Advertisement
E-Paper

পুরনো দিনের জলখাবার খই মোটেই হেলাফেলার নয়! পুষ্টিতে টক্কর দিতে পারে কর্নফ্লেক্স, ওট্‌সকেও

প্রাতরাশে খই খাওয়ার চল বহু পুরনো। এক সময়ে বাংলার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তো বটেই, উচ্চবিত্তদের ঘরেও সকালে খই দুধ বা খই-দই খাওয়ার চল ছিল।

ছবি: শাটারস্টক।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫৮
Share
Save

কথায় বলে ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’! মতান্তরে ‘খই বাছ’ও বলেন কেউ কেউ। কথাচ্ছলে কাজটিকে খানিক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে বলে মনে হলেও কাজ দু’টির একটিও হেলাফেলার নয়। ধান থেকে বালিতে খই ভাজা এবং ভাজার পরে তা থেকে ধানের খোসা বাছতে ধৈর্য লাগে। আর সেই দুই কাজ শেষে যে খই তৈরি হয়, সেই খাবারটিও ইদানীং নতুন করে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে স্বাস্থ্যসচেতনদের মধ্যে।

সাম্প্রতিক সময়ে পুষ্টিবিদেরা তারকাদের নিয়ম-মানা খাদ্যতালিকায় প্রাতরাশে খই খাওয়ার নিদান দিচ্ছেন। ফলে গ্রামবাংলার আটপৌরে খই জোর টক্কর দিচ্ছে শপিং মলে পাওয়া ঝকঝকে প্যাকিংয়ের স্বাস্থ্যকর ব্রেকফাস্ট সেরেলকে। কিন্তু খই কি এতটাই গুণী? তা-ই যদি হবে, তবে প্রাতরাশ হিসাবে খইয়ের কথা মানুষ ভুলতে বসেছিল কেন! পুষ্টিবিদ অনন্যা ভৌমিক বলছেন, ‘‘সেটা পশ্চিমি সংস্কৃতিকে অন্ধ ভাবে অনুসরণের জন্যও হতে পারে। খই কিন্তু বরাবরই উপকারী। তার গুণে নতুন করে কোনও সংযোজন হয়নি।’’

পুরনোয় নতুন করে ফেরা

খইকে পুজো-পার্বণের খাবার হিসাবেই দেখা হয় সাধারণত। বাঙালির বিয়েতে অগ্নিসাক্ষী রেখে খই পোড়ানোর চল আছে। খই সরস্বতী পুজোর দধিকর্মা প্রসাদেও দেওয়া হয়। আবার বাঙালিদের প্রাতরাশে খই খাওয়ার চলও বহু পুরনো। এক সময় বাংলার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তো বটেই, উচ্চবিত্তদের ঘরেও সকালে খই দুধ বা খই-দই খাওয়ার চল ছিল। বয়স্কেরা তো খেতেনই, ১০টা-৫টার কাজ করা সরকারি দফতরের বাবুরা যাঁরা মধ্যাহ্নে বাড়ি ফিরে ‘টিফিন’ করার সুযোগ পেতেন, তাঁদের অনেকেই খই-দই-কলা খেয়ে অফিস যেতেন। চিঁড়ে-গুড়-খই মেখে সুস্বাদু জলখাবারও খাওয়া হত বাঙালি পরিবারে। আসলে খই খাওয়ার সুবিধা এই ছিল যে, সেটি সহজে পাওয়া যায়, সহজে খাওয়া যায় এবং খাবার হিসাবেও হালকা। পেটের রোগের ভয় পাওয়া, হজম নিয়ে চিন্তিত বাঙালিরা নিশ্চিন্তে সেই খই খেতেও পারতেন। অনন্যা বলছেন, ‘‘আমি যে প্রাতরাশে খই খাওয়ার পরামর্শ দিই, তার একটা বড় কারণও কিন্তু ওটাই। খই হজম করতে কোনও সমস্যা হয় না।’’

পুষ্টিবিদ শ্রেয়া চক্রবর্তীও প্রাতরাশের খাবার হিসাবে খই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি বলছেন, ‘‘যাঁদের আইবিএস রয়েছে বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকে, তাঁদের আমি খই খেতে বলি। কারণ খই গ্লুটেন মুক্ত। তবে শুধু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। খই অনেক সহজে পাওয়াও যায়। দামি খাবার নয়।। আর তা ছাড়া অনেকেই দেখি বলেন তাঁদের ওটস খেতে ভাল লাগে না। তাঁদেরকে আমি খই খেতে বলি।’’

খই কি এতটাই গুণী? তা-ই যদি হবে, তবে প্রাতরাশ হিসাবে খইয়ের কথা মানুষ ভুলতে বসেছিল কেন!

খই কি এতটাই গুণী? তা-ই যদি হবে, তবে প্রাতরাশ হিসাবে খইয়ের কথা মানুষ ভুলতে বসেছিল কেন! ছবি: সংগৃহীত।

কী বলছেন পুষ্টিবিদ?

খই খাওয়া যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই পুষ্টিবিদ অনন্যার। তিনি এ-ও জানাচ্ছেন যে, খইয়ে এমন কিছু উপাদান আছে, যা বিপাকতন্ত্রের স্বাস্থ্যকেও ভাল রাখে। পুষ্টিবিদ বলছেন, ‘‘দিনের শুরুতে যদি এমন একটি খাবার খাওয়া যায়, তবে সারা দিনের খাবার খাওয়া এবং হজম করার সমস্যা অনেকখানি সামলানো যায় বলে মনে করি আমি। তা ছাড়া খই খেলে জিআই-ও ঠিক থাকে।’’

গোটা দুনিয়া এখন চিন্তায় পড়েছে ‘সুগার স্পাইক’ নিয়ে। কোন খাবার খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা ঝট করে অনেকটা বেড়ে যেতে পারে, তার সঙ্গে কোন খাবার খেলে ততটা শর্করা বাড়বে না্‌ সেই হিসাব নিরন্তর বুঝিয়ে চলেছেন সমাজমাধ্যম প্রভাবীরা। সেই সূত্র ধরেই জিআই বা গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের কথাও অল্পবিস্তর সবার জানা। জিআই হল সেই জিনিস, যা খাবারে কম থাকলে তা দ্রুত রক্তে শর্করা বৃদ্ধি করে না। শুধু তা-ই নয়, সারা দিনের খাবারে নিয়মিত অতিরিক্ত জিআই থাকলে তা থেকে হৃদ্‌রোগ, ডায়াবিটিস এবং ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ে বলে জানাচ্ছে বহু গবেষণা।

ইন্টারনেটে স্বাস্থ্যসচেতনদের অনেকেই কোন খাবারে জিআই কম, সেই তথ্য জেনে খাবার খান। তৈরি করেন খাদ্যতালিকা। খই সেই কম জিআই থাকা খাবারগুলির মধ্যে একটি। শ্রেয়া বলছেন, ‘‘খইয়ে জিআই কম। আমি তো ডায়াবিটিসের রোগীদেরও খই খেতে বলি। কেউ বলতেই পারেন খইয়ে শর্করা আছে। কিন্তু শর্করা মানেই যে খারাপ তা তো নয়। শর্করাও শরীরে প্রয়োজনীয়। বরং ডায়াবিটিসের রোগীরা যা খাচ্ছেন, তা যদি তাঁদের ভাল না লাগে তাতেও সমস্যা হতে পারে।’’

খইয়ের শর্করা প্রসঙ্গে পুষ্টিবিদ অনন্যা বলছেন, ‘‘খই যে হেতু হালকা, অল্প ওজনেই অনেকখানি হয়। তাই খই খেলে শর্করাও কমই খাওয়া হবে। তা ছাড়া খই এমন একটি খাবার, যেটির ক্যালোরি কম, ফ্যাট কম, অথচ পেটও ভরে থাকে। আমার কাছে যাঁরা ওজন ঝরানোর জন্য খাদ্যতালিকা তৈরি করে দিতে বলেন, তাঁদের আমি বলি, সকালে চায়ের সঙ্গে একটি বিস্কুট খাওয়ার বদলে এক মুঠো খই খান। সেটা অনেক বেশি উপকারী।’’

 চিঁড়ে-গুড়-খই মেখে সুস্বাদু জলখাবারও খাওয়া হত বাঙালি পরিবারে।

চিঁড়ে-গুড়-খই মেখে সুস্বাদু জলখাবারও খাওয়া হত বাঙালি পরিবারে। ছবি: সংগৃহীত।

গবেষণা কী বলছে?

ভারত সরকারের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দফতর, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা সংস্থা সিজিআইএআর-এর আর্থিক সহযোগিতায় খই নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। সেই গবেষণার ফলও বলছে, খইয়ের উপকারিতা অনেক। বিশেষ করে প্রাতরাশের খাবার হিসাবে তা নানা দিক থেকে উপযুক্ত।

কী কী রয়েছে খইয়ে?

১। বায়োঅ্যাক্টিভস: গবেষণায় বলা হয়েছে, খইয়ে রয়েছে শরীরের জন্য জরুরি নানা বায়োঅ্যাক্টিভ। যা ক্যানসার, হৃদরোগ এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমিয়ে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষকেরা।

২। আয়রন: খইয়ে আয়রনও আছে, যা ভাতের থেকেও পরিমাণে অনেক বেশি। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ধান বালিতে ভেজে খই বানানোর প্রক্রিয়ায় আয়রন অনেকটা বেড়ে যায়।

৩। খনিজ: পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ়, কপার, জ়িঙ্ক, সেলেনিয়ামের মতো খনিজও রয়েছে খইয়ে।

৪। প্রোটিন: ১০০ গ্রাম খইয়ে ১০ গ্রামের আশপাশে প্রোটিনও থাকে বলে জানাচ্ছে ওই গবেষণা।

৫। শর্করা: ধান থেকে খই বানানোর সময় শর্করার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও কিছুটা অন্তত কমে। ১০০ গ্রাম খইয়ে রয়েছে ৭০ গ্রাম শর্করা। দুই পুষ্টিবিদই বলছেন, খইয়ের ওই শর্করাকে দেখে অযথা ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বরং খইয়ের শর্করাটুকু শরীরের দৈনিক শর্করার যে চাহিদার যোগান হিসাবে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর। একই সঙ্গে অবশ্য শ্রেয়া এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘কোনও কিছুই বেশি খাওয়া ভাল নয়। তাই খই ভাল ভেবে রোজ অনেক খেয়ে ফেলার দরকার নেই। মেপে খান।’’

৬। ফাইবার: খইয়ে ফাইবারও রয়েছে। পুষ্টিবিদ বলছেন, ‘‘খইয়ে ফাইবার ওট্‌স বা ডালিয়ার তুলনায় কম হলেও খই হজমে সহায়ক। ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও উপকারী।’’

 যে ধরনের পুষ্টিকর খাবারের খোঁজ করছেন স্বাস্থ্যসচেতনেরা, খইয়ের সেই চাহিদা পূরণের ক্ষমতা আছে।

যে ধরনের পুষ্টিকর খাবারের খোঁজ করছেন স্বাস্থ্যসচেতনেরা, খইয়ের সেই চাহিদা পূরণের ক্ষমতা আছে। ছবি: সংগৃহীত।

৭। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস: এ ছাড়া খইয়ে রাইবোফ্ল্যাভিন, থিয়ামিন, নায়াসিন এবং প্যান্টোথেনিক অ্যাসিডের মতো বি ভিটামিন রয়েছে, আছে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি-ও। শ্রেয়া বলছেন, ‘‘খইয়ে থাকা ওই সব মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট্স আসলে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টস, যা ত্বক ভাল রাখতেও সাহায্য করে। ’’

৮। গ্লুটেন-মুক্ত: খইয়ে গ্লুটেন নেই। নানা শারীরিক কারণে অনেকেই গ্লুটেন খেতে পারেন না। তাঁদের জন্য আদর্শ খাবার হতে পারে খই, জানাচ্ছেন অনন্যা।

৯। ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া বাড়তে দেয় না: গবেষণা বলছে খই মাইক্রোবায়াল এবং প্যাথোজেন বাড়তে দেয় না। ওই ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া শরীরে নানা রোগের কারণ। সেই দিক থেকেও উপকারী খই।

উপসংহার

গবেষণায় তো বটেই, পুষ্টিবিদও খইয়ের উপকারিতায় বিশ্বাসী। বস্তুত গবেষণায় এ-ও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, স্বাস্থ্যসচেতনতা যত বাড়ছে এবং যে ধরনের পুষ্টিকর খাবারের খোঁজ করছেন স্বাস্থ্যসচেতনেরা, খইয়ের সেই চাহিদা পূরণের ক্ষমতা আছে। শুধু তা-ই নয়, খই খাবার হিসাবে নিরাপদ এবং সহজপাচ্য বলেও জানাচ্ছে গবেষণা। আর সবচেয়ে বড় কথা, এমন একটি স্বাস্থ্যকর খাবারকে প্রয়োজনমতো সুস্বাদুও বানিয়ে নেওয়া যায়।

আর কী চাই! বরং ভবিষ্যতে কেউ ‘খই ভাজা’র কথা বলে ব্যঙ্গ করলে, তাঁকে জানিয়ে দিন, খই তাঁরও কাজে লাগতে পারে।

Khoi Benefits Of Khoi Popped Rice

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}