Advertisement
E-Paper

প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গেলেন যিশু

লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ধারালো চেহারা, শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর ভরাট স্বর। সমীহ জাগানো গোয়েন্দার অবয়ব কল্পনা করতে চাইলে এই রকম সব ব্যাপারস্যাপার যে থাকতেই হবে, সেটা কী ভাবে যেন আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই দেখবেন, এটা ভাবনার একটা বদভ্যাস। স্টিরিওটাইপ।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৫

ধারালো চেহারা, শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর ভরাট স্বর। সমীহ জাগানো গোয়েন্দার অবয়ব কল্পনা করতে চাইলে এই রকম সব ব্যাপারস্যাপার যে থাকতেই হবে, সেটা কী ভাবে যেন আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই দেখবেন, এটা ভাবনার একটা বদভ্যাস। স্টিরিওটাইপ।

যিশু সেনগুপ্ত ব্যোমকেশ করা মানে এই স্টিরিওটাইপটি ভাঙা। যিশু মানেই যেন মিষ্টি মুখ, মিষ্টি হাসি, মিষ্টি গলা। তিনি হবেন ডাকসাইটে গোয়েন্দা? অঞ্জন দত্তের নতুন ব্যোমকেশে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এবং যিশু প্রমাণ করে ছাড়লেন, অভিনয়টা করতে জানলে মিষ্টি মুখ-মিষ্টি হাসি এক জন গোয়েন্দার সম্পদ হতে পারে। অভিনেতা যিশুর জার্নি হিসেবে যদি এই ব্যোমকেশকে দেখি, তা হলে বলতেই হবে যিশু প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। যাঁরা ভাবছেন নতুন ব্যোমকেশের সঙ্গে পুরনো অজিতের রসায়ন কেমন জমবে, তাঁরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। যিশু আর শাশ্বতকে দেখে মনে হচ্ছে না এই প্রথম বার জুড়ি বেঁধেছেন। ব্যোমকেশ মাথায় বাড়ি খাওয়ার পরে অজিত একাই গল্পটা বেশ কিছু ক্ষণ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় যথারীতি সেখানে দুরন্ত। কিন্তু যিশুও হারিয়ে গেলেন না। ব্যোমকেশ-অজিত যুগলবন্দিই আগাগোড়া এই ছবির প্রাণভোমরা।

ব্যোমকেশ সিরিজে অঞ্জন দত্তের এটি চতুর্থ ছবি। তাঁর প্রথমটির নামও ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ই ছিল। অন্য একটা নাম ভাবা গেল না কেন, স্পষ্ট নয়। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট। অজস্র ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়েই অঞ্জন পরপর ব্যোমকেশ করে যাচ্ছেন। সেই সব ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করতে করতেই দর্শক ব্যোমকেশ দেখে যাচ্ছেন। সকলেই জেনে গিয়েছেন এত দিনে যে, এ বারের গল্প ‘কহেন কবি কালিদাস’ যেখানে ব্যোমকেশ একটি কয়লা খনিতে ঝুটঝামেলার রহস্য ভেদ করতে গিয়ে অন্য একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে। এবং সেই খুনের গল্পটাই ক্রমে ‘আসল’ গল্প হয়ে ওঠে। অঞ্জনের ব্যোমকেশ সিরিজে এই কয়লা-শহরের গল্প ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে? উত্তরটা বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। কারণ, এই ছবির একাধিক জায়গায় অঞ্জন তাঁর আগের তিনটির চেয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। কিছু জায়গায় একই রকম রয়েছেন। আবার দু’একটি জায়গায় একটু দুর্বলও হয়েছেন। আমরা শেষ থেকে শুরু করব। অর্থাৎ দুর্বলতার জায়গাগুলো আগে বলে নিয়ে মধুরেণ সমাপয়েতের দিকে এগোব।

দুর্বলতা নম্বর ওয়ান। রহস্যের মূল বুনোটটি জমেনি। ফলে গল্পের নিজস্ব চলনের মধ্যে সাসপেন্স তেমন ঘনায়নি। গতির দিক থেকেও ছবিটা বহু বার ঠোক্কর খেয়েছে। প্রাণহরি পোদ্দারের বাড়িতে এসে ব্যোমকেশ, অজিত আর ইনস্পেক্টর বরাট বকবক করেই যাচ্ছেন। অরবিন্দ হালদার (সাগ্নিক) তার বাড়িতে শার্টের বোতাম খুলে দাঁড়িয়ে হাবিজাবি বলেই যাচ্ছে। বেশ ক্লান্তিকর। সবচেয়ে বড় কথা, খুনের রাতের যে দৃশ্যটা চার বন্ধু চার বার করে বর্ণনা করছে, সেটাও ঠিক দাঁড়ায়নি। চার জনে ঠিক কী প্ল্যান করে এগোচ্ছিল, কার কী দায়িত্ব ছিল, নিশুতি রাতে ট্যাক্সি থেকে নামার পর তাদের সব ঝগড়া উথলে উঠল কেন, ওইটুকু একটা জায়গার মধ্যে কে কোথায় ছিটকেই বা গেল, কিছুই ভাল করে বোঝা যায় না। চার জনের বক্তব্যের মধ্যে যেটুকু গরমিল, তাতে বাড়তি উত্তেজনাও যোগ হয় না। বর‌ং দৃশ্যটা বারবার দেখে একঘেয়েমি বাড়তে থাকে। যে দৃশ্য রিপিট করা হবে, সেটা যদি জোরদার না হয়, তবে বড্ড মুশকিল। চার বন্ধু কেউই ঠিক ক্রিমিনাল নয়। কিন্তু তাই বলে খুনের রাতে যতটা আনাড়িপনা আর বোঝাপড়ার অভাব তারা দেখাল, সেটা বিশ্বাসযোগ্য হল না। অঞ্জনের ছবিতে ছোট-বড় পার্শ্বচরিত্রেরা সাধারণত ভাল অভিনয় করে থাকেন। এ বারে সকলের সম্পর্কে সেটাও বলা গেল না। কৌশিক সেন লাগাতার ভিলেন হয়ে যাচ্ছেন। এ বার একটু মুখ বদল হলে ভাল। সুরপতি আর বিশুকে প্রথম থেকেই ভিলেন বলে বোঝা যায়। ফলে কয়লা খনির রহস্যটা গোড়াতেই মুলতুবি হয়ে যায়। সামগ্রিক ভাবে সাসপেন্স তৈরির দিক থেকে এই ছবিটা তাই পিছিয়ে থাকছে। আর একটি দুর্বলতা মোহিনী। না, অঙ্কিতা বেশ ভালই অভিনয় করেছেন। কিন্তু প্রাণহরির জুয়ার আড্ডায় মোহিনীর ভূমিকাটা এত বেশি চড়া দাগে দেখানো হয় যে পরে তার মুখে ‘আমার ইজ্জৎ এত সস্তা নয়’-এর মতো সংলাপ আর লাগসই থাকে না। যার ইজ্জৎ সস্তা নয়, সে পুলিশ অফিসারের সামনে আঁচল নিয়ে অসাবধান থাকবে না নিশ্চয়।

অঞ্জনের ব্যোমকেশ যাঁরা পরপর দেখেছেন, তাঁরা জানেন বেশ কিছু ফাঁকফোকর তাঁর চিত্রনাট্যে থেকেই থাকে। অনেক চরিত্র অনেক কাজ করে, যেটা তাদের করার কথা নয়। অনেক কিছু ঘটে, যেটা ঘটার কথা নয়। এমন কিছু ব্যাপার চিত্রনাট্যে ঢুকে পড়ে, যেটা গল্পের ঘোষিত কালপর্বের সঙ্গে খাপ খায় না। এ বারেও সেই সব গড়়বড় কিছু কিছু আছে। বহু চরিত্রেরই সংলাপ অনেকাংশে দুর্বল। অ়জিত যে সানগ্লাসটা পরেছে, সেটা দেখলে রে-ব্যান ছাড়া কিছু মনে হয় না। ভুবন দাস (চন্দন সেন) ড্রাইভারকে প্রাণহরি নাকি তিনশো টাকা দিত। অজিত শুনে বলছে, ‘‘মাত্র?’’ ষাটের দশকের শেষে (ছবিতে এটাই কাহিনির কাল) ড্রাইভার মাসিক বন্দোবস্তে তিনশো টাকা পেলে, সেটা কম? ‘কহেন কবি..’র প্রথম মুদ্রণ ১৯৬১ সালে। সেখানে টাকাটা ছিল পঁয়ত্রিশ। তার পর ধরুন, ছবির গোড়াতেই দেখছি ব্যোমকেশ স্বগতোক্তি করছে, ‘‘ইট হ্যাজ টু বি..।’’ এই ভাষাটা ব্যোমকেশের সঙ্গে যায়? প্রশ্ন বাড়াচ্ছি না। শরদিন্দু থাকলে বলতেন, অলমিতি।

আসা যাক ভাল-র কথায়। সত্যবতী (উষসী চক্রবর্তী) এ বারে তার মুখরা স্বভাবটি ত্যাগ করেছে। নিশ্চিন্ত হলুম। বইয়ে যা ছিল, তার থেকে ফণীশ (জয়জিৎ) এবং ইন্দিরার (প্রিয়ঙ্কা) চরিত্রটি বদলেছে। কিন্তু সেটা বেমানান হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত তারা দু’জনে কী করল, সেটা জানতে পারলে আরও ভাল লাগত। ভিলেনের মুখে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু যুক্তি খাড়া করার কাজটি এর আগে অঞ্জন একাধিক বার করেছেন। কিন্তু এ বারে গোবিন্দ হালদার যখন দাপটে বলে উঠল, ‘‘সবই তো চাড্ডি টাকার জন্যেই’’, বেশ জমে গেল কিন্তু। আরও জমিয়ে দিলেন যিশু, যখন কোনও রকম বাড়াবাড়ির মধ্যে না গিয়ে খুব শান্ত ভাবে বুঝিয়ে দিলেন ব্যোমকেশ কোথায় আলাদা।

আর একটা কথা আছে, স্যার। ছবিতে ব্যোমকেশের প্রথম আবির্ভাব কাবুলিওয়ালার ছদ্মবেশে। পাঞ্জাবির পকেটে সাপের কথাও এল। অঞ্জনের চতুর্থ ব্যোমকেশে ক্লাইম্যাক্সেরও একটা ক্লাইম্যাক্স আছে। সেটা দেখলে বুঝবেন, ভাল সিক্যুয়েল অনেক দেখেছেন। কিন্তু কৌস্তুভ রায় প্রযোজিত আরপি টেকভিশন-এর এই ছবিটা একটা দুরন্ত প্রিক্যুয়েল। শেষ কালের ওই আলতো
টোকাটিই ছবির সবচেয়ে বড় তেহাই। এবং সেটা শরদিন্দু নয়, অঞ্জনেরই তৈরি। পয়সা উসুল!

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy