মাদ্রাজ হাই কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
ঝুরি নামা হদ্দবুড়ো বটগাছটাও আজ খুশি। সাকিন বাচাতি গ্রাম, জিলা ধর্মপুরী, তামিলনাড়ু।
৩০টা বছর পেরিয়ে অবশেষে ন্যায় বিচার মিলেছে বাচাতি গাঁয়ের বাসিন্দা অরণ্যচারী আদিবাসী মানুষগুলোর, যাঁরা আসতে যেতে মাথা ঠেকিয়ে যান ওই বুড়ো বটের থানে। আবার ‘সরকারি বাবুরা’ এই বটেরই ছায়ায় একটা গোটা দিন ধরে গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষগুলোর উপরে যে ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালিয়ে তিন দশক ধরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, মাদ্রাজ হাই কোর্ট শুক্রবার সে জন্য তাদের দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দিয়েছে সক্কলকে। হাই কোর্টের বিচারপতি পি বেলমুরুগন তামিলনাড়ু সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন— প্রত্যেক নির্যাতিত গ্রামবাসীকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। চাকরির বন্দোবস্ত করতে হবেপরিবার পিছু।
চন্দনদস্যু বীরাপ্পানকে সহযোগিতা করেন বাসিন্দারা, এমন একটা অভিযোগ তুলে জঙ্গলে ঢাকা সিতেরি পাহাড়ের ঠিক পায়ের গোড়ায় বাচাতি গ্রামে মাঝে মাঝেই হানা দিত পুলিশ। পুরুষদের দেখা মাত্র মারধর করে ভ্যানে তুলে নিয়ে যেত। চন্দনকাঠ থেকে মাদক চোরাচালানের মামলা দিয়ে ফাটকে ভরে দিত। দিনটা ১৯৯২-র ২০ জুন। পুলিশের সহায়ক কয়েক জন বনরক্ষী এক গ্রামবাসীকে মারধর করলে এক জনকে পাল্টা মার দিলেন গ্রামের বাসিন্দারা। শাসিয়ে ফিরেযায় বনরক্ষীরা।
আদালতের নথি বলছে— এর কয়েক ঘণ্টা পরে ১৫৫ জন আগ্নেয়াস্ত্রধারী বনরক্ষী, ১০৮ জন সশস্ত্র পুলিশ এবং ৬ জন রাজস্ব-অফিসার বাচাতি গ্রাম ঘিরে ফেলে ‘বীরাপ্পানের খোঁজে’ তল্লাশি শুরু করে। গ্রামের সমর্থ পুরুষেরা পুলিশের ভয়ে আগেই গা-ঢাকা দেন সিতেরি পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে। সরকারি বাহিনী গ্রামে পান বয়স্ক, অথর্ব আর নারী-শিশুকে। সবাইকে জড়ো করা হয় ওই বুড়ো বটের নীচে। ১৮ জন মহিলাকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয় গাঁয়ের একমাত্র পুকুরটির ধারে নিরিবিলিতে, যাঁদের অনেকেই তখন কিশোরী স্কুলছাত্রী। সেখানে গণধর্ষণ করা হয় তাঁদের। বাকিদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেওয়া হয় বটতলায়। গ্রামের সব বাড়ি ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় গোয়ালঘর। পোষা গরু-ছাগলগুলোকেও মেরে ফেলা হয়।
এর পরে দু’-চার জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছাড়া মোট ১০০ জন গ্রামবাসীকে থানায় তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে চোরাচালান থেকে চুরি-ডাকাতির মামলা দেওয়া হয়। আর নির্যাতিতারা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গেলে, নেওয়া হয়নি তা। নিম্ন আদালতে মামলা চলাকালীন কেউ কেউ নির্যাতন-ধর্ষণের কথা বিচারককে জানালে অভিযুক্তরা ‘সব মনগড়া’ বলে জানায়। বিচারকেরা বলেন, সরকারি অফিসারেরা আবার ধর্ষণ করে নাকি?
এক দিন জামিন পেয়ে এক এক করে ঘরে ফেরেন গ্রামবাসীরা। বিচার চেয়ে জোট বাঁধেন। ধর্না দেন শহরে এসে। কিছু মানবাধিকার কর্মী এবং সিপিএমের তামিলনাড়ু শাখা এঁদের পাশে এসে দাঁড়ায়। পার্টির আইনজীবীরা নতুন করে মামলা শুরু করেন। আন্দোলনের চাপে রাজ্য সরকার ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। সিবিআই রিপোর্টে জানায়, গ্রামবাসীদের অভিযোগ সত্যি। এর পরে ঘটনার ২০ বছর পরে ২০১১-য় নিম্ন আদালত ২৬৯ জন পুলিশ, বনরক্ষী ও প্রশাসনিক অফিসারকে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের উপরে অত্যাচারে দোষী সাব্যস্ত করে। এদের মধ্যে ১৭ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় গণধর্ষণের জন্য। কিন্তু ওই ১৭ জন ছাড়া কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়নি, তারা হাই কোর্টে রায়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা ঠোকে।
হাই কোর্টের বিচারপতি বেলমুরুগন শুনানির মধ্যেই মার্চে এক দিন গাড়ি নিয়ে চলে যান বাচাতি গ্রামে। নির্যাতিতদের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। শুক্রবার রায়ে নিম্ন আদালতের রায়কে বহাল রেখে তিনি ২১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেন, কারণ বাকি ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে তত দিনে। এক থেকে ১০ বছরের কারাবাসের সাজা দিয়েছেন প্রত্যেককে। সঙ্গে জরিমানাও। বাচাতির বাসিন্দারা সন্তুষ্ট, খুশি ঝুরি নামা সেই বুড়ো বটও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy