ছবি: প্রদীপ আদক
বিজনবাবু (ভট্টাচার্য) আর ধৃতিমানকে (চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে বসেছিলাম সে দিন। ‘পদাতিক’-এর শেষ দৃশ্যের শুটিং। শট নেওয়ার আগে দুজনেই জানতে চাইছিলেন, কী ধরনের অভিনয় আশা করছি আমি তাঁদের কাছ থেকে।
বিজনবাবু বাবার চরিত্রে, ছেলের চরিত্রে ধৃতিমান। ছেলেটি নকশাল, পালিয়ে রয়েছে, আত্মগোপনকারী। পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়েছিল। সে পার্টির হোল-টাইমার— সর্ব ক্ষণের কর্মী। সক্রিয় কর্মী বলেই সে প্রশ্ন তোলে পার্টির নেতৃত্ব সম্পর্কে, অবিরত প্রশ্ন করে নিজেকেও। কত কাল সে এ ভাবে বিচ্ছিন্ন থাকবে, সমস্ত মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। বড় একটা ফ্রন্ট তৈরি করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবত সে, কারা বন্ধু বা কারা শত্রু তা নিয়েও ভাবত, ফলে একটা লম্বা চিঠিও লিখে ফেলল, চিঠিটার ভাষা কঠিন ও ঝাঁজালো, চিঠিটা পাঠাল নেতাদের কাছে। স্বভাবতই উত্তরও এল কঠিন এবং ধারালো, নেতাদের কথা: প্রশ্ন নয়, মেনে চলো, নয়তো অপসারণ। ছেলেটির তখন এক দিকে পুলিশ, আর এক দিকে নেতারা, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। তবু হার মানে না নকশাল ছেলেটি।
বাবা তাঁর ছেলেটিকে বুঝতে পারেন না, নকশাল আন্দোলনকেও বুঝতে পারেন না। তর্ক করেন ছেলের সঙ্গে, রেগেও যান। কারণ তিনিও এক জন সংগ্রামী মানুষ, দীর্ঘ কাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন সামান্য একটা চাকরি করেন, সংসারে অন্ন জোগান, স্ত্রী অসুস্থ, শয্যাশায়ী। মা মারা যাওয়ার পর লুকিয়ে ছেলেটি দেখা করতে আসে, বাবা তাকে সকলের আড়ালে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা কথা বলেন। এটাই ‘পদাতিক’-এর শেষ দৃশ্য। বাবা বলেন যে, তাঁর অফিসে পুরনো কর্মচারীদের একটা কাগজে দস্তখত করতে হচ্ছে— কোনও দিন হরতাল করা চলবে না এই মর্মে, কিন্তু তিনি সে কাগজে সই করেননি। শুনতে শুনতে নকশাল ছেলেটি হতবাক হয়ে যায়, গভীর দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায়। পুলিশের ভ্যান আসার আওয়াজ পাওয়া যায়, পলাতক ছেলেকে পালানোর সাহায্য করতে করতে বাবা বলে ওঠেন: বি ব্রেভ।
পিতা-পুত্রের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এমন মুহূর্ত তৈরি করা যে কোনও ছবি-করিয়ের কাছেই বেশ কঠিন। এতটাই ভেতরকার অনুভূতির ব্যাপার যে এমন পরিস্থিতি তৈরি করাটাই রীতিমত শক্ত হয়ে পড়ে। আমি তখন আমার আগেকার ছবির ক্যামেরাম্যান পল চট্টোপাধ্যায়ের নিজের জীবনের একটা ঘটনা বললাম বিজনবাবু আর ধৃতিমানকে। বানানো নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা কিনা সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগায়!
উত্তরবঙ্গের এক সিভিল সার্জেনের ছেলে পরাধীন ভারতে সন্ত্রাসবাদীদের দলে নাম লিখিয়েছিল, বয়স তখন তার মাত্র ষোলো। বাবার এ নিয়ে তীব্র আপত্তি। তুমুল অশান্তি হত, বকাবকিও করতেন ছেলেকে। এক বার তাঁর সেই ছেলে-সহ সন্ত্রাসবাদী দলের অনেকেই পুলিশের বেদম প্রহারে জেলা হাসপাতালে ভর্তি হল। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ সেই হাসপাতালে তখন সেই সিভিল সার্জেন এলেন। প্রতিটি আহত ছেলের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে নার্সকে নির্দেশ দিতে লাগলেন, তার পর এক সময়ে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু ফের ঘুরে এলেন, মুহূর্তের জন্যে, যেন ফেলে-যাওয়া কোনও জিনিস খুঁজতে এসেছেন, চকিতে গিয়ে দাঁড়ালেন নিজের ছেলের বেডের সামনে, অস্ফুটে বললেন ‘আমি আর এ চাকরি করব না’, বলেই আবার তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেলেন।
বলতে বলতে আমার গলা বুজে আসছিল, ধৃতিমান-বিজনবাবু দুজনেই আমাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন: বুঝতে পেরেছি। যত ক্ষণ ক্যামেরা চলেছিল শেষ দৃশ্যে, অসামান্য অভিনয় করেছিলেন দুজনে।
ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী ছেলেটির পাশে দাঁড়াচ্ছেন তার বাবা যে বিশ্বাস থেকে, সেই বিশ্বাস থেকেই কিন্তু ‘পদাতিক’-এর নকশাল ছেলেটির পাশে দাঁড়াচ্ছেন তাঁর বাবা। সন্ত্রাসবাদ বা নকশাল আন্দোলনের সরব সমর্থক না হয়েও দুই পিতাই কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন, নীরবে, হয়তো সকলের অগোচরে। অথচ একটা গাঢ় বিশ্বাস থেকে।
এমনই একটা বিশ্বাস থেকে ’৬০-’৭০ দশকের সন্ধিক্ষণে নকশাল আন্দোলনকে দেখেছি, তা নিয়ে ভেবেছি, জড়িয়ে পড়েছি। এ দেখার মধ্যে বেহিসেবি দেখা ছিল, এ ভাবনার ভিতরে বেপরোয়া ভাবনা ছিল, এ ভাবে জড়িয়ে পড়ায় অনেকটাই আবেগ যুক্ত ছিল। কিন্তু এ সবের মধ্যে আমার কোনও হিসেব ছিল না, নির্লিপ্ত শীতল পর্যবেক্ষণ ছিল না, ছক কষার কোনও চেষ্টা ছিল না। নকশাল আন্দোলনকে সামনে রেখে কোনও অঙ্কটঙ্ক কষে ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, কিংবা ‘পদাতিক’ বানাইনি। ওই অস্থির সময়টার তাপ যখন যে ভাবে মনের ওপর ছাপ ফেলেছে, সে ভাবেই একের পর এক ছবিগুলো করে গিয়েছি।
কঠিন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাই বরাবর। পুরনো কমিউনিস্ট বন্ধুবান্ধবেরা রাগ করতেন, তর্ক তুলতেন, তিরস্কার করে বলতেন— নকশাল আন্দোলন নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ির কী আছে! আবার ‘ইন্টারভিউ’ বা ‘কলকাতা ৭১’-এর পর যখন ‘পদাতিক’ করি, তখন এ শহরের এক বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক, যিনি নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন, বেজায় চটে গিয়েছিলেন। যে হেতু ছবিটাতে নকশাল আন্দোলনের আত্মসমালোচনার একটা পর্ব ছিল, বিপ্লবী রাজনীতির কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এ সমস্ত সমালোচনায় কখনও ভয় পাইনি, নতি স্বীকার করিনি কোনও চাপের মুখে। বরং বেশ মজাই পেতাম। হয়তো এ সব যুঝবার জোরটা নকশাল আন্দোলনই জুগিয়ে দিয়েছিল!
আসলে যে বিশ্বাস থেকে নকশাল আন্দোলনকে দেখেছি বা তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি, সে বিশ্বাস তো কোনও মতবাদ বা doctrine-এ বিশ্বাস নয়। আর আমার ছবিও নকশাল আন্দোলনের রাজনৈতিক ভাষ্য বা বিশ্লেষণ নয়। আমি সময়টাকে ধরতে চেয়েছিলাম, ষাটের দশকের শেষ থেকেই সেই অস্থির সময়টা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরত। ছবি করা ছাড়া আর কিছু তো পারতাম না, তাই আমার ভেতরকার অস্থিরতাটা আমি আমার ছবির ভাষায় প্রকাশ করতাম, আমার ছবির ভাঙচুরের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করতাম, সে সময়ে আমাদের জীবনে মসৃণতার অভাব দেখানোর জন্যে করতাম।
সত্তর দশকটা ছিল প্রতিবাদের দশক, আর সে প্রতিবাদের ভাষা ছিল হিংসা। প্রতিবাদ আর হিংসার আগুন জ্বলতেই থাকল। পুলিশের একচেটিয়া অত্যাচারে মানুষের মধ্যে উন্মাদনার সৃষ্টি হল। প্রতি দিনের ঘটনা... একটা ছেলে দৌড়চ্ছে, পুলিশ তাড়া করেছে তাকে গুলি করার জন্যে, ছেলেটি দৌড়চ্ছে, দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ সে একটা গাছের ওপর উঠে গেল। উঠে সে ওখানেই লুকিয়ে থাকতে পারত পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, কিন্তু এত রাগ যে সে ওই গাছের ওপর থেকেই নীচে পুলিশকে লক্ষ করে বোমা মারল, টের পাওয়া মাত্রই পুলিশ ছেলেটিকে গুলি করে মাটিতে নামিয়ে আনল। কী সাংঘাতিক!
নকশাল ছেলেটির কী দুরন্ত সাহস, সে জানে যে মরে যাবে, তবু ও-রকম করল। ছেলেটি ভুল করল না ঠিক করল, আমার কাছে তা গৌণ। আমাকে বাক্রুদ্ধ করেছিল ছেলেটির দুর্জয় সাহস! ঠিক এমনটাই দেখেছি ছেলেবেলায় ফরিদপুরে, ব্রিটিশ আমল, ভরদুপুরে সদর কাছারির রাস্তায় একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে রিভলভার হাতে দৌড়ে যাচ্ছে, ধরা পড়লে ফাঁসি হয়ে যাবে। গোটা ব্যাপারটাই হয়তো ছেলেমানুষি, রোম্যান্টিকতা, কিন্তু তা বলে তার প্রচণ্ড সাহস এতটুকু ছোট হয়ে যায় না। ঠিক এ রকমই একটা সাহস থেকে আমার ‘কলকাতা ৭১’-এর ছেলেটা দৌড়য়, কখনও গলির ভিতর দিয়ে, কখনও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, সমুদ্রের পাড় দিয়ে, ভিড় রাস্তা থেকে বড় রাস্তায়, গ্রাম থেকে অরণ্যে, একেবারে শেষে ময়দানে, ভোরবেলায়, দৌড়তে দৌড়তেই গুলির শব্দ হয়, এক ঝাঁক পাখির গুলির আওয়াজে উড়ে যাওয়ার শব্দ।
পুলিশের গুলিতে মারা-যাওয়া সেই কুড়ি বছরের ছেলেটি যেন হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে, এ ভাবেই শুরু হয় ছবিটা। কুড়ি বছর বয়স নিয়ে হাজার বছর ধরে সে দারিদ্র মালিন্য আর মৃত্যুর ভিড় ঠেলে চলেছে, হাজার বছর ধরে দেখছে দারিদ্র বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস। এ ভাবে ইতিহাসকে দেখার চোখ খুলে দিয়েছিল সে সময়টা। আমরা তো রঙিন চশমা পরে আমাদের দেশের ইতিহাসকে দেখি, কত কর্কশ রুক্ষ কদর্য সে ইতিহাস, যেখানে অতীত-বর্তমান একাকার, তার দরজাটা যেন খুলে দিয়েছিল সত্তর দশক, আমার ছবির নাম দিয়েছিলাম তাই ‘কলকাতা ৭১’।
মনে আছে অ্যালবার্ট জনসন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ফিল্মের অধ্যাপক, এ দেশে এসে ‘ইন্টারভিউ’ দেখেন। ’৭০-এর শেষ, ’৭১-এর শুরু তখন, শীতকাল, দেখে এতই উত্তেজিত যে রাত বারোটায় ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসেন আমাদের মতিলাল নেহরু রোডের বাড়িতে। প্রথম প্রশ্নই ছিল তাঁর— রঞ্জিত (মল্লিক) কি সত্যিই নকশাল রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত? এ ছবির কতটা বাস্তব, আর কতটুকুই বা বানানো? ছবিটার শেষে রঞ্জিত পাথর ছুড়ে শো-কেস’এ রাখা ম্যানিকিনের চার পাশের কাচ ভাঙচুর করেছিল, ম্যানিকিনের পোশাক-টোশাক ছেঁড়া হয়েছিল। ছবি দেখে বেরিয়ে বিরক্ত হয়ে অনেকেই আমায় প্রশ্ন করতেন— কী হচ্ছে, এ সব পাগলামির অর্থ কী? আজ এত কাল পর মনে হয়, তাঁদেরকে আমার ‘ডাকঘর’-এর বুড়ো ঠাকুরদার মতো বলা উচিত ছিল— ‘চুপ করো অবিশ্বাসী!’ একটা শাসনের নিগড় ভাঙার জন্যে রঞ্জিতের এই কার্যকলাপের সঙ্গে যেন ঠাকুরদার ধমক কোথাও মিলে যায়, সেখানেও অমলের রাজার চিঠি পাওয়ার স্বপ্নকে যারা মিথ্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে ছিল ঠাকুরদার ওই সংলাপ। রঞ্জিত অমল আর ঠাকুরদার পাগলামির যোগাযোগ আছে একটা কোথাও, সেটা বিশ্বাসের যোগাযোগ।
কুড়ি বছর পর আশি-নব্বই দশকের সন্ধিক্ষণে একটা ছবি করেছিলাম, ‘মহাপৃথিবী’। তখন সাম্যবাদের দুর্গপতন হচ্ছে, ধসে পড়ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তাদের শাসনাধীন পূর্ব বা মধ্য ইউরোপ। উত্তর কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে এক মায়ের আত্মহত্যা দিয়ে ছবিটা শুরু। মায়ের মেজো ছেলে বুলু, নকশাল, পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানালে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সে লড়াইয়ে নেমেছিল। আত্মহত্যার পর মা-র একটা ডায়েরি পাওয়া যায়, তাতে তিনি ধুয়োর মতো একটা প্রশ্নই ঘুরেফিরে করেছিলেন কেবল— বুলু, তোরা কি সব মিথ্যে হয়ে গেলি?
আজ যখন আমি পিছনে চলে যাই তখন সে সময়টাকে আরও বিশদ ভাবে খুঁজে পাই যেন... না, বুলুরা কেউ মিথ্যে হয়ে যায়নি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy