Advertisement
E-Paper

বায়োপিকে আমার আগ্রহ নেই

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘সেলফি’তে উঁকি দিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।শ্যুটিংয়ের সময় ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সরিয়ে রাখা যায়। কিন্তু অবসরে আত্মজীবনী লেখার কথা মনে আসে না? বললেন, “আমার কিছু লেখা নিয়ে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘পরিচয়’। কিন্তু আমি কোনও আত্মজীবনী লিখিনি। তার কারণ আমি জানি, সরাসরি ভাবে সবটা লেখা যায় না। ভেতরে অনেক কিছুই রয়ে যায়।”

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০০

আশি ছুঁইছুঁই নায়ক। এখনও চূড়ান্ত ব্যস্ততায় কাটছে দিন। কখনও মঞ্চে অভিনয়, কখনও শ্যুটিং। কখনও বা নিভৃতে কবিতা লেখা। এত কিছুর মাঝে মনে হয় না নিজেকে নিয়ে তৈরি করা একটা বায়োপিক দেখতে? ঠিক যে ভাবে বিশ্বের কিংবদন্তি শিল্পী চ্যাপলিন থেকে পাসোলিনিদের নিয়ে করা হয়েছে?

প্রশ্নটা শুনে বিন্দুমাত্র না থেমেই উত্তর দিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “না, বায়োপিক তৈরি নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। প্রথমে কে করবে সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন রয়েছে। সে আমাকে কতটুকু জানে? আমার অবর্তমানে কেউ যদি কিছু করে, তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।”


‘সেলফি’তে সৌমিত্র-সোহিনী।

তা হলে ‘সেলফি’ ছবিটাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে টলিউডের প্রথম বায়োপিক?

সেই সংজ্ঞাটা ভুল।

‘অপুর সংসার’য়ের রিমেক?

‘অটোগ্রাফ’কে যেমন ‘নায়ক’য়ের রিমেক বলা যায় না, ‘সেলফি’ও ‘অপুর সংসার’য়ের রিমেক নয়।

তা হলে ‘সেলফি’ কী ‘স্পুফ’? দপর্ণের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিচ্ছবি? না কি ছবিতেই ব্যবহৃত সৌমিত্রের নিজের লেখা কবিতার লাইন যেখানে শিল্পী নিজেই ঘোষণা করছেন ‘যদি কোনও প্রতিবিম্ব থাকে/ যোগভ্রষ্ট আত্মপ্রতিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়’?

আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে ছবিটা এ সময়ে দাঁড়িয়ে ‘অপুর সংসার’য়ের সঙ্গে একটা ডায়ালগ স্থাপন করার চেষ্টা। এমন একটা ডায়ালগ যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রয়েছেন নিজের ভূমিকায়। রয়েছে অপর্ণা। আর রয়েছে অন্য এক সৌমিত্র।

না, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ডাবল রোল নেই এখানে।

এই দ্বিতীয় সৌমিত্র হল এক ফিল্ম ইউনিটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। কিন্তু মিল শুধু মাত্র নামে। অন্য সব কিছুই আলাদা। আর এই মিল-অমিলের ধূসর জায়গায় আনাগোনা করে তার প্রেমিকা মেক আপ আর্টিস্ট অপর্ণা।

এই তিন চরিত্রের পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া, প্রেম-অপ্রেম, ভয় নিয়েই গাঁথা ‘সেলফি’র চিত্রনাট্য। যেখানে দুই সৌমিত্র আর অপর্ণা মিলে এক রিয়েলিটি শো-এর প্রতিযোগী হয়ে হানা দেয় অভিনেতার দুঃস্বপ্নে। যেখানে বাস্তব মাঝেমধ্যেই মিশে যায় স্বপ্নের ছায়ায়। তৈরি করে নতুন সব নিজস্বী।

আত্মজীবনীমূলক কাজ এর আগে মঞ্চে করেছেন সৌমিত্রবাবু। ‘তৃতীয় অঙ্ক অতএব’ নাটকে নিজের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অনেকেই মনে করেন যে কবিতাটার মধ্যেই একটা সমান্তরাল আত্মকথা লিখে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু বড় পর্দায় এমন কাজ তো তিনি এর আগে করেননি। শোভন তরফদারের ‘সেলফি’ কি তা হলে সেই সুযোগ করে দিল নায়ককে?

ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য ২০১৪-তে টালা ব্রিজের ধারে সেই বাড়িতে আবার ফিরে গিয়েছিলেন নায়ক। এক সময় যেখানে সত্যজিৎ রায় শ্যুটিং করেছিলেন ‘অপুর পাঁচালি’। যে গলি ধরে একদিন হেঁটে গিয়েছিলেন শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে...প্রায় ৫৫ বছর পর আবার সেখানে ফিরে গিয়ে, ফিরে দেখে ওঁর মনে হচ্ছিল, এ যেন জন্মান্তরের মতোই এক অভিজ্ঞতা।

“প্রথমেই বলি ‘সেলফি’ কিন্তু আমার আত্মকথা নয়। ‘স্পুফ’ বলাটাও ঠিক হবে না। আমি বলব এটা সুন্দর একটা টেল। ক্লেভারলি ক্র্যাফ্টেড একটা আখ্যান,” জানাচ্ছেন সৌমিত্র।

‘ক্লেভারলি ক্র্যাফ্টেড’ বলেই হয়তো তা দেখে দর্শক জিজ্ঞেস করবেন এমনটা কি সত্যি হয়েছিল? অথবা প্রশ্ন করবেন, কেমন হত যদি এমনটা ঘটত?

এর কারণ চিত্রনাট্যের মুনশিয়ানা। যার জন্য বেশ কিছু প্রশ্ন উঁকি দেয় কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনসত্যের খুব কাছাকাছি এক আবর্তে। যেমন, কেন ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর কোনও দিন কাজ করা হয়ে ওঠেনি? যদিও নিজমুখে বারবার বলেছেন যে উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল, বাস্তবে কি সেটাই সত্যি ছিল? আরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায় নায়কের অভিনীত চরিত্রকে কেন্দ্র করে। ‘অপুর সংসার’য়ের অপর্ণা অনেক অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিল। শোকতাপের পরেও বিপত্নীক অপুর কি কোনও মহিলা-সঙ্গ প্রয়োজন হয়নি?

প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর মেলে ছবিতেই। অপুর আর কোনও মহিলা-সঙ্গ প্রয়োজন ছিল কি না, সে প্রসঙ্গ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে আসে ঠিকই। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে তা নেই। ‘সেলফি’তেও না।

বিদেশের কিংবদন্তি শিল্পীদের জীবনের আধারে ছবি তৈরি হলে পরিচালকরা সেখানে তাঁদের নারীসঙ্গের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান না। এ দেশে বাধানিষেধ অনেক। সেখানে কিংবদন্তি শিল্পী বা তাঁদের অভিনীত চরিত্রদেরও সাধারণত ‘ডি-সেক্সুয়ালাইজ’ করাটাই প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ তাই আজও ব্যতিক্রমী ছবি। ‘সেলফি’র চিত্রনাট্যে সে ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও সরাসরি ভাবে কিছুই বলা নেই। সেখানে এই পুরো প্রসঙ্গটাই এসেছে এক দুঃস্বপ্ন হিসেবে!

জানতে ইচ্ছে করে, নায়কের জীবনেও কি ‘সেলফি’ ছবির অপর্ণার মতো নারীরা আসেননি? যাঁরা স্বীকার করতেন যে, নায়ককে দেখে তাঁদের মনে পড়ে অপুর সেই ‘ডিপ, ব্রুডিং’ দু’টো চোখ? যাঁরা অনায়াসে নিজেদের বেআব্রু পিঠে চেয়ে বসেন নায়কের কাছে... সৌমিত্র নয়, অপুর অটোগ্রাফ?

‘সহচরী’ কবিতায় কবেই সৌমিত্র লিখেছিলেন: ‘আমি যাদের সঙ্গে/ ভালবাসার সম্পর্ক করে/ আয়ুর অনেকটা অর্থবহ করে তুলেছি/ তাদের কারও একটা ছবিও আমার কাছে নেই/ তবু সমাজ নির্দেশের বাইরে/ সেই সম্পর্কগুলি/ ভূগর্ভের অন্ধকার জলধারার মতো/ এখনও আমার আনন্দের স্রোত হয়ে আছে/ এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই/ তাদের ছবি নেই আমার অ্যালবামে/ তবু তাদের মুখ মনে পড়ে/ যখনই সহচরী বাসনার মুখের দিকে আমি তাকাই...’

এ ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে কোনও মুখ কি তাঁর মনে ভেসে এসেছিল? এমন মুখ, যার ছবি রাখা নেই তাঁর কোনও অ্যালবামে? “ঠিক এ ধরনের মানুষ যে আসেনি তা নয়। আমার ইমেজের প্রতি লালায়িত হয়েছেন। তবে তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড অন্য রকম। তাঁদের জীবনে আলো প্রবেশ করেনি, তাই হয়তো আমার দিকে ও ভাবে দেখেছেন। কিন্তু শ্যুটিংয়ের সময় কোনও মুখই ভেসে আসেনি। তখন আমি একজন পেশাদার অভিনেতা,” বলছেন নায়ক।

শ্যুটিংয়ের সময় ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সরিয়ে রাখা যায়। কিন্তু অবসরে আত্মজীবনী লেখার কথা মনে আসে না? বললেন, “আমার কিছু লেখা নিয়ে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘পরিচয়’। কিন্তু আমি কোনও আত্মজীবনী লিখিনি। তার কারণ আমি জানি, সরাসরি ভাবে সবটা লেখা যায় না। ভেতরে অনেক কিছুই রয়ে যায়।”

‘সেলফি’র মূল বক্তব্যও এই দর্শনকে ঘিরেই। ‘লাইফ ইজ অ্যান ওপেন বুক’ লাইনটা শুনতে দারুণ। বলার মধ্যেও বীরত্ব থাকে। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় নিজস্বী তোলার সময়ও সমান্তরাল ভাবে সেল্ফ-এডিটিং চলতে থাকে। কারণ ছবিটির বাইরেও পড়ে থাকে অন্য এক ছবি। আর অনেক না-বলা কথা।

আনাচে কানাচে


গিলি গিলি ফু: সোনু নিগম। কলকাতার এক স্টুডিয়োতে
মিউজিক ভিডিয়ো শ্যুটে। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।


খিলখিলাকর হস দিয়ে: সানিয়া মির্জা-মাধুরী দীক্ষিত নেনে।

ananda plus selfie drama soumitra chattopadhay soumitra chatterjee priyanka dasgupta sobhon tarafdar sovon tarafdar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy