Advertisement
E-Paper

মধ্যবিত্তের সমস্যা-সিরিজের সফল রূপায়ণ

শিক্ষিকার মেজাজে রচনা সম্পূর্ণ। গার্গীর কামব্যাক সফল। তবু কিছু খামতি থেকে গেল। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।গুরুজন স্থানীয় এক জনের মুখেই গল্পটা শোনা। চেতলা বয়েজ স্কুলে পড়তেন তিনি। কোনও এক ইন্টারভিউ প্যানেলের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আশেপাশে বেশ কয়েক জন ভারী ভারী কনভেন্ট থেকে পাশ করা ছেলে। আমাদের চরিত্রটি দর বাড়াবার জন্য দুম করে বলে দিলেন, সেন্ট চেতলা!

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৪ ০০:০০

গুরুজন স্থানীয় এক জনের মুখেই গল্পটা শোনা। চেতলা বয়েজ স্কুলে পড়তেন তিনি। কোনও এক ইন্টারভিউ প্যানেলের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আশেপাশে বেশ কয়েক জন ভারী ভারী কনভেন্ট থেকে পাশ করা ছেলে। আমাদের চরিত্রটি দর বাড়াবার জন্য দুম করে বলে দিলেন, সেন্ট চেতলা!

তবে সেটা ছিল নিতান্তই দাশুসুলভ মিচকেমি। ভদ্রলোক পরে রীতিমতো মান্যগণ্য মানুষ বলে সুপরিচিত হন।

কিন্তু সেই সময় আর আজকের সময়ের মধ্যে অনেকটা তফাত। এখনকার বাচ্চারা কেউই বড় একটা বাংলা স্কুলে পড়তে যায় না। আজকের বাবা-মায়েরাও শহরাঞ্চলে ছেলেমেয়েদের বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করার কথা পারতপক্ষে ভাবেন না। বাংলা ইস্কুলে পড়েও ইংরেজি শেখা যায় কি না, সরকারি বা আধা সরকারি স্কুলগুলোর পরিকাঠামো ভাল হলে এমনটা হত কি না, একটা সময় প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এর জন্য কতটা দায়ী এমন হরেক প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিশ্বায়িত অর্থনীতির দাবিও আছে। এই মুহূর্তে একটা আস্ত ছবিও আছে, রামধনু!

একাধিক সংলাপে খুচরো কিছু রেফারেন্স থাকলেও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের ছবিটি অবশ্য কেন, কী ভাবে ইংরেজি ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়াটাই সন্তান প্রতিপালনের পয়লা নম্বর কর্তব্য হয়ে উঠল, সেটা খুঁজে দেখেনি। বাবা-মা আর বাচ্চাকে ভর্তি করার জন্য তাঁদের প্রাণান্তকর পরিশ্রমটুকুই এ ছবির গল্প। তার মধ্যে দিয়েই লটারিতে অস্বচ্ছতা, ডোনেশন-রাজ, ইন্টারভিউ নামক জুজু ইত্যাদি সবই গল্পে ঢুকে পড়েছে। কিছু ঘটনা, কিছু রটনা এবং এ সব ঘিরে পাগল-পারা আতঙ্কই বলতে গেলে এ ছবির সবচেয়ে বড় চরিত্র। পরিচালকদ্বয় এ বারও সুচিত্রা ভট্টাচার্যর কাহিনি নির্বাচন করেছেন। চিত্রনাট্য নন্দিতা, সংলাপ শিবপ্রসাদ।

শিবপ্রসাদ-নন্দিতার বেশির ভাগ ছবিকেই বলা চলে মধ্যবিত্তের সমস্যা-সিরিজ। কখনও সন্তানের ওপর মায়ের পজেসিভনেস, কখনও পথ দুর্ঘটনা, কখনও চিকিত্‌সকের মূল্যবোধ... এমন সব বিষয়, যা নিয়ে সক্কলের দুইখান কথা আছে। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তির সমস্যা সেই মেনুতে একেবারে গোড়ার দিকে থাকবে। আর সেই জায়গা থেকেই আঠেরো থেকে আঠাশ যদি না-ও দেখেন, পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়ষট্টিরা ‘রামধনু’ দেখবেনই এবং রিলেট করবেনই! ছবিটির সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা এই রিলেটেবিলিটি! ওষুধের দোকানি লাল্টু দত্ত (শিবপ্রসাদ), তার স্ত্রী মিতালি (গার্গী) এবং তাদের ছেলে গোগোলের (আকাশনীল) গল্প যাকে বলে ঘর ঘর কি কহানি!

শিব-নন্দিতার ছবি দেখলে বোঝা যায়, তাঁদের নিশানা খুব স্পষ্ট। চিত্রনাট্য বা চিত্রভাষা কোথাও কোনও মারপ্যাঁচ নেই। সরল গল্প সরলীকৃত ভাবে বলে যাওয়াটাই তাঁদের স্টাইল। কিন্তু তার মধ্যে বেশ একটা আটপৌরে ছোঁয়া থাকে। আটপৌরে বিষয় নির্বাচনের সঙ্গে সেটা দিব্য মানিয়ে যায়। শিবপ্রসাদদের কৃতিত্ব, তাঁরা এক দিকে ‘গেম’ বা ‘রংবাজ’ আর অন্য দিকে ‘অটোগ্রাফ’ বা ‘মাছ মিষ্টি মোর’-এর মাঝামাঝি একটা ধারণা নিজেদের জন্য তৈরি করতে পেরেছেন।

আবার এই কৃতিত্বটাই তাঁদের আংশিক দুর্বলতাও বটে। এক মঝ্ঝিম পন্থা নিতে গিয়ে তাঁদের ছবিগুলোও অনেক সময় মঝ্ঝিম অর্থাত্‌ মধ্যম মানের থেকে যায়। তাতে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি হয়তো ভরে, কিন্তু মা সরস্বতী সব সময় মন খুলে খুশি হতে পারেন না। একটু সেন্টিমেন্টাল, একটু ফ্ল্যাট। একটু নীতিবাগীশও। পরিচালকের মেসেজ এইটে ঠিক আর এইটে ভুল খুব দাগিয়ে দিয়ে বলা।

এই লক্ষণগুলো রামধনুতে নেই, এমন বলছি না। গ্রামের রাস্তায় ঢোকা মাত্র নেপথ্যে লোকসঙ্গীত বেজে উঠেছে। মেমসাহেবের মুখ দিয়ে বাংলা ভাষার জয়গান বেরিয়ে পড়েছে। গ্রাম মানেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গোছের একটা স্টিরিওটাইপ ফের জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু এই মেদটুকু বাদ দিলে রামধনু ছবিটা যথেষ্ট উপভোগ্য এবং হৃদয়গ্রাহী। তার প্রধান উপাদান তিনটে। গোছানো চিত্রনাট্য, সুলিখিত সংলাপ এবং জোরালো অভিনয়।

গার্গী রায়চৌধুরীর কামব্যাক বলা হচ্ছে এই ছবিকে! কিন্তু এত বড় চরিত্র গার্গী এর আগে বড় পর্দায় করেছেন কি? অথচ কেন যে করেননি! ছবি দেখতে দেখতে বারবার এই প্রশ্নটা মনে আসতে বাধ্য! টেনশন-হতাশা-বিরক্তি-ভয়-স্নেহ-জেদ এমন কোনও অভিব্যক্তি নেই যেখানে গার্গী মুগ্ধ করেননি। তাঁর চরিত্রটার মধ্যে পাগলামি আছে, হুজুগ আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে আছে অসহায়তা, দুশ্চিন্তা। সেই কারণেই দর্শক হিসেবে তাঁর সঙ্গে একাত্ম না হয়ে পারা যায় না। চুলের ক্লিপ থেকে পায়ের চটি পর্যন্ত তাঁকে এখানে গোগোলের মা ছাড়া অন্য কিচ্ছুটি ভাবা সম্ভব নয়।

গার্গীর মতো উন্মুক্ত বিচরণক্ষেত্র রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় পাননি। কারণ তাঁর চরিত্রটা শিক্ষিকার। যিনি গোগোলের মতো বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের বাবা-মায়েদেরও গ্রুম করেন। ইন্টারভিউ বৈতরণী পার হওয়ার প্রশিক্ষণ দেন। ফলে স্বভাবতই পেশাদারিত্বের মোড়কে ঘেরা থাকতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেই পেশাদারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, টান টান শাড়ি, একই সঙ্গে অভয় দেওয়া এবং সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়া হাসি, পরিমিত বাচন রচনাকেও ‘মালবিকা ম্যাডাম’ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা শক্ত। বাঙালির এই ‘দিদি’কে এর আগে ভিন্‌ধারার ছবিতে সে ভাবে দেখা যায়নি। এ বার যদি রচনারও দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়, সেটা দর্শকদের জন্য সত্যিই ভাল খবর হবে।

ছবির পার্শ্বচরিত্রগুলোর মধ্যে যথারীতি মাতিয়ে দেন খরাজ। এ ছবিতে তিনি ইউনিফর্ম-ব্যাপারি সিংঘানিয়া। পিছনের দরজা দিয়ে অ্যাডমিশন করানোয় তাঁর বিশেষ ব্যুত্‌পত্তি। সাশা ঘোষালকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে হিসেবে চেনেন সকলে। এ ছবিতে তিনি মিতালির এমআইটি-ফেরত দাদা। সাশা বলেই বোধহয় তাঁকে দিয়ে একখানি গান গাওয়ানো হয়েছে। সেটার কোনও প্রয়োজন ছিল না।

তা বাদেও এটি ছবির দুর্বলতম চরিত্র। সেটা সংলাপলেখক শিবপ্রসাদের দোষ। শিবপ্রসাদ আগাপাস্তলা বেশ ভাল সংলাপ লিখেছেন। সাশার বেলায় কী হল কে জানে! চরিত্রটি বিদেশ থেকে ফোন করেছে বোনকে! সে এত দিন কোথায় কোথায় ছিল, তার লম্বা ফিরিস্তি দেবে কেন? অত্যন্ত কৃত্রিম লাগে এই নেমড্রপিং! তার পর ধরুন, তাকে আলাদা করে খুব ট্যাঁশ বলে দেখানো হয়নি! অথচ সে লাল্টুকে সহসা “হোয়াটস আপ, ডুড” বলে হেঁকে ওঠে! কেন?

যাক গে, হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় না! শিবপ্রসাদের এই গলদটুকু অনায়াসে মাফ করে দেওয়া যায় লাল্টু দত্তের মুখ চেয়ে। নাদুসনুদুস দোকানি, নিতান্ত গোবেচারা মানুষটি। শিবপ্রসাদের অভিনয়ে যে একটা অনিল চাটুজ্জীয় ভঙ্গি আছে, সেটা এই চরিত্রে দারুণ খাপ খেয়ে গিয়েছে। লাল্টু দত্ত গোটা ছবি জুড়ে কমিক উপাদান জুগিয়ে গিয়েছে, অথচ তার কারুণ্যটুকু হারায়নি। এখানেই লাল্টু দত্ত সার্থক, শিবপ্রসাদ সার্থক।

সবচেয়ে বেশি সার্থক রামধনু!

ramdhanu review jagori bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy