Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মঞ্চে দেহান্তর

দাবি, রূপান্তরকামীদের দিয়ে এমন নাটক বাংলা মঞ্চে প্রথম। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।‘বিগ বস’য়ে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়। তখন তিনি সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময় নানা বিষয়ে কথা হলেও নাটক করার প্রসঙ্গ ওঠেনি। ‘বিগ বস’য়ে যাওয়ার ঠিক আগে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল ‘তৃতীয়’ লিঙ্গ প্রসঙ্গে।

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে টিম ‘দেহান্তর মনান্তর’। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে টিম ‘দেহান্তর মনান্তর’। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৮:৫৯
Share: Save:

‘বিগ বস’য়ে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়। তখন তিনি সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময় নানা বিষয়ে কথা হলেও নাটক করার প্রসঙ্গ ওঠেনি।

‘বিগ বস’য়ে যাওয়ার ঠিক আগে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল ‘তৃতীয়’ লিঙ্গ প্রসঙ্গে। ‘তৃতীয়’ শব্দটা নিয়ে দেবেশের ঘোর আপত্তি। বলেছিলেন তৃতীয় বলে কিছু নির্ধারিত হলে প্রথম বা দ্বিতীয়কেও নির্ধারণ করতে হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়ের সংঘাতে বিশ্বাস করেন না দেবেশ। প্রায়োরিটি সিকোয়েন্সেও নয়।

এর পর মানবী চলে যান ‘বিগ বস’য়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর দেবেশের সঙ্গে আবার দেখা। তত দিনে তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও প্রকাশ হয়েছে। হঠাৎ একদিন ঠিক হল কেমন হয় যদি রূপান্তরকামীদের কথা নিয়ে তাঁদের দিয়ে একটা ডকু-থিয়েটারে অভিনয় করানো যায়? শুরু হল তৃতীয় লিঙ্গের আত্মকথন মঞ্চস্থ করার ওয়ার্কশপ।

মহালয়াতে প্রথম মঞ্চস্থ হবে এ নাটক। নাম ‘দেহান্তর মনান্তর’। নাটকের পেছনে মূল ভাবনা নিয়ে বলতে গিয়ে দেবেশ জানাচ্ছেন, “আমি চেয়েছি সেক্স অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটির প্রেক্ষিতে ওরা নিজেদের কথা অন্তরঙ্গ ভাবে বলুক। সে জন্যই ব্যবহার করব নাট্য অ্যাকাডেমির তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহের ইন্টিমেট স্পেস। নাটকে যৌনতা থাকছে। নগ্নতা নেই। আর মহালয়ার দিনটা বেছে নেওয়া দেবীপক্ষের সূচনা বলে। তিন ধরনের দেবী আছেন এই নাট্যে। কেউ শরীর পাল্টে ফেলেছেন। কেউ শুধুই মন, আবার কেউ সদ্য নিজেকে নারী হিসেবে ভাবতে চাইছেন।”

মোট সাত জন অভিনয় করছেন এই নাটকে। মানবী ছাড়াও সে নাটকে রয়েছেন সায়ন্তন ঘোষ, ঋক ঘোষ, কুসুম সামন্ত, সৌরভ দত্ত, পার্থসারথি দাস আর তনুশ্রী চক্রবর্তী। মানবী আর তনুশ্রী দুজনেই সেক্স রিঅ্যালাইনমেন্ট সার্জারি করিয়েছেন। অন্যরা সবাই রূপান্তরকামী। ওয়ার্কশপের সময় এঁরা সবাই নিজেদের জীবনের গল্পগুলো শোনাতে থাকেন। এবং তা নিয়েই তৈরি হয় ডকু-থিয়েটারের চিত্রনাট্য।

মানবী আর দেবেশের দাবি এই প্রথম ‘সেক্স রিঅ্যালাইনমেন্ট সার্জারি’ নিয়ে কোনও রূপান্তরকামী নিজেই নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। “ঋতুপর্ণ ঘোষ বিষয়টা এনেছিলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ সিনেমাতে। কিন্তু তিনি ইতিহাসের পটভূমি ব্যবহার করে তা বুঝিয়েছিলেন। আমি নিজের অভিজ্ঞতা নিজেই মঞ্চে বলব। মানসিক ভাবে এই সার্জারি করতে গেলে যে কত রকম ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সেটাই আমরা নিজেদের জবানিতে বলব,” বলছেন মানবী।

কুসুম সামন্ত কাজ করেন একটা কারখানায়। এ ছাড়াও যাত্রা করেন গ্রামে। “কুসুমের মা ওকে ছেলে হিসেবেই মানুষ করেছে। একদিন ব্যাগ থেকে হঠাৎ একটা অন্তর্বাস খুঁজে পান তিনি। ভাবেন ছেলের চরিত্র বোধহয় নষ্ট হয়েছে। তখন ছেলের বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। বাধ্য হয়ে কুসুমকে বলতে হয় তাঁর অবস্থানের কথা। মাকে এই ব্যাপারটা জানানোটা যে কত কষ্টের ছিল, তা বলতে গিয়ে কুসুম একদম ভেঙে পড়ে,” বলছেন পরিচালক।

সায়ন্তনের অভিজ্ঞতা আলাদা। পেশায় তিনি আইনজীবী। সারাদিন কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তাঁর ব্যাগে রাখা থাকে নাচের পোশাক। কোর্টে প্র্যাকটিস সেরে সায়ন্তন মেয়েদের পোশাক পরে নাচের স্কুলে যান। সেখানে রাত ন’টা অবধি নাচগান। বাড়ি ফেরার আগে আবার পুরুষের পোশাক পরে নেন। সেটা পরেই বাড়িতে ঢোকা।

অভিজ্ঞতাগুলো মর্মস্পর্শী ঠিকই। তবে অভিনেতা হিসেবে এঁরা কেমন? উত্তরে পরিচালক বলছেন, “এরা প্রচণ্ড ইমোশনাল। সেটাকে পারফর্ম্যান্সের জন্য ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সে কনভার্ট করতে পারলে এরা অসাধারণ পারফর্মার। মানবী, সায়ন্তন, কুসুম, তনুশ্রীর পারফর্ম্যান্স থেকে সেটা বোঝা যাবে। বাকিরা তৈরি হতে হতে যাবে।”

ডকু-থিয়েটারের উদ্দেশ্য মহৎ। তবে এঁদের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে দক্ষ অভিনেতাদের দিয়ে ডকু-থিয়েটার করালেও তো হত? দক্ষ অভিনেতারা স্টেজের ভাষাটা অনেক ভাল বোঝেন। তাঁরা অভিনয় করলে চমক বা গিমিক ট্যাগটাও থাকত না। “হয়তো পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করলে পারফর্ম্যান্সটা বেটার হত। এমন প্রয়াস আগেও হয়েছে। কিন্তু আমি এই কাজের মধ্যে দিয়েই এই মানুষের প্রতি এমপ্যাথি চেয়েছি। সিমপ্যাথি নয়। এঁরা নিজেরা অভিনয় করলে সেটা হবে। শুধুমাত্র থিয়েটার হিসেবে এই কাজটাকে মূল্যায়ন করলে চলবে না। এই কাজটার উদ্দেশ্য অন্য।”

পাবলিক ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে নারী-পুরুষকে কোনও দিন ভাবতে হয় না যে কোন ঘরে তাঁদের ঢুকতে হবে। এঁদের সে সমস্যা হয়। পুরুষদের শৌচালয়ে গেলে টিটকিরি খেতে হয়। মহিলাদের শৌচালয়ে গেলেও অস্বস্তি কম হয় না। হয়তো এই কাজের পরে দর্শক দু’বার ভাববেন এমন কত বেসিক সমস্যা আজও এঁদের কুরেকুরে খায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE