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে তবে কলিং বেলে হাত ছোঁয়ান ওই সাংবাদিক। প্রবেশাধিকার মেলে। সাক্ষাৎকার দিতে সে দিন নাকি আর কোনও বেগড়বাঁই করেননি নীরদ সি চৌধুরী!

জাপানে গিয়েও নাকি ভারী বিড়ম্বনায় পড়েছিল এক বাঙালি। অচেনা দেশে ঠিক জায়গায় নামতে যাতে সমস্যা না হয়, তাই ট্রেনে ওঠার আগেই সে জানতে চাইল, অমুক স্টেশনে তাকে নামতে হবে, তো তার আগের স্টেশনের নামটি কী? অবাক কণ্ঠে ছুটে এল স্পষ্ট জবাব, পাঁচটা তেইশে যেখানে ট্রেন দাঁড়াবে, সেখানে নামতে হবে। সে যতই জিজ্ঞেস করে, আগের স্টেশনের নাম কী, ততই উত্তর আসে, পাঁচটা তেইশ। পাঁচটা তেইশ অবধি অপেক্ষা করে বাঙালি বাবুটি ঠাওর করেছিল, পাংচুয়ালিটি কারে কয়! রোজকার মতোই ঠিক তখনই ওই স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল ট্রেন। অতঃপর বাঙালি নামে। জাপানিরা ওঠে।

অথচ বাঙালির শহুরে রূপকথা মেট্রো রেলও আজ পাঁচ-দশ মিনিট অন্তরই ডিজিটাল বোর্ডে তার নীল আর হলুদ সময়ের তুলনা দিয়ে জাহির করে, এই দু-এক দশকেই সে কত্তখানি বাঙালি হয়ে গিয়েছে! শিয়ালদা-ডানকুনি লাইনে ডেলি প্যাসেঞ্জারির সূত্রেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি এক বিচিত্র টাইমটেব্ল পকেটে রাখতেন। নিজেরই বানানো। তাতে প্রতিটি ট্রেনের নম্বরের পাশে লেখা থাকত, আসলে ওই ট্রেনটি গড়পড়তা য’টা নাগাদ আসে, সেই সময়টি! বলা ভাল, টাইমটেব্লের প্যারডি। এখন প্রশ্ন হল, কোনটি প্যারডি, আর কোনটি অরিজিনাল!

ট্রেনের স্টেশনে ঢুকতে, দিদিমণির ক্লাসে ঢুকতে, গবেষকের সেমিনারে ঢুকতে, কেরানির আপিসে ঢুকতে... সব রকমের ঢোকাঢুকির ক্ষেত্রেই এই যে বাড়তি সময়টুকু, বাঙালির কাছে টেক্ন ফর গ্র্যান্টেড। বছর পনেরো আগের কথা। সন্ধে ছ’টা থেকে কলকাতার এক মঞ্চে সে দিন একটি বাংলা ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। কী করে কে জানে, একেবারে যথাসময়েই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সোয়া ছ’টা নাগাদ হঠাৎই গেটের মুখে জোর বাওয়াল! ব্যান্ডেরই এক সদস্যের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড় দশ-বারো জন দর্শকের। তাঁদের অভিযোগ, কেন শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান? ব্যান্ড-সদস্য জানান, কার্ডেই তো সময় লেখা রয়েছে: ছ’টা। বিক্ষুব্ধ দর্শকদেরও তখন বক্তব্য সেটাই— ‘আরে দাদা, সেই তো বলছি! পরিষ্কার লেখা রয়েছে, সন্ধে ছ’টায় প্রোগ্রাম। আর এখন সবে সোয়া ছ’টা, শুরু হয়ে গেল?’

‘আই এস টি’ মানে আজ বাঙালির অভিধানে— ইন্ডিয়ান স্ট্রেচেব্ল টাইম! ‘ডেডলাইন’ মানে জাঙিয়ার ইলাস্টিক। বাঙালি-শ্রেষ্ঠ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কি ‘সময়জ্ঞান’ কনসেপ্টটিকে খোঁটা দেননি ‘অন্ত্যেষ্টি-সৎকার’ নাটিকায়? মৃত্যুশয্যায় বাবা। আশা-মাফিক যথাসময়ে তাঁর দেহান্ত হচ্ছে না দেখে, ছেলে গোটা বাঙালি জাতিকেই দুষছে— ‘মরবে তবু পাংচুয়াল হবে না।’ ‘লিপিকা’র ‘ভুল স্বর্গ’ রচনাটিতেও রবীন্দ্রনাথ কাক্কেশ্বরকে কাউন্টার করছেন। লিখছেন, ‘সবাই বলে, ‘সময়ের মূল্য আছে।’ কেউ বলে না, ‘সময় অমূল্য।’ আমবাঙালি অবশ্য সময় নিয়ে এই দর কষাকষিতে নেই। সময় তার কাছে সারা বছরের চৈত্র সেল। ফ্রি। মাগনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bangali susnata chowdhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE