Advertisement
E-Paper

সুখের চেয়ে স্বস্তি

ছেলেবেলায় মাঝে মাঝেই প্রবীণ-প্রবীণাদের বলতে শুনতাম, ‘যে সয় সে রয়।’ বয়স যত দিন কম থাকে, লড়ে যাওয়ার তাগিদ থাকে, কারণ তাগদও থাকে। যৌবন এক দিন শেষ হয়, ফুরোতে থাকে যৌবনের তাগদ। কোনও কিছু পছন্দ না হলে বেঁকে বসার ক্ষমতাটা যেন শরীর থেকেই চলে যায়। মধ্যবয়সে এসে পড়লে মানুষ সাধারণত দেখতে পায় দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে। খরচ যাচ্ছে বেড়ে। ঝুঁকি নেওয়ার সেই পুরনো দম আর কোথায়। কর্মস্থলে উত্তমর্ণের তিরস্কার আর অ্যাঁকাব্যাঁকা কথা গিলে ফেলা ছাড়া আর গতি নেই।

কবীর সুমন

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৩
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ছেলেবেলায় মাঝে মাঝেই প্রবীণ-প্রবীণাদের বলতে শুনতাম, ‘যে সয় সে রয়।’ বয়স যত দিন কম থাকে, লড়ে যাওয়ার তাগিদ থাকে, কারণ তাগদও থাকে। যৌবন এক দিন শেষ হয়, ফুরোতে থাকে যৌবনের তাগদ। কোনও কিছু পছন্দ না হলে বেঁকে বসার ক্ষমতাটা যেন শরীর থেকেই চলে যায়। মধ্যবয়সে এসে পড়লে মানুষ সাধারণত দেখতে পায় দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে। খরচ যাচ্ছে বেড়ে। ঝুঁকি নেওয়ার সেই পুরনো দম আর কোথায়। কর্মস্থলে উত্তমর্ণের তিরস্কার আর অ্যাঁকাব্যাঁকা কথা গিলে ফেলা ছাড়া আর গতি নেই। বেঁচে থাকতে, চাকরিতে বা ব্যবসায় টিকে থাকতে গেলে সহ্য করতেই হবে। কতকটা রাজনীতিতে ঢোকার মতো। ভোটে যদি দাঁড়াতে হয় কোনও পার্টির টিকিট লাগবেই। স্রেফ নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়ালে এক ধরনের বীরত্ব প্রকাশ পায় বটে কিন্তু জমানত জব্দ হওয়ার আশঙ্কাটাও থাকে। পার্টির টিকিট পেতে হলে ‘যে সয় সে পায়।’ পার্টির নেতাদের হম্বিতম্বি ও জ্ঞান সইতে হবে। শিকেয় তুলতে হবে আত্মমর্যাদা।

ব্রেশ্ট এক জায়গায় লিখেছিলেন— সাধারণ লোকদের দিকে চেয়ে দেখো, কত কৌশল করে তারা বেঁচে আছে। সাধারণ মধ্যবিত্তকেও বেঁচে থাকতে হয় কৌশল করেই। সয়ে সয়ে। এই সয়ে-সয়ে থাকার মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি আছে। গায়ের চামড়াটা একটু পুরু করে ফেলতে পারলেই স্বস্তি। অন্যের আক্রমণাত্মক বা বিষাক্ত কথায় যদি মনের মধ্যে সমানে বাজতে থাকে ‘ইচ্ছে করে সব ব্যাটাদের গোঁফ ধ’রে খুব নাচি’ আর ঋষি সুকুমার রায়ের কথাটা যদি এক বার অন্তত সত্যি করে দিতে চাই তো তাতে ধকল আছে, ঝুঁকি আছে, কারণ গোঁফ যে আছে আমারও। প্রতিপক্ষের মনেও তো একই ইচ্ছে জাগতে পারে। কাজেই, চেপে যাওয়া ভাল। স্বস্তি।

তেমনই, মাটির কলসিতে জল কী সুন্দর ঠান্ডা থাকত। আর এ-বেলার রান্না বড়জোর ও-বেলা পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। একটু মাথা খাটিয়ে এক-থালা জলে পাত্রটা বসিয়ে রাখলেই হয়। তা না, রেফ্রিজারেটর কেনা। কেন? গরম কালে ঠান্ডা জলে একটু শরবত খেয়ে সুখ পাওয়া যাবে। এ-বেলা রান্না করে দিন-দুই কি তারও বেশি রেখে দেওয়া যাবে, নষ্ট হবে না। এই ভাবে সেই ষাটের দশকে ছোট্টখাট্টো হিমালাক্স এসেছিল দুই-কামরার বাসায়। দিদার তাতে আপত্তি। বলিহারি যাই বউমা, সংসার যেন আমরা করিনি। কী এমন সুখ পাবে। মাটির কলসির জলে একরত্তি কর্পূর, একটুখানি ক্যাওড়া ফেলে দিলে জল খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। স্বস্তি। আর বাসি রান্না। তিন দিনের বাসি রান্না নিজে খেতে চাও খাও। কিন্তু ছেলেদের খাওয়াবে, স্বামীকে খাওয়াবে, এ কেমন সুখ? কী বললে? মাঝে মাঝে আইসক্রিম বানাবে? আমরা বুঝি ছেলেমেয়ে মানুষ করিনি? ওই সব ছাইপাঁশ না খেয়েও তো মানুষ হয়েছে দিব্যি। দেখো কী হয়। ঠান্ডা মেশিন ছিল না, স্বস্তি ছিল। সুখ করতে গিয়ে এ বার স্বস্তিটা যাবে। আসলে কী জানো, এই যে তুমি চাকরিটা নিলে— এখানেই সব গেল। স্বামীর মাইনেতে চলছিল তো বেশ। খোকারও (আমার বাবা) আক্কেল বলিহারি। সমাজটা রসাতলে যাচ্ছে এই ভাবে। কী? তুমি এরোপ্লেন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছ, সকলকে নিয়ে এ বারে বিনা পয়সার টিকিটে দেশ ঘোরার সুখ পাবে? কেন? ট্রেনে চাপলে কি জাত যায়? আমরা তো জীবনে প্লেনে চড়িনি। তাই বলে কি কাশী যাইনি তোমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে? কী স্বস্তিটাই না ছিল। এখন তুমি আমার ছেলে আর নাতিদের কত বড় একটা বিপদের সামনে ঠেলে দিতে চলেছ এক বার ভাবো। যে জিনিসটা মাটিতে চলে না, আকাশে চলে... যে কোনও সময়ে দড়াম করে আছড়ে পড়বে। তোমাদের প্লেনে চেপে দেশ ঘোরার সুখের নিকুচি করেছে। ট্রেনে চেপে বাসে চেপে যাওয়ার স্বস্তিটাই চুলোয় গেল। তোমরা ভুলে গেছ— সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।

ঘরের ছেলে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকো। এমন একটা চাকরি জোগাড় করো যাতে বাসার মোটামুটি কাছে হয়। এখানে ভাল কাজ নেই, মাইনে কম। জীবনটা যে একটু চেখে দেখব, ভাল টাকা কামাব, এখানে থাকলে তা হবে না। বাইরে যেতে হবে। কিন্তু বাইরে যাওয়া মানেই নিজে হাতে অনেক কিছু করা। তার চেয়েও যা বড় কথা— অন্য একটা ভাষা শেখার বাধ্যবাধকতা। তার মধ্যেও হয়তো সুখ আছে। কত নতুন মানুষকে জানা, তাদের বই পড়া, কাগজ পড়া, নাটক দেখা। কিন্তু ঝুঁকিটা? ভাল করে শিখতে কত দিন লাগবে কে জানে। তার আগে কথা বলতে গেলে লোকে যদি হাসাহাসি করে? কী বলতে কী বলে ফেলব। আমাদের এই মোদের-গরব-মোদের-আশার দেশে থাকতে পারলে ওই ধরনের ঝুঁকি নেই। পছন্দসই কাজ পাচ্ছি না, মাইনে ভাল না, তাতে কী? স্বস্তি তো আছে। এটা ঠিক যে হাতে টাকা থাকলে শপিং মল-এ ঘুরে বেড়িয়ে জেল্লাদার সব দোকানের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতে হত না। আইপ্যাড না হোক ছোটখাটো একটা ট্যাব কমসে কম। এখানকার মাইনেয় হবে না। কিন্তু বাইরে যাব না তা বলে। চেনা জায়গায় আছি। আজন্মের চেনা ভাষায় কথা বলছি। আর কথাই তো সব। খোকনের দোকানে চা খেতে খেতে, পাড়ায় নতুন খোলা কায়দার কফির দোকানে যে তরুণ-তরুণীরা খদ্দের তাদের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরার যে স্বস্তি, সুখের চেয়ে তা ঢের ভাল। ট্যাবের কল্পনায় ঘুম আসবেই আসবে। আধ ঘণ্টা নাহয় একটু কষ্টই পেলাম।

kabir suman bangali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy