Advertisement
E-Paper

তেতোপ্যাথি হুস!

শক্ত অসুখ হলে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা চাই-ই, কেউ কেউ মানেন না।সারা জীবনে সম্ভবত একটাও অ্যালোপ্যাথি বড়ি খাননি তিনি। ‘সম্ভবত’ শব্দটা নিজেই ব্যবহার করলেন। কারণ, ‘ছোটবেলায় কবে কে কী খাইয়ে দিয়েছে অতটা তো হলফ করে বলা যায় না। তবে এটা বলতে পারি, নিজের মতামত তৈরি হওয়ার পরে আমাকে ও সব বিষ কেউ খাওয়াতে পারেনি।’ একেবারে সিনেমার সংলাপ। বক্তা মহীতোষ হালদার।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫

সারা জীবনে সম্ভবত একটাও অ্যালোপ্যাথি বড়ি খাননি তিনি। ‘সম্ভবত’ শব্দটা নিজেই ব্যবহার করলেন। কারণ, ‘ছোটবেলায় কবে কে কী খাইয়ে দিয়েছে অতটা তো হলফ করে বলা যায় না। তবে এটা বলতে পারি, নিজের মতামত তৈরি হওয়ার পরে আমাকে ও সব বিষ কেউ খাওয়াতে পারেনি।’ একেবারে সিনেমার সংলাপ। বক্তা মহীতোষ হালদার।

হাওড়া জেলার সাঁকরাইলের চম্পাতলার গলি তস্য গলি পেরিয়ে পুরনো আমলের বাড়ি। বাড়ির রং, আসবাবে সেকেলে ভাব, কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতার ছাপও স্পষ্ট। এক ছেলে বেসরকারি সংস্থার কর্মী। মেয়ে স্কুলে পড়ান। বাবার কথায় অসহায় হাসি ফুটে ওঠে তাঁদের মুখে। সত্তর পেরিয়ে মোটের ওপর সুস্থ মহীতোষের হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে মাস কয়েক আগে। কিন্তু অ্যালোপ্যাথিক ট্রিটমেন্টে রাজি নন তিনি। জড়িবুটি ভরসা করেই চিকিৎসা চলছে। ছেলেমেয়েদের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘আয়ুর্বেদ, বুঝলেন! বায়ু, পিত্ত, কফের হাত ধরে রোগ ধরা হয়। সপ্তধাতুর গতিবিধির উপরে নির্ভর করে হয় চিকিৎসা। নো সাইড এফেক্টস অ্যান্ড লো কস্ট!’

চিকিৎসাশাস্ত্রকে ঘিরে নতুন-পুরনোর আদর্শের লড়াই ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর জীবনমশাইকে নানা টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে। আর এ যুগে মহীতোষরা নিজেদের জেদ বজায় রাখতে ক্রমশ অন্যদের থেকে আলাদা হয়েছেন। নিজেদের ইচ্ছা, সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে গিয়ে এঁরা ব্রাত্য হয়েছেন, হাসির পাত্র হয়েছেন পরিবারে, সমাজে। কিন্তু তাঁদের মুখের হাসি বা মনের তৃপ্তিটা কাউকে কেড়ে নিতে দেননি।

উত্তর কলকাতার হরনাথ মজুমদার তাঁর জেদ বজায় রাখার শেষ হাসিটা অন্যদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর অন্তিম ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ যখন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে তখন যেন কাচের গাড়ির সামনে এক টুকরো কাগজে লেখা থাকে, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করিনি পান।’ এখানেই শেষ নয়। স্থানীয় এক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ক্লিনিকের সামনে যেন গাড়িটা কয়েক মিনিট দাঁড়ায়। কেন? তাঁর পুত্রবধূ জানালেন, হরনাথবাবুর ছেলে ওই ক্লিনিকের ম্যানেজার। চিকিৎসা নিয়ে বাবা-ছেলের গোলমাল বহু দিনের। বাবা নিজে কখনও হোমিয়োপ্যাথির বাইরে কোনও চিকিৎসাই করাননি। তিনি সগর্বে বলে বেড়াতেন, হোমিয়োপ্যাথিতে শুধু উপসর্গ দেখে গুচ্ছের ওষুধ ধরিয়ে দেওয়া হয় না। খুঁটিনাটি জেনে তবে একেবারে মূল থেকে রোগ সারানোর চেষ্টা চলে। হরনাথবাবুর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেলে এক রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অন্য হাজারটা রোগকে ডেকে আনা হবে।

কিন্তু ছেলে একটু বড় হওয়ার পর থেকেই এর প্রতিবাদ করে এসেছেন। পুত্রবধূ বলেন, ‘আমাদের একটাই সন্তান। ছোটবেলায় তার টাইফয়েড হয়েছিল। তখনও বাবা ডাক্তার ডাকতে দিচ্ছিলেন না। নাতির মাথার কাছে বসে ঘণ্টায় ঘণ্টায় হোমিয়োপ্যাথির গুলি খাওয়াচ্ছিলেন। আমার স্বামী জোর করে অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার ডাকেন। তার পরে ছেলে তো সুস্থ হল। কিন্তু ও দিকে বাবা-ছেলের কথা বন্ধ হয়ে গেল।’

এ যেন আক্ষরিক অর্থেই ছোটগল্পের চরিত্র! এমন অনেককেই আমরা চিনি, সারাটা জীবন ধরে স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে যাঁরা ঠিক কোথায় পৌঁছতে চেয়েছেন তা আমাদের অজানাই থেকে যায়। প্রিয়জন অসুস্থ হলে অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার ডাকেন না বলে এঁদের স্ত্রী বলেন, ‘হাড়কিপটে’। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে অবলীলায় বলে দেয় ‘অমানুষ’। জামাই-পুত্রবধূ দাগিয়ে দেয় ‘অশিক্ষিত’ বলে।

কিন্তু অ্যালোপ্যাথির প্রতি এই বিরাগ কেন? শুধু ওষুধগুলো তেতো বলে? ইঞ্জেকশন দিলে খুব লাগে বলে? না। অনেকে মনে করেন, অ্যালোপ্যাথিতে নাকি সব লোককে একটাই ছাঁচে ঢেলে, অমুক অসুখ মানেই তমুক ওষুধ এই ভিত্তিতে চিকিৎসা হয়। কিন্তু প্রতিটি মানুষ আলাদা, তাই রোগীকে গোটাগুটি বিচার না করলে, তার রোগ ধরা সম্ভব নয়। মানে, রাম আর শ্যাম যে হেতু আলাদা ব্যক্তি, তাদের ব্যক্তিত্ব আলাদা, ধরন আলাদা, মানসিকতা আলাদা, পরিস্থিতি আলাদা, তাই মাথা ব্যথা করছে বলে দুজনকেই একই ট্যাবলেট দিয়ে দিলাম, এটা চিকিৎসা নয়। তাদের খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে, মাথাব্যথার কারণটা কী। হয়তো দুজনকে সম্পূূর্ণ দুটো আলাদা ওষুধ দিতে হবে।

তথাকথিত ‘লক্ষণভিত্তিক’-এর চেয়ে ‘সমগ্র মানুষভিত্তিক’-এর দিকে, মেনস্ট্রিম চিকিৎসা ছেড়ে ‘হলিস্টিক’ বা ‘অল্টারনেটিভ’ মেডিসিনের দিকে ঝোঁক সারা দুনিয়া জুড়েই কিছুটা চলছে। যেমন, প্রথাগত পথের বাইরে গিয়ে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা হয় লেকটাউনের এক কেন্দ্রে। সেখানে যাঁরা চিকিৎসার জন্য যান, তাঁদের একটা বড় অংশই ক্যানসারের প্রথাগত চিকিৎসা অর্থাৎ কেমোথেরাপি করানোর পাশাপাশি ওই বিশেষ হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা, যার নাম ‘সোরিনাম থেরাপি’, তার আশ্রয় নিচ্ছেন। এরই পাশাপাশি এমন রোগীও অহরহ আসছেন, যাঁরা আজীবন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ স্পর্শ করেননি।

ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় চলছে। নতুন নতুন ওষুধ, রোগ নির্ণয়ের অত্যাধুনিক যন্ত্র, দামী কেমো। কী ভাবে আরও কিছুদিন অন্তত আয়ুটাকে বাড়িয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই চলেছে নিরন্তর। কিন্তু এখানেও স্রোতের উলটো দিকে হাঁটছেন কিছু মানুষ।

মুম্বইয়ের একটি সংস্থা গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যানসারের প্রথাগত চিকিৎসা না করে, একটাও কেমো না নিয়ে কী ভাবে তুলনামূলকভাবে বেশি দিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা যায় সে নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। তাদের বক্তব্য, কেমো, কাটাছেঁড়া, রেডিয়েশন শুধু যন্ত্রণাই বাড়ায়, ক্যানসারকে এক চুলও কমাতে পারে না। আশ্চর্যজনকভাবে কিছু অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকও তাঁদের এই মতামতকে সমর্থন জানিয়েছেন।

কানাডার বিখ্যাত চিকিৎসক উইলিয়াম অসলার একবার বলেছিলেন, ‘ওষুধের প্রতি আকর্ষণ মানুষের জন্মগত। মানুষ নামক পশুটি অন্য পশুদের চেয়ে আলাদা, কারণ মানুষ সব সময়েই কোনও না কোনও অজুহাতে ওষুধ খেতে চায়।’ অসলার চেয়েছিলেন এর মোকাবিলা করতে। তাঁর লক্ষ্য ছিল, প্রেসক্রিপশন না করলে ডাক্তারিই হল না, এই মিথটা ভাঙা। হেল্থ কেয়ার ইকোনমিস্ট ডেভিস এডি-ও আধুনিক এই চিকিৎসাপদ্ধতির নানা অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। এমন নজির আরও আছে।

এঁরা ঠিক করছেন না ভুল করছেন, সেটা মূল কথা নয়। এঁদের যে স্রোতের উলটো দিকে চলার জেদ ও জেহাদ, সারা পৃথিবী এক কথা বললেও নিজে অন্য কথা আঁকড়ে থাকার রোখ, সেই শক্ত মুঠিটা তাঁদের আলাদা করে চেনায় ছাঁচে-ঢালা সমাজে।

soma mukhopadhyay soma independence day
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy