শূন্যনের ‘লাল জমিন’ নাটকের মুহূর্ত। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
ব-য়ে বিশ্ববাংলা, ব-য়ে বহরমপুর। পশ্চিমবঙ্গের নাট্য-মানচিত্রে বহরমপুর বরাবরই ক্ষুদ্র বাঙালিয়ানার গণ্ডি ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে। বুধবার ঝত্বিকের ‘দেশবিদেশের নাট্যমেলা’-র দ্বিতীয় দিনে দেখা গেল বাংলাদেশের ‘শূন্যন’ দলের নাটক ‘লাল জমিন’। মোমেনা চৌধুরীর একক অভিনয় বুঝিয়ে দেয়, স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে বাংলাদেশ আজও লাঞ্ছিতা এক নারী। খানসেনাদের হাতে ধর্ষিতা, তবু মুক্তির স্বপ্ন দেখা। স্বাধীনতা এসেছে, মেলেনি মুক্তির দিশা। শেষ দৃশ্যে বাংলাদেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে সে নারী প্রায় উন্মাদ, দৃষ্টি বনবন ঘোরে তার। নাট্যদলের কনর্ধার মামুনূর রশিদ বলছিলেন, ভিসা, কাঁটাতারের ব্যবধান সত্ত্বেও এদেশে আসতে ভাল লাগে তাঁর।
কিন্তু বহরমপুরের আন্তর্জাতিকতা মানে শুধু বাংলাদেশ? ঋত্বিক সংস্থার সম্পাদক মোহিতবন্ধু অধিকারী জানাচ্ছেন, জার্মানির এক নাট্য দলের সঙ্গে এ বার তাঁদের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে রবীন্দ্রসদন পুনর্সংস্কারের কাজ শেষ হবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় ছিল বলে পাকাপাকি কথা বলা যায়নি। জার্মানি অবশ্য এই উত্সবে দু’ বার ঘুরে গিয়েছে। ২০১১ সালে তাইল্যান্ড। তার আগে পাকিস্তান, কোরিয়া, নরওয়ে।
বহরমপুর থিয়েটারের আন্তর্জাতিকতা অবশ্য কলকাতার চেয়েও পুরনো। আজকের স্কোয়ার ফিল্ড এলাকা তখন কোম্পানির সেনা ছাউনি। বহরমপুরের ইতিহাস-গবেষক সায়ন্তন মজুমদার বলছিলেন, সেই ছাউনির সেনানী জন লিচ বিয়ে করেছিলেন এসথার ফ্ল্যাটম্যানকে। ১৮২৩ সালে ব্যারাকে অভিনীত হয় ‘ওথেলো’। ডেসডিমোনার ভূমিকায় এসথার। সেটিই তাঁর প্রথম অভিনয়। জন মারা গেলে এসথার লিচ আসেন কলকাতায়। পার্ক স্ট্রিটের ‘সাঁ সুসি’ থিয়েটারে অভিনয়ের সময় গাউনে আগুন লেগে পুড়ে মারা যান তিনি। ওই নাট্যমঞ্চের জায়গাতেই আজকের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ।
আন্তর্জাতিকতার এই ইতিহাস-পরম্পরাতেই বাংলা ভাষার গণ্ডি ভেঙে জাতীয় স্তরে পৌঁছে গিয়েছে বহরমপুর। কখনও শো করতে এসেছেন হাবিব তনবীর, কখনও বা জম্মুর নাট্যদল কিংবা নয়াদিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা। কলকাতা শহরে এখন অনেক নাট্যমেলাতেই বিদেশের নাটক দেখা যায়। মফস্সল শহরে টানা ১৪ বছর ধরে পাকিস্তান, কোরিয়া থেকে নাটক আনা সহজ কথা নয়। আগামী ১৭ ডিসেম্বর কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের উত্সব শুরু। গত পাঁচ বছর ধরে সেখানে ভিনদেশি কোনও নাট্যদল নেই। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ‘প্রাঙ্গণে মোর’ নাট্যদলের ‘রক্তকরবী’ই সেখানে শেষ বিদেশি নাটক। এবং সেখানেও বহরমপুরের ছোট্ট ভূমিকা আছে। লুনা আফরোজের দল সে বার বহরমপুরের নাট্য উত্সবে যোগ দিতে আসে, ঋত্বিকের গৌতম রায়চৌধুরীর সৌজন্যে কল্যাণী তাঁকে পায়। বহরমপুরের নাট্য দলগুলিকে নিছক ‘মফস্সলি বৃত্তান্ত’ বলা যায় না, হাত বাড়ালেই বন্ধু!
বিদেশি নাট্যদল নিয়ে আদানপ্রদান এখনও অটুট। এ বার ঋত্বিকের উত্সবের শেষ দিন, ২০ ডিসেম্বর ওই ‘প্রাঙ্গণে মোর’ দলেরই নাটক। কলকাতায় নান্দীকারের জাতীয় নাট্যমেলাতেও এ বার দেখা যাবে তাঁদের। “নান্দীকারের প্রেরণাতেই আমরা বহরমপুরে অন্য ভাষার নাটক এনেছি। আজ এই ছোট শহরেও লোকে যখন জিজ্ঞেস করে, এ বার উত্সবে বাংলার বাইরের কোন নাটক, ভাল লাগে। এটাই প্রাপ্তি,” বলছিলেন মোহিতবাবু। নান্দীকারের রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত খুশিতে বাঙ্ময়, “কাজটাই আসল। কারা আগে, কারা পরে শুরু করল সেটা কোনও বিষয় নয়।”
নান্দীকার পথিকৃত্ অবশ্যই। আর বহরমপুর দিনের পর দিন প্রমাণ করে গেল, ভাল নাটকের খিদে সর্বত্র সমান। সেখানে সদর-অন্দর বা শহর-মফস্সল ভাগাভাগি নেই। তবে একটি তফাত আছে। রবীন্দ্রসদনের পিছনের মাঠে ম্যারাপ-বাঁধা খাবারের জায়গা। ইউরোপ, আমেরিকা যেখানকার নাট্যদল আসুক, পরিচালক থেকে লাইটম্যান সবাইকে ওখানে বসে খেতে হবে। বার্লিন থেকে ভোপাল, সব আমন্ত্রিতরাই একত্র বসে খাবেন। “নাটকই সব নয়, একসঙ্গে খাওয়াটাও আমাদের কাছে প্রধান। নাট্যকর্মীদের মধ্যে জাতপাত থাকে না, সেই শপথটাই আমরা ফি বছর এ ভাবে নিই,” বললেন মোহিতবাবু।
বিভেদ-আক্রান্ত দুনিয়ায় নাটকের এই পংক্তিভোজন সত্যিই অনন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy