ছিলেন সুন্দরবনের আতঙ্ক! বনকর্মী আর দুঁদে পুলিশ অফিসারদের নিশানার মধ্যমণি। তাঁর টিকির দেখা পাওয়াও সহজ ছিল না। হবে না ই বা কেন! তাঁর কাছে তো জঙ্গলটা হাতের তালুর মতোই পরিচিত। বনবিভাগের কর্মীরা ক্রমাগত ব্যর্থ চেষ্টার পর তাঁর হদিশ পাওয়ার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। না পারছিল পুলিশও তাঁকে ধরতে।
হঠাৎ একদিন ফরেস্ট অফিসার-ইন-চার্জের ঘরের বাইরে হাজির মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ। নিজেই পরিচয় দিলেন। বললেন, আপনারা আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তো? আমিই সেই অনিল মিস্ত্রি। শুনে তো ফরেস্ট অফিসারের ভিরমি খেয়ে যাওয়ার জোগাড়। বিশ্বাস করাই শক্ত যে, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং অনিল মিস্ত্রি। সুন্দরবনের ত্রাস। এলাকার সবথেকে ভয়ঙ্কর চোরা শিকারি।
চমকের তখনও শেষ হয়নি। এর পর অনিল যে কথাগুলো বললেন, তাতে প্রায় চেয়ার থেকে উল্টেই পড়ে যাচ্ছিলেন অফিসার। “আমাকে কোনও দিন ধরতে পারতেন না, স্যর। আপনারা কবে-কখন-কোথায় আমাকে ধরার তোড়জোড় করতেন, সব আমি আগেই জেনে যেতাম,” বলছিলেন অনিল। সঙ্গে যোগ করলেন, “কালকেও আমি একটা হরিণ মেরেছি। সেই হরিণের বাচ্চাটা মৃত মায়ের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছিল।” অনিল সেই দৃশ্য দেখে গভীর আত্মশোচনায় পড়ে যান। তাঁর মতো কঠোর চোরাশিকারির চোখও জলে ভরে উঠেছিল। অনিল শুধু বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন বললে অর্ধেকটা বলা হবে। আর সেখানে দাঁড়াতে পারেননি। বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। পরের দিন সকালেই সোজা বন দফতর। আত্মসমর্পণ। আর কোনও দিন চোরাশিকার না-করার অঙ্গীকার।
শিকার সামনে এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার প্রশ্নই নেই। সুন্দরবনের আনাচে-কানাচে একচ্ছত্র দাপিয়ে বেড়ানো ‘পোচার’ অনিলের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে তিরবিদ্ধ হরিণীর মৃত্যু হওয়ারই ছিল। যেটা হওয়ার ছিল না, যেটা শুধু সিনেমাতেই হয়, সেটাই ঘটে যায় পরের দৃশ্যে। যখন অনিল আবিষ্কার করেন মৃত হরিণীর পাশেই তার শাবকটিকে, চেষ্টা করছে মৃতপ্রায় মায়ের দুধ খাওয়ার।
এর পর বিবেকের টানাপড়েনে কাটানো ঘুমহীন রাত... পোচিং চিরতরে পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত।
গল্পের মতো শোনাচ্ছে? কিন্তু গল্প হলেও সত্যি। এবং গল্পের শেষে শুধু আত্মসমর্পণেই নয়, বিবেকের তাড়নায় আইনের কাছে নতজানু হওয়ার নজির অনেক আছে অপরাধ জগতে। কিন্তু অনিল মিস্ত্রির প্রায়শ্চিত্তের কাহিনি আরও চমকপ্রদ। আরও রুদ্ধশ্বাস। ছাড়া পাওয়ার পর পোচিং-বিরোধী আন্দোলনে বাকি জীবনটা বন্ধক রাখার জন্যই অনিলকৃষ্ণ মিস্ত্রির গল্প রূপকথার থেকেও মায়াবী। থ্রিলারের থেকেও গা-ছমছমে। দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকিতে উত্তরণের আধুনিক চালচিত্র।
আসুন, আলাপ করিয়ে দিই মানুষটার সঙ্গে, যাঁর অত্যাশ্চর্য কর্মকাণ্ডের কথা পরিচিত কয়েক জনের মুখে শুনে সশরীরে চাক্ষুষ করতে শহর ছেড়ে সপ্তাহান্তে সুন্দরবনের বালিদ্বীপে পাড়ি দেওয়া। গাড়িতে গদখালি, তার পর বোটে ঘণ্টাখানেক। আগে জানিয়ে রাখা ছিল অনিলকে। বালিদ্বীপে নেমে কিছুটা এগোতেই পেটানো চেহারার মাঝবয়সি লোকটি মৃদু হেসে নমস্কার করে বললেন, “আমি অনিল মিস্ত্রি।” তাঁকে প্রথম দেখায় বাঙালি বলে ধরে নেওয়া কঠিন। মুখেচোখে একটা পাথুরে রুক্ষতা অবাঙালি-সুলভ। আর ওই রুক্ষতার মধ্যেই শান্ত দু’টো চোখ আর শিশুসুলভ হাসি। একটা বন্য সৌন্দর্যের আস্তরণ বুলিয়ে দিয়েছে যেন। গলায় নেক কলার। খুব নিচুস্বরে কথা বলার মধ্যে যেন একটা দারুণ শান্ত ভাব। অনিলের পাশে হাঁটতে হাঁটতে খটকা লাগে মনে। এই লোকটা? এই নম্র ভদ্র লোকটা এক সময় বালিদ্বীপের বীরাপ্পান হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল বছরের পর বছর। বেআইনি পশুশিকারের রাজ্যপাট কায়েম করে ঘুম কেড়ে নিয়েছিল বন দফতরের? পরের আটচল্লিশ ঘণ্টায় সুন্দরবন সফরে অনিলের সঙ্গে, “‘অনিলবাবু’ থেকে অনিলদা-য় নেমে আসা অনায়াসে। আর সাক্ষী থাকা অপরাধের অতল থেকে সমাজসেবার শৃঙ্গে ওঠার রোড ম্যাপের।
হরিণী হত্যার পর অসহায় শাবককে দেখে চিত্তশুদ্ধির যে কাহিনি দিয়ে এই লেখার শুরু, সেই ঘটনা প্রায় বছর কুড়ি আগের। আর আজ? বছর কুড়ি পরে? সে দিনের মায়াদয়াহীন ‘পোচার’ অনিল আজ ওয়াইল্ড প্রোটেকশন সোসাইটি অব ইন্ডিয়া (ডব্লুপিএসআই)র সক্রিয়তম সদস্যদের একজন। যে সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বিশ্বখ্যাত ‘ওয়াইল্ড লাইফ কনর্জাভেশন’ বিশেষজ্ঞ বেলিন্ডা রাইট স্বয়ং। বেলিন্ডা ম্যাডামের নামে অজ্ঞান অনিল। গলায় ঝরে পড়ে দৃপ্ত প্রত্যায় যখন কথায় কথায় বলে ওঠেন, “আমরা পোচিং করতাম বাবা-দাদাদের দেখে। কত বার যে হিংস্র জানোয়ারের হাতে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছি। ন্যায়-অন্যায়ের কোনও বোধই ছিল না। আজ বুক ঠুকে বলতে পারি বালিদ্বীপে কোথাও পোচিং হয় না।”
কিন্তু কী ভাবে?
বিকল্প রোজগারের বাস্তবসম্মত উপায় না থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম তো দিক্ভ্রষ্ট হতে বাধ্য। সেটা আটকাবেন কী করে? অনিল একটু হাসেন আর বলতে শুরু করেন গত দু’ দশকের নিরলস লড়াইয়ের কথা। একটু একটু করে জানতে পারি এই অঞ্চলে পশুশিকারের চিরাচরিত বেপথ থেকে উঠতি যুবকদের জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে কী ভাবে চাষবাস এবং কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন অনিল। কী ভাবে এলাকার মহিলাদের জন্য নানাবিধ আয়-উপযোগী গেরস্থালি শিক্ষার আয়োজন করেছেন সযত্নে। কী ভাবে ডব্লুপিএসআইয়ের অধীনে বাচ্চাদের জন্য চালু করেছেন স্কুল। আর পরম প্রশ্রয়ে লালন করে চলেছেন একটাই স্বপ্ন।.... শুধু বালিদ্বীপ নয়, গোটা সুন্দরবনকে পোচিং মুক্ত করা। ভাল কাজ কখনও চাপা থাকে না। যত প্রসারিত হয়েছে কর্মকাণ্ড, পেয়েছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং শুভানুধ্যায়ীদের আনুকূল্য। পাড়ি দিয়েছেন ভিন্দেশে একাধিক বার। মার্কিন মুলুকের মায়ামি থেকে আর্জেন্টিনা.... পোচিং-বিরোধী আন্দোলনে বিদেশ গিয়েছেন বহু বার। আমি কর্মসূত্রে মায়ামিতে থাকি শুনে চোখে সামান্য বাড়তি ঝিলিক। বললাম, “পরে যখন আসবেন, আমার বাড়িতে থাকতে হবে অনিলদা।” অনিল মিস্ত্রি উত্তরে কিছু বললেন না। শুধু হাসেন। বড় প্রাণছোঁয়া সে হাসি।
জীবনের স্মরণীয় দিন কোনটা জিজ্ঞেস করতেই আবার সেই হাসি। “যে দিন আর্জেন্টিনায় একটা সেমিনারে পাঁচ হাজার লোকের সামনে কোট-টাই পরে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম। হাততালি জানেন থামছিলই না।” জিজ্ঞেস করি, “ভয় করেনি বিদেশ-বিভুঁইয়ে এত লোকের সামনে?” অনিল এ বার হাসেন না। একটু চুপ থেকে মর্মভেদী দৃষ্টিতে তাকান আমার দিকে। ঠোঁট থেকে ছিটকে বেরোয় ছ’টা শব্দ, “ভয় আমার কোনও কিছুতেই করে না।” আমি কথা বাড়াই না আর। কখনও কখনও কথা বলতে নেই!
বোটে সুন্দরবন। সফর চলছে অনিলদার সঙ্গে। কোথায় কী ভাবে শিকার করতেন, ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন সোৎসাহে। জিজ্ঞেস না করে পারি না, “আচ্ছা, হাতের তালুর থেকেও তো ভাল চেনেন দেখছি সুন্দরবনকে। এটা হল কী করে?” সটান উত্তর আসে, “আপনি যেমন মায়ামির রাস্তাঘাট ভাল চেনেন, তেমনই চিনি আমি সুন্দরবনকে।” আমি আবার চুপ। ওই যে লিখলাম, সব কথার উত্তর হয় না। এমনিতে নির্মোহ, আপাত-রুক্ষ মানুষটাকে আবেগতাড়িত লাগে এক বারই, যখন বলেন ক্যানিংয়ে থাকা পরিবারের কথা। স্ত্রী আশালতা, যাঁর কোনও অভিযোগ নেই অনিল সংসারে সময় দিতে পারেন না বলে। দুই ছেলে এবং এক পালিত পুত্র। সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন তাঁদের পালিত পুত্রের বাবা-মা। বড় ছেলে কলেজে পড়ছে। আঁকার হাত খাসা। অসুস্থ বাবা যখন মৃত্যুশয্যায়, অনিলের তখন আর্জেন্টিনা যাওয়ার কথা। অনিল যেতে চাননি। বাবা বলেছিলেন, “যা...তুই অনেক বড় কাজে যাচ্ছিস।” কথাগুলো বলার সময় প্রথম, এই প্রথম উদাস লাগে অনিলদাকে। ঝটিকা সফর শেষ।
গ্রাম ছেড়ে, জঙ্গল ছেড়ে এ বার ফের শহরের পথে। সকাল সাড়ে ছ’টায় রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখি, অনিলদা পুকুরপাড়ে বসে অপেক্ষা করছেন। “আরে, তুমি অনেকক্ষণ এসেছ নাকি?” নিচু গলায় উত্তর আসে, “আমি রোজ ভোর চারটের সময় উঠে এই পুকুরপাড়ে বসে থাকি ঘণ্টা দু’য়েক। ভাবি আরও কত কী করার আছে। চলুন, বোট রেডি।” ফিরছি। ‘বালিদ্বীপের বাল্মীকি’ অনিল মিস্ত্রি ঘাট থেকে হাত নাড়ছেন।
বোট গতি বাড়াচ্ছে। আর অনিলদাকে দেখা যাচ্ছে না। মুখ ফিরিয়ে নিই।
বোটে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম সেই সব কথাবার্তা। কত অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিল, এক অসামান্য মানবিক যাত্রা।
এই না হলে জীবন!
ভাবছি এই মানুষটাকে নিয়ে একটা সিনেমা পরিচালনা করলে কেমন হয়? নাম দেব, ‘দ্য পোচার’।