Advertisement
০২ মে ২০২৪

নিশ্চিন্তে ডেঙ্গি ‘চাষ’ হাসপাতালেই

আর জি কর হাসপাতাল। ইমার্জেন্সির পাশেই মেন বয়েজ হস্টেল। শুক্রবার দুপুরে তিনতলার ২৬ নম্বর ঘরে মশারির ভিতরে শুয়ে ছিলেন এমবিবিএস চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র দেবাঞ্জন বড়াল। তাঁর ডেঙ্গি হয়েছে। এই ঘরেরই আর এক আবাসিক, পুষ্পেন্দু নস্করের ডেঙ্গি হয়েছিল পুজোর সময়ে।

এন আর এস

এন আর এস

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫৫
Share: Save:

আর জি কর হাসপাতাল। ইমার্জেন্সির পাশেই মেন বয়েজ হস্টেল। শুক্রবার দুপুরে তিনতলার ২৬ নম্বর ঘরে মশারির ভিতরে শুয়ে ছিলেন এমবিবিএস চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র দেবাঞ্জন বড়াল। তাঁর ডেঙ্গি হয়েছে। এই ঘরেরই আর এক আবাসিক, পুষ্পেন্দু নস্করের ডেঙ্গি হয়েছিল পুজোর সময়ে। আপাতত ডেঙ্গি-আতঙ্কে হস্টেলের প্রায় সকলে দিন-রাত মশারি টাঙিয়ে রাখছেন। গায়ে মশা তাড়ানোর ক্রিম লাগাচ্ছেন, ঘরে-ঘরে জ্বলছে মশা মারার ধূপ। বেশ কয়েক জন আবাসিক সাময়িক ভাবে হস্টেল ছেড়ে কাছাকাছি বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে উঠেছেন।

শুধু আর জি কর নয়, শহরের বিভিন্ন হাসপাতালই এখন ডেঙ্গির আঁতুড়ঘর। ডেঙ্গি-দাপটে এখন থরহরি কম্প কলকাতা মেডিক্যাল থেকে শুরু করে এনআরএস, আর জি কর— সর্বত্রই। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী বহু চিকিৎসক, হবু চিকিৎসক, নার্সেরা। কোথাও কোথাও অবস্থা এমনই যে, রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সংখ্যাতেই টান পড়ছে।

কিছু হাসপাতালে রোগীদের অভিজ্ঞতা আরও মারাত্মক। তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন এক রোগ নিয়ে, কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময়েই সেখানে উড়ে বেড়ানো এডিস ইজিপ্টাই মশার মাধ্যমে তাঁদের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকে পড়ছে। অর্থাৎ, এক রোগ সারাতে এসে তাঁরা উপরি নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ডেঙ্গির দাপটের দিক থেকে এখন শীর্ষে রয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেখানে গত এক মাসের মধ্যে চিকিৎসক ও হবু চিকিৎসক মিলিয়ে ৫৩ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশই কলেজের হস্টেলের আবাসিক। এই মুহূর্তে চিকিৎসাধীন ১৭ জন। এঁদের মধ্যে অনেকের প্লেটলেট অত্যন্ত কমে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর হাসপাতালেই মাত্র দু’দিনের নোটিসে রক্তদান শিবির আয়োজন করে রক্ত দিয়েছেন ১৩৬ জন। আরজিকরে অন্তত ৯ জন নার্সেরও ডেঙ্গি হয়েছে।

তালিকায় এর পরেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ। সেখানে চিকিৎসকেরা তো একের পর এক ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হচ্ছেনই, মেডিক্যালে লিউকোমিয়া নিয়ে ভর্তি হওয়া আঠেরো বছরের এক গুরুতর অসুস্থ তরুণের দেহেও হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকেছে। এই রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরে পৌঁছোতেই হইচই শুরু হয়েছে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও মেডিসিন বিভাগ ও গাইনি বিভাগে রোগীদের দেহে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকেছে বলেও অভিযোগ।

তটস্থ হাসপাতাল

এমবিবিএসের ফাইনাল বর্ষের ছাত্র দেবাঞ্জন বড়াল, কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল, এমডি-র ছাত্র অরিজিৎ ঘোষ, ইন্টার্ন বিবেক কুমার, সুহিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিজিৎ মিশ্র— নামের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আরজিকরে। ডেঙ্গি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানকার সব ক’টি ছাত্র হস্টেলে। হাসপাতালের সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রচণ্ড ডেঙ্গি হচ্ছে হাসপাতালে। এত ডাক্তার, ডাক্তারির ছাত্র এবং নার্স আক্রান্ত হচ্ছেন যে, ডিউটি ভাগ করতে সমস্যা হচ্ছে। এক-এক জনকে অতিরিক্ত সময়ে কাজ করতে হচ্ছে।’’ পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না দেখে গত ২৯ অক্টোবর কলকাতা পুরসভাকে চিঠি লিখে হাসপাতালের হস্টেলে ডেঙ্গি পরিস্থিতির বিষয়ে জানানো হয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে গত ৫ অক্টোবর হেমাটোলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৮ বছরের রণিত কয়াল। তাঁর লিউকেমিয়া হয়েছিল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ২২ অক্টোবর থেকে রণিতের জ্বর আসা শুরু হয়। ৩১ অক্টোবর তাঁর রক্ত পরীক্ষা হ। রিপোর্টে দেখা যায়, ডেঙ্গি হয়ে গিয়েছে রণিতের। কর্তৃপক্ষই স্বীকার করছেন, হাসপাতাল থেকেই ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকেছে রোগীর দেহে। মেডিক্যালে গত এক মাসে অন্তত তিন জন চিকিৎসক এবং চার জন ডাক্তারির ছাত্র ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন।

একই অবস্থা নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসকদের কোয়ার্টার্সে অন্তত ১৫ জন গত এক মাসে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই মুহূর্তে ডেঙ্গিতে ধুঁকছেন ডেপুটি সুপার-সহ একাধিক ডাক্তার। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেল মেডিসিন বিভাগে ৫৬ বছরের এক ব্যক্তি যকৃতের সমস্যা নিয়ে প্রায় ১৭ দিন ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে থাকার শেষ দিকে তাঁর রক্তে ডেঙ্গি ধরা পড়ে এবং হাসপাতাল থেকেই এই জীবাণু ঢুকেছে বলে অভিযোগ করে বাড়ির লোক বন্ড দিয়ে তাঁকে নিয়ে চলে যান। একই ভাবে গাইনিতে ভর্তি ২৬ বছরের এক তরুণীও হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন ডেঙ্গি হয়েছে বলে অভিযোগ করে চার দিন আগে হাসপাতাল ছেড়েছেন।

কেন হাসপাতালে ডেঙ্গি?

আরজিকরের ডেপুটি সুপার সুপ্রিয় চৌধুরীর দাবি, যে সব ডেঙ্গি-আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের কামড়ানোর পরে মশারা হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কামড়াচ্ছে। সেখান থেকেই ডেঙ্গি হচ্ছে। যেহেতু হস্টেলে কাছাকাছি অনেকে থাকেন, তাই এক জন আক্রান্ত হলে তার থেকে মশার মাধ্যমে আরও অনেকের রোগ ছড়াচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত এডিস ইজিপ্টাই জন্মাচ্ছে কী করে? ডেঙ্গি-আক্রান্ত একাধিক চিকিৎসকের অভিযোগ, ‘‘হাসপাতাল চত্বর ও হস্টেলে দিনের পর দিন জমা জল, ময়লা, আগাছা পরিষ্কার হয় না। মশার লার্ভা গিজগিজ করছে। ডেঙ্গি হবে না তো আর কী হবে?’’

কলকাতা মেডিক্যাল ও এনআরএসের চিকিৎসকদের বক্তব্য, বছরের পর বছর হাসপাতালে নতুন ভবন তৈরি, সংষ্কার ও সম্প্রসারণের কাজ হচ্ছে। ইঁট-কাঠের স্তূপে জল জমছে, দেদার মশা হচ্ছে। নীলরতনে বড় একটি পুকুর রয়েছে, যা ঠিকঠাক সাফাইয়ের অভাবে পাড় বরাবর নোংরা জমে থকথকে হয়ে রয়েছে। সেখানে ডিম পাড়ছে ডেঙ্গির মশা।

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফাই, ‘‘প্রয়োজন মতো হাসপাতাল চত্বর সাফাই হয়। কিন্তু এ বছর বৃষ্টি আর গরম দু’টোই বেশি। নভেম্বর এসে গেলেও এখনও পর্যন্ত তেমন ঠান্ডা পড়ল না। এই অবস্থায় ডেঙ্গি এমনিতেই বাড়ে। তবে আমরা মেডিক্যাল কলেজগুলির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছি।’’

কী করছে এবং বলছে কলকাতা পুরসভা?

পুরসভার উপদেষ্টা তপন মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কলকাতার সব ক’টি মেডিক্যাল কলেজে পূর্ণবয়স্ক মশা মারতে ধোঁয়া ছড়ানো ও মশার লার্ভা খুঁজে মারার কাজ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক, হবু চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেরা উদ্যোগী না হলে ডেঙ্গি রোখা যাবে না। কারণ ডেঙ্গির মশা হয় ছোট্ট জায়গায় জমা জলে। যেমন ছোট্ট কৌটো বা শিশি বা পাত্র বা ট্রে। এই রকম জিনিস যে কোনও হাসপাতালের আনাচ-কানাচে অসংখ্য ছড়িয়ে থাকে। ব্যক্তিগত ভাবে হাসপাতালের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ম করে ফেলে দিতে হবে।

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dengue hospital parijat bandopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE