ইঁদুরদৌড়ের এই জীবনে চাকরি, পড়াশোনা, পরিবার, দায়িত্ব— সব মিলিয়ে শরীর, মন দুই-ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দশ মিনিটের ধ্যান মনকে শান্ত করতে পারে। আবার জিম বা ব্যায়াম শরীরের ক্লান্তি কাটাতে পারে। কিন্তু ব্যস্ত জীবনে শরীর, মনের জন্য আলাদা করে সময় বার করতে পারেন না অনেকেই। সে সমস্যার সহজ সমাধান তাই চি।
মুভিং মেডিটেশন
মূলত চিনা মার্শাল আর্টস থেকে তাই চি বা তাইজিকুয়ান-এর উৎস। এক সময়ে প্রাচীন চিনে আত্মরক্ষা ও শারীরিক প্রশিক্ষণের জন্য তা ব্যবহৃত হত। ত্রয়োদশ শতক থেকেই মন ও শরীরের যত্নে, আরোগ্যচর্চার অংশ হয়ে ওঠে তাই চি। শরীর ও মনের ক্লান্তি কাটাতেও সহায়ক। তাই একে মুভিং মেডিটেশন বা চলমান ধ্যানও বলা হয়।
খুঁটিনাটি নিয়মকানুন
তাই চি-র অর্থ, শরীরের সমস্ত শক্তিকে ব্যবহার করার ভঙ্গি। ফিটনেস প্রশিক্ষক অরিজিৎ ঘোষাল বলছেন, “যেমন ধরা যাক, সামনে কোনও দেওয়াল বা ভারী আসবাব থাকলে আমরা যে শক্তি দিয়ে তাকে ঠেলব, সেই একই শক্তি, একই ভঙ্গি আমরা তাই চি চর্চার সময়ে ব্যবহার করব, তবে সামনে কোনও বস্তু না রেখেই।” তাই চি-র জন্য জরুরি শান্ত পরিবেশ আর হালকা পোশাক। ফ্ল্যাট জুতো বা খালি পায়ে তাই চি অভ্যাস করা ভাল। অ্যাডভান্স স্তরের তাই চি-র সঙ্গে বিগিনারস স্তরের নিয়মকানুনের তফাত রয়েছে। চেন, ইয়াং, উচেন, হুয়ান, সুন... নানা স্টাইলে তাই চি করা হয়। তাই চি-র ধরন, তার স্টেপ যেমন ভিন্ন ধরনের, তেমনই এর নামগুলোও কিন্তু বেশ মজার। বিগিনারস স্টেজে যেমন— গ্র্যাস্প দ্য বার্ডস টেল, সিঙ্গল হুইপ, ডাবল হুইপ, ওয়েভ হ্যান্ডস লাইক ক্লাউডস ইত্যাদি। অ্যাডভান্স স্তরে ব্রাশ নি অ্যান্ড পুশ, লোটাস কিক, স্টেপ আপ টু সেভেন স্টারস, ক্রস হ্যান্ডস ইত্যাদি।
বিগিনারস স্তরে
- শুরুর সময়ে: শরীরের দু’পাশে হাত দুটো প্রসারিত করুন। এ বার পা দুটো স্ট্রেচ করুন। শ্বাস ধরে রেখে দুই হাত বুকের সামনে তুলুন, জল তোলার ভঙ্গিমায়। কয়েক সেকেন্ড পরে ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে হাত নামিয়ে দিন। এ বার বাঁ পা সামান্য আগে নিয়ে যান। বাঁ হাত বুক থেকে সামনে বাড়ান, ডান হাত কোমরের কাছে রাখুন। মসৃণ ভাবে ডান-বাম হাত অদলবদল করুন।
- মেঘের সঙ্গে ভেসে: হাঁটু সামান্য ভেঙে স্কোয়াট পজ়িশনে দাঁড়ান। দুই হাত পাশে তুলুন। এক হাত উপরে আর এক হাত নীচে নিন। হাওয়ায় উড়ে বেড়ানোর ভঙ্গিমায় শরীরকে ধীরে ধীরে ডান-বাম দিকে নাড়ুন।
- এক পায়ের ভরে: ডান পা ভাঁজ করে শরীরের ওজন বাঁ পায়ে রাখুন। ডান হাত বুকের সামনে তুলুন। কিছুক্ষণ ভারসাম্য রাখুন, তার পরে পা বদলান।
- সবশেষে: ধীরে ধীরে দুই হাত বুকের সামনে আনুন। শ্বাস ছেড়ে হাত স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনুন। চোখ বন্ধ করে শরীর স্থির করুন।
অ্যাডভান্স স্তরে
বিগিনার্স রুটিনে ৪–৫টি মুভমেন্ট থাকে। অ্যাডভান্স স্তরে ২৪, ৪২ বা ১০৮টি ফর্ম থাকে। এই স্টেজে আর শুধু হাত-পা নাড়ানো নয়, শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকেও নজর দেওয়া হয়। হাত ও পায়ের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে শ্বাস মিলিয়ে এমন ভাবে এক্সারসাইজ় করা হয়, যেন পুরো শরীরে এনার্জি প্রবাহিত হয়।
- ব্রাশ নি অ্যান্ড পুশ: বাঁ পা সামনে বাড়ান। বাঁ হাত সামনে বাড়ানো হাঁটুর উপরে সমান্তরালে রাখুন। অন্য হাত দিয়ে সামনে ধাক্কা দিন। ডান-বাম পাল্টে একই অভ্যাস করুন।
- লোটাস কিক: এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা ঘুরিয়ে কিক করুন। কোর মাসলের ভারসাম্য ও মনোযোগ বাড়ায়।
- স্টেপ আপ টু সেভেন স্টারস: মূলত তাই চি-র প্রতিরক্ষামূলক পজ়িশন। সামনের দিকে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের ব্যবহার করা হয়।
- ক্রস হ্যান্ডস: দুই হাত বুকের সামনে এনে ক্রস করে বন্ধ করা হয়। সাধারণত তাই চি-র শেষ ভঙ্গি এটা।
কি গং প্র্যাকটিস
অনেক তাই চি ফর্মের মধ্যে কি গং প্র্যাকটিসও থাকে। কি গং-এর অর্থ শক্তির অনুশীলন, সঙ্গে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে ধ্যান করা। মানসিক চাপ কমাতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে কি গং সাহায্য করে। কি গং তাই চি অনুশীলনের মূলে কোমর ও পা। এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক শক্তি আসে কোমর থেকে, শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখে পা। মনকে স্থির রাখতে, মনোযোগ বাড়াতে অভ্যেস করা হয় উ চি।
কারা করতে পারে?
তাই চি সব বয়সের মানুষই করতে পারেন। তবে অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে শারীরিক ভারসাম্য, ফ্লেক্সিবিলিটি বেশি থাকে। ফলে তাদের তেমন দরকার পড়ে না। তুলনায় বয়স বাড়লে যখন শরীরের ভারসাম্য কমে আসে, স্টিফনেস, ব্যথা বাড়ে, তখন নিয়মিত তাই চি করলে উপকারে লাগতে পারে। রোজকার জীবনে মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। অরিজিৎ বলছেন, “অনেকের ক্ষেত্রেই এক্সারসাইজ় করার সময়ে ঠিক মতো মাসল কনট্রাকশন হয় না। এর পিছনে মূলত ফোকাস ও মনোযোগের অভাব কাজ করে। পশ্চার বদলেও একই সমস্যা যাঁদের হয়, তাঁদের তাই চি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।” দিনে ১৫-২০ মিনিট তাই চি অভ্যাস যথেষ্ট। দীর্ঘ অভ্যাসে শরীরের সহ্যক্ষমতা অনুযায়ী দিনে প্রায় ঘণ্টাখানেকও তাই চি করা যায়।
তাই চি-র উপকার
তাই চি শরীরের ভারসাম্য, নমনীয়তা বাড়ায়। আর্থ্রাইটিস, জয়েন্টের ব্যথা কমিয়ে মাংসপেশি সচল রাখে। শরীরে গড়ন ঠিক করে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ কমাতে যেমন তাই চি সহায়ক, তেমনই মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে পারে। নিয়মিত তাই চি অভ্যাসে ঘুম ভাল হয়। এটি প্রায় সকলের জন্যই নিরাপদ। তবে হাড় ভাঙা বা সার্জারির পরে যাঁরা আরোগ্যের পথে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া তাঁদের তাই চি না করাই ভাল। হার্টের সমস্যা থাকলে কিংবা মাথা ঘোরা বা ভার্টিগোর সমস্যা থাকলেও তাই চি এড়িয়ে চলা ভাল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)