Advertisement
১৭ জুন ২০২৪

হারের ময়নাতদন্তে পুরনো কাসুন্দিই

আগামী এপ্রিলে বিশাখাপত্তনমে বসবে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস। তার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দলের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকে কর্মী ও বিভিন্ন স্তরের নেতাদের এই প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হচ্ছে দেশ জুড়ে সিপিএমের চূড়ান্ত ভরাডুবি কেন? শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, এ বার লোকসভা নির্বাচনে ত্রিপুরা বাদে সিপিএম ধাক্কা খেয়েছে সর্বত্রই।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০২:২১
Share: Save:

আগামী এপ্রিলে বিশাখাপত্তনমে বসবে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস। তার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দলের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকে কর্মী ও বিভিন্ন স্তরের নেতাদের এই প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হচ্ছে দেশ জুড়ে সিপিএমের চূড়ান্ত ভরাডুবি কেন?

শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, এ বার লোকসভা নির্বাচনে ত্রিপুরা বাদে সিপিএম ধাক্কা খেয়েছে সর্বত্রই। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কারাটের তৃতীয় দফা শেষ হওয়ার মুখে প্রশ্ন উঠেছে, দলের এই হাল কেন? মনমোহন সিংহের জমানায় পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে কারাট সমর্থন প্রত্যাহার করার পরে দলীয় বিপর্যয়ের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষার দাবি উঠেছে বারবার। গত কয়েক বছরে দলের ক্রমাবনতির মূল্যায়ন না করে কারাট ফরমান জারি করেছেন, ১৯৭৮ সালে জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসে অ-কংগ্রেসি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ে চলার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি না, তা নতুন করে বিচার করে দেখা হোক! দিল্লিতে ২৬ থেকে ২৯ অক্টোবর আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই দল তার প্রাথমিক বিচারে বসছে। যার অর্থ ৩৬ বছরের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে এখন তৎপর কারাট!

কারাটপন্থী নেতাদের বক্তব্য, জরুরি অবস্থার পরে দেশ জুড়ে কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছিল। ওই জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসেই ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে শুধু যে কেন্দ্রে মোরারজি দেশাই সরকার গঠন হয়েছিল তা নয়, পশ্চিমবঙ্গেও বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তার পরে ভারতের রাজনীতিতে অনেক পালাবদল হয়েছে। ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে হায়দরাবাদে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়, বিজেপি-কে আটকাতে প্রয়োজনে কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমর্থন করতে হতে পারে। ২০০৫ সালের দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে এই ভাবনাই আরও চূড়ান্ত রূপ পায়। সেখানেই কারাট হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের হাত থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু মনমোহন সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে ২০০৮ সালে কারাটের নেতৃত্বে সিপিএম আবার কংগ্রেস-বিরোধী লাইন নেয়।

কংগ্রেস না বিজেপি কে বড় শত্রু, তা নিয়ে সিপিএমের মধ্যে দোলাচল অবশ্য সুপ্রাচীন। ইএমএস থেকে সুরজিৎ, এই বিতর্ক অব্যাহত ছিল। আবার জ্যোতি বসু-সুরজিৎ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও কারাট অনেক বেশি কংগ্রেস-বিরোধী লাইন নিয়েছিলেন। সমর্থন প্রত্যাহার করে কারাটই আবার বোঝাপড়া করতে গিয়েছিলেন মায়াবতীর মতো আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীর সঙ্গে। কিন্তু এখন কারাট-শিবিরই চাইছে জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসে বুর্জোয়া দলের সঙ্গে যাওয়ার ঠিক-ভুল বিচার করতে!

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে যখন বিজেপি নতুন করে হুঙ্কার দিচ্ছে, তখন সিপিএম পার্টি কংগ্রেসে আবার রাজনৈতিক লাইন পরিবর্তন করার কথা ভাবছে। কিন্তু সেখানেও মাথাচাড়া দিচ্ছে প্রবল বিতর্ক। সিপিএমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আর বছর দেড়েক পরে বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্য সিপিএমের একাংশ মনে করছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সরাতে গেলে রাজ্য স্তরেও কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া করা বাঞ্ছনীয়।

সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “বিজেপি-র সঙ্গে বোঝাপড়া অসম্ভব। কিন্তু মমতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধার বিষয়টি বিবেচনা করা অসম্ভব নয়। কারণ এত বিপর্যয়ের পরেও কংগ্রেসের শতকরা ভোট কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে অনেকটাই থেকে যাচ্ছে। যেটা মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানাতেও দেখা গিয়েছে।”

কিন্তু কারাট যেমন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির নামে কংগ্রেসের দিকে মুখ ফেরাতে রাজি নন, তেমনই সরাসরি তাঁর আমলের ব্যর্থতা নিয়ে কাটাছেঁড়াতেও অনাগ্রহী!

দলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, “গত কয়েক বছরের দলীয় কাজকর্মের পর্যালোচনা না করে ৪০ বছরের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার কারণ একটাই। সেটা হল প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বকে সুরক্ষিত করা!” দলীয় গঠনতন্ত্র অনুসারে সাধারণ সম্পাদক পদে তিন বারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এ বার কারাটকে বিদায় নিতে হবে।

কারাট-পন্থী নেতারা চাইছেন, বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ, কেরলের এস আর পিল্লাইকে দায়িত্বে আনা হোক। দ্বিতীয় পছন্দ অন্ধ্রের নেতা বি ভি রাঘবুলু। এমনকী, পিল্লাই ও রাঘবুলুকে ঐকমত্য না হলে দলীয় গঠনতন্ত্রের জরুরি অবস্থার অনুচ্ছেদটি প্রয়োগ করে কারাটকেই ফের সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করা হতে পারে! সে ক্ষেত্রে দেখানো হবে, বিজেপি-র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির ভয়াবহ উত্থানে, দলের এই সঙ্কটে কারাটের থাকাটা জরুরি। অতীতে নির্বাচিত সভাপতি সীতারাম কেশরীকে সরাতে যে ভাবে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছিল, সিপিএমও কারাটকে সেই ভাবেই দলীয় পদে বহাল রাখতে পারে।

পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতির ঘোষণা করে কারাট নিজেই জানিয়েছিলেন, অতীতের রাজনৈতিক লাইনের পর্যালোচনা হবে। কারাটপন্থীরা যুক্তি দিচ্ছেন, তাঁদের দলের রাজনৈতিক অভিমুখ পুরনো পার্টি কংগ্রেসের পর্যালোচনা করেই তৈরি হয়। আবার দলের অন্য একাংশের বক্তব্য, জালন্ধর থেকে বিচার করতে বসা আসলে কারাটের দায় এড়ানোর কৌশল!

দলীয় সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক সদস্য কারাটের এই কৌশলে অখুশি হলেও বৈঠকে তেমন সরব হন না! তাঁদের ভয়, কারাট বা কারাটপন্থীরাই থেকে গেলে নতুন কমিটিতে প্রতিবাদীদের আর ঠাঁই হবে না! তাই সাড়ে তিন দশক আগেকার ভুল-ঠিক বিচার করতে গিয়ে বিতর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে দলের অন্দরে কৌতূহল এখন প্রবল। শারীরিক কারণে দিল্লিতে পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যেতে পারেন না বলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে এ বিষয়ে লিখিত মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। যদিও এখনও এ কে জি ভবনে সেই মত এসে পৌঁছয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE