Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বোরখার আড়াল ছেড়ে পুরুষ-দুর্গে হানা শাইনাবার

ছোট ছোট টিলা মনোরম সবুজে মোড়া। প্রকৃতির মতো গোটা তল্লাটের রাজনৈতিক রংও ঘোরতর ভাবে সবুজ! সেই মুলুকেই বড় মহল্লা থেকে সরু গলিঘুঁজিতে হাসি মুখে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন ৫২ বছরের এক মহিলা। গলায় লাল উত্তরীয়! আর ৪৮ ঘণ্টা পরে কেরলে ভোট শুরু। বৈদ্যুতিন ভোট যন্ত্রে তাঁর বিপ্লবের কোনও চিহ্ন থাকল কি না, জানা যাবে ১৬ মে। কিন্তু জনাদেশ ঘোষিত হওয়ার আগেই উত্তর কেরলের মলপ্পুরমে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন পি কে শাইনাবা!

প্রচারে শাইনাবা। —নিজস্ব চিত্র।

প্রচারে শাইনাবা। —নিজস্ব চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

ছোট ছোট টিলা মনোরম সবুজে মোড়া। প্রকৃতির মতো গোটা তল্লাটের রাজনৈতিক রংও ঘোরতর ভাবে সবুজ! সেই মুলুকেই বড় মহল্লা থেকে সরু গলিঘুঁজিতে হাসি মুখে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন ৫২ বছরের এক মহিলা। গলায় লাল উত্তরীয়!

আর ৪৮ ঘণ্টা পরে কেরলে ভোট শুরু। বৈদ্যুতিন ভোট যন্ত্রে তাঁর বিপ্লবের কোনও চিহ্ন থাকল কি না, জানা যাবে ১৬ মে। কিন্তু জনাদেশ ঘোষিত হওয়ার আগেই উত্তর কেরলের মলপ্পুরমে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন পি কে শাইনাবা! মুসলিম-অধ্যুষিত মলপ্পুরম লোকসভা কেন্দ্রে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম মহিলা প্রার্থী। যে মলপ্পুরম এখনও মুসলিম লিগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং ৬ বারের সাংসদ ই আহমেদের সঙ্গে টক্কর নিতে শাইনাবা নেমেছেন সিপিএমের প্রতীক নিয়ে।

কেরল জনতার অনেকেই মলপ্পুরমকে ঠাট্টা করে ‘কেরলের মিনি পাকিস্তান’ বলে ডাকে। জনসংখ্যার অন্তত ৭০% মুসলিম। কিছু খ্রিস্টানও আছেন। সংখ্যাগুরু মুসলিমদের দাবিকে স্বীকৃতি দিতে মলপ্পুরমকে পৃথক জেলা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন দেশের এবং রাজ্যের প্রথম কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ। কিন্তু তার পর থেকে এই তল্লাটে কোনও কালেই কমিউনিস্টরা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে জেলায় মলপ্পুরম নামে লোকসভা কেন্দ্র ছিল না। অধুনা বিলুপ্ত মনজেরি আসনে ১০ বছর আগে এক বার জিতেছিল সিপিএম। এখন মলপ্পুরম কেন্দ্রটির যা বিন্যাস হয়েছে, তাতে মুসলিম লিগেরই দাপট প্রবল। এমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পিছনে রেখে এবং সামাজিক অনুশাসন ভেঙে প্রথম মহিলা প্রার্থী হিসাবে আক্ষরিক অর্থেই দুঃসাহসী লড়াইয়ে সৈনিক হয়েছেন শাইনাবা।

মলপ্পুরমে সাক্ষরতার হার ৯৫%-এর বেশি। তবু বোরখা ছাড়া মহিলাদের বাইরে দেখতে নারাজ সে জেলা। প্রচারে বেরোনো পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে বাড়ির মহিলারা কথা বলেন দূরত্ব রেখে। এমন ‘ঘেটো’ সংস্কৃতির খাস তালুকে শাইনাবা বেরোচ্ছেন বোরখা ছাড়া! স্থানীয় মুসলিম লিগের নেতারা তা-ই নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। কিন্তু শাইনাবা বলেন, “এখানে শিক্ষিত মহিলারাও কাজ করতে বাইরে যান না। শুধু বোরখার আড়ালে থাকা, প্রথমে বাবা, পরে স্বামী এবং আরও পরে সন্তানদের কথা শুনে জীবন কাটিয়ে দেওয়া এই হল রুটিন। মহিলাদের জীবন মানে কি এই? মুখোমুখি তাই বলছি।” পাড়ায় ঢুকলে মহিলা এবং শিশুদের ভিড় জমছে তাঁকে ঘিরে।

তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ এমন প্রচারে বিচলিত নন। তাঁর দাবি, মলপ্পুরমের পুরনো চেহারা পাল্টাচ্ছে। “মহিলাদের পিছিয়ে থাকার কথা বলে লাভ হবে না। আসল কথা হল, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি।” বক্তব্য আহমেদের। মলপ্পুরম থেকে শ্রমিকরা কাজে যান সৌদি আরবে। তাঁদের ভিসা জোগাড় করে দিতে গত ক’বছরে সাহায্য করেছেন কেন্দ্রীয় বিদেশ প্রতিমন্ত্রী আহমেদ। সম্প্রতি রিয়াধে যখন নির্মাণ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের উপরে খাঁড়া নেমেছে, বিকল্প কাজ খুঁজতে থেকে যাওয়ার জন্য ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন মন্ত্রী। শ্রমিক পরিবারের কাছে তিনি তাই ত্রাতা। পক্ষান্তরে শাইনাবা চান সামাজিক অনুশাসনের ঘেরাটোপে এক টুকরো মুক্তির ত্রাণ নিয়ে যেতে। তাঁর কথায়, “সকলের জন্য সমানাধিকার, এই আমাদের সহজ দাবি।” সিপিএমের হয়েই আগে পঞ্চায়েতে জিতেছেন শাইনাবা। রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য হয়েছেন। তাঁর স্বামীও কর্মক্ষেত্রে সিপিএম-প্রভাবিত সংগঠনেরই নেতা। শক্ত ময়দানে শাইনাবার সাহসী লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁর বহু মহিলা সতীর্থ। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ব্যারাকপুরের প্রার্থী সুভাষিণী আলির কথায়, “মহিলা সমিতিতে ওর সঙ্গে কাজ করেছি। আইনজীবী, মাথাটা খুব পরিষ্কার। ওখানে ও যে লড়াইটা করতে গিয়েছে, তার জন্য সাহস লাগে! চাইছি জিতে আসুক!”

শাইনাবার ভাগ্য ‘শাইন’ করবে কি না, মলপ্পুরমই জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

loksabha election shainaba sandipan chakrabarty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE