পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে, সন্তান, তার বড় হয়ে ওঠা— পরিকল্পনা ছাড়া এখন কোনও কিছুই ঠিক মতো করা যায় না। গর্ভধারণ বা ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর আগেও তাই অত্যন্ত জরুরি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
পরামর্শ যেখানে জরুরি
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গর্ভধারণের সময়ে জটিলতার জেরে গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়া, সন্তানের জন্মগত সমস্যা-সহ আরও নানা সমস্যা হতে পারে। যেমন, মায়ের হাইপো থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে সন্তানের মস্তিষ্ক গঠনে সমস্যা হতে পারে। তাই গর্ভধারণের আগে কিছু বিষয় পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া জরুরি। তার মধ্যে রয়েছে, দম্পতি বা তাদের পরিবারে কারও থাইরয়েড, ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশন বা এপিলেপসির মতো রোগ রয়েছে কি না। পরীক্ষায় যদি কোনও রোগ ধরা পড়ে তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এগোতে হবে।
প্রিকনসেপশন কাউন্সেলিং এবং টেস্টিংয়ের উপরে জোর দিচ্ছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। তিনি বললেন, “সন্তানধারণের আগে মায়ের বয়স, ওজন, কোনও রকম অসুস্থতা আছে কি না, কী ওষুধ খাচ্ছেন, গর্ভস্থ সন্তানের উপরে তার প্রভাব পড়তে পারে কি না, পরিবারে কারও রোগ আছে কি না, তা দেখে নেওয়া জরুরি।” মায়ের পাইলস, ফিশচুলা জাতীয় সমস্যা থাকলে গর্ভধারণের আগে তা নিয়ন্ত্রণে আনাও দরকার।
হিমোগ্লোবিন, থ্যালাসেমিয়া টেস্টের উপরেও জোর দিচ্ছেন ডা. দাশগুপ্ত। হিমোগ্লোবিনে সমস্যা হলে গর্ভে থাকাকালীন সন্তানের বেড়ে ওঠায় প্রভাব পড়তে পারে। তাই আগে থেকে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন ধরনের হরমোনের পরীক্ষা যেমন থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, প্রোল্যাক্টিন ইত্যাদি দেখে নেওয়া উচিত। ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্তর কথায়, “যাঁদের ডায়াবিটিস আছে, তাঁদের অতি অবশ্যই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে তবেই প্রেগন্যান্সির কথা ভাবা উচিত। ব্লাড সুগার বেশি থাকা অবস্থায় গর্ভধারণ করলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি থাকার আশঙ্কা থাকে।” ধূমপান, মদ্যপান ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে ও প্রেগন্যান্সির উপরে কুপ্রভাব সৃষ্টি করে। সুতরাং যাঁরা প্রেগন্যান্সির কথা ভাবছেন তাঁদের সব রকম নেশা পরিত্যাগ করতে হবে।
অনেক সময়ে আগের সন্তানের বা পরিবারে জিনগত ত্রুটি থাকে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সন্তানকে যাতে জিনগত সমস্যায় ভুগতে না হয়, তার জন্যও গর্ভধারণের আগে পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে।
আইভিএফ-এর ক্ষেত্রে
যাঁরা আইভিএফ-এর মাধ্যমে গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন, তাঁদের এমনিতেই ‘হাই রিস্ক’-এর তালিকায় ফেলা হয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই সকল ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। দম্পতির বয়স, দু’জনের ওজন, আগে কোনও রোগে ভুগেছেন কি না, সব কিছুই খুঁটিয়ে দেখা হয়। সাবধান থাকতে রুবেলা (জার্মান মিজ়েলস), ভ্যারিসেলা, হেপাটাইটিস বি-এর প্রতিষেধক নেওয়াও প্রয়োজন।
নজর মানসিক স্বাস্থ্যেও
মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াও অত্যন্ত জরুরি। গর্ভধারণের আগে বা অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন মা যদি কোনও মানসিক সমস্যার শিকার হন, তবে তাঁর চিকিৎসার দরকার। নচেৎ সন্তান জন্মের পর অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যাকে বলে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। যাঁরা আগে থেকে অবসাদ বা অন্য কোনও মানসিক সমস্যার ওষুধ খেয়ে আসছেন, তাঁদের উদ্দেশে চিকিৎসকের পরামর্শ— ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার পরেই সেই ওষুধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ প্রয়োজনে ওষুধ বা তার ডোজ় বদলে দিতে পারেন চিকিৎসক।
শেষ কথা
অতিরিক্ত কফি খাওয়া, মদ্যপান, ধূমপান শরীরে প্রভাব ফেলতেপারে। ভাল থাকতে ও সন্তানকে ভাল রাখতে দরকার পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামের। পুরুষদের ক্ষেত্রে, স্পার্ম কাউন্ট ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জ়িঙ্ক, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, সেলেনিয়াম খাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
ডা. দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, ওজন বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কারণ বিএমআই যদি ঠিক না থাকে, তা হলে তার প্রভাবে সন্তানের শরীরের গঠন এবং স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়েরও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা যেতে পারে। যেমন জেস্টেশনাল ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি। গর্ভপাতের আশঙ্কাও বেড়ে যায় বহু ক্ষেত্রে। তাঁর পরামর্শ, হাঁটাহাঁটি, হালকা কিছু ব্যায়াম করে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। পরিবার পরিকল্পনার কথা যাঁরা ভাবছেন অতি অবশ্যই তাঁদের ফলিক অ্যাসিডযুক্ত ভিটামিন রোজ খাওয়া উচিত। এতে সন্তানের নিউরাল টিউবে ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।
ঐশী চট্টোপাধ্যায়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)