Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আবু পাহাড়ের হাতছানি

সেই সুদূর পশ্চিমে রাজস্থানে বহু প্রাচীন আরাবল্লী পর্বত। চারপাশে থর মরুভূমির রুক্ষতা। সেই ধূ ধূ মরুর মাঝে আরাবল্লীর গায়ে শুয়ে আছে নাক্কি লেক – পাহাড়ঘেরা মনোরম এক হ্রদ। সেই হ্রদকে কেন্দ্র করে মরূদ্যানের মত এক শৈলশহর - মাউন্ট আবু। তপ্ত বালিয়ারির দেশে একমাত্র শীতল স্থান। প্রকৃতির আশ্চর্য এক সৃষ্টি! কি করে এমনটা হল, এ নিয়ে অনেক গল্প, অনেক কাহিনি, পুরাণকথা, লোককথা।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

সেই সুদূর পশ্চিমে রাজস্থানে বহু প্রাচীন আরাবল্লী পর্বত। চারপাশে থর মরুভূমির রুক্ষতা। সেই ধূ ধূ মরুর মাঝে আরাবল্লীর গায়ে শুয়ে আছে নাক্কি লেক – পাহাড়ঘেরা মনোরম এক হ্রদ। সেই হ্রদকে কেন্দ্র করে মরূদ্যানের মত এক শৈলশহর - মাউন্ট আবু। তপ্ত বালিয়ারির দেশে একমাত্র শীতল স্থান। প্রকৃতির আশ্চর্য এক সৃষ্টি! কি করে এমনটা হল, এ নিয়ে অনেক গল্প, অনেক কাহিনি, পুরাণকথা, লোককথা। সেই প্রাচীনকালে ছিলেন এক জ্ঞানী ঋষি – বশিষ্ঠ। তাঁর ছিল এক গাভী। নাম নন্দিনী। ঐ অঞ্চল দিয়ে ভ্রমণকালে নন্দিনী হঠাৎ পড়ে গেল গভীর খাদে। হা ভগবান, এ কি হ’ল! ওই গভীর খাদ থেকে কিছুতেই সে উঠতে পারল না। তখন বশিষ্ঠ শরণাপন্ন হলেন শিবের। হে দেবাদিদেব, এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন আমার নন্দিনীকে। মহাদেবের নির্দেশে পুণ্যসলিলা সরস্বতী নদী প্লাবিত করলেন ঐ খাদ। অবশেষে ভেসে উঠল নন্দিনী। বেঁচে গেল সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ঋষি বশিষ্ঠ। কিন্তু নিজের কার্যোদ্ধার হয়ে গেল বলে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন না। বরং আর কোন দুর্ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সেই চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি পর্বতরাজ হিমালয়কে বললেন, এই গিরিখাত ভরাট করে দাও যাতে আর কেউ কখনো এখানে পড়ে না যায়। ঋষি বশিষ্ঠের আদেশ পালন করেন হিমালয়। হিমালয়ের কনিষ্ঠ পুত্র সর্পদেবী অর্বুদার সাহায্যে বুঁজিয়ে দেয় সেই খাদ। সেই থেকে ঐ স্থানের নাম হয় অর্বুদা পাহাড়, পরবর্তীকালে যা সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ায় আবু পাহাড়। প্রাথমিক অবস্থায় আবু পাহাড় ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ছিল, কিন্তু শিব তাকে পা দিয়ে চেপে মাটিতে প্রোথিত করে দেন। এখানে অচলগড়ে অচলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে শিবের পায়ের আঙুলের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এই হল একটি কাহিনি আবু পাহাড়কে ঘিরে।

আর একটি পুরাণকথায় আছে যে, সর্পদেবী অর্বুদা, নন্দীকে উদ্ধার করেছিলেন এইখানে একটি গিরিখাত থেকে। এইখানে অগ্নিকুল রাজপুতদের দ্বারা একটি যজ্ঞও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইতিহাসের পাতা ওল্টালেও দেখতে পাওয়া যায় যে, আকবরনামায় আবুল ফজল বলেছেন যে, আবুর পুরাকালের নাম ছিল অর্বুদা। অচল অর্বুদা ছিল এক আত্মা যে নিজেকে নারীরূপের আড়ালে লুকিয়ে রাখত। ঐ পাহাড় জঙ্গলে সে ঘুরে বেড়াত। অচল অর্থ পাহাড়। একাদশ শতাব্দীতে এই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় হয়ে ওঠে মুনি ঋষিদের সাধনার স্বর্গভূমি। বিশেষ করে এই অঞ্চল হয়ে ওঠে জৈনদের তীর্থস্থান – গড়ে ওঠে বিখ্যাত জৈন মন্দির দেলওয়াড়া, যেখানে মার্বেল পাথরের সূক্ষ্ম কারুকার্যে জেগে ওঠে সুর।

পঞ্চদশ শতকে মেবারের রানা কুম্ভ এই পাহাড়ের অধিপতি হয়ে ওঠেন। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মাউন্ট আবু গড়ে ওঠে এক শৈলশহর হিসেবে। ১৮২২ সালের জুনে কর্নেল জেমস টড নতুন করে আবিষ্কার করেন মাউন্ট আবুকে। ১৮৪৫ সালে মহারাজা শিব সিং এর কাছ থেকে বৃটিশরা মাউন্ট আবুতে জমি লিজ নেয় স্যানাটোরিয়াম স্থাপনের জন্য। পরবর্তীকালে মাউন্ট আবুই রাজপুতানায় বৃটিশদের কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯১৭ সালে সিরোহী মহারাজা কেসরী সিংকে বাৎসরিক সাতাশ হাজার টাকার বিনিময়ে মাউন্ট আবুতে তাদের অধিকার কায়েম করে বৃটিশরা। ১৯৪৭ সালের জুলাইতে স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে লিজের শর্ত তুলে নেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর মাউন্ট আবু যুক্ত হয় বম্বে স্টেটের সাথে। কিন্তু আদতে এটি রাজস্থানেরই অংশ ছিল, তাই রাজস্থান সরকার একে ফিরে পাওয়ার জন্য আর্জি জানায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। অবশেষে ১৯৫৬ সালের পয়লা নভেম্বর স্টেট রিঅর্গানাইজেশন কমিশনের সিদ্ধান্তে মাউন্ট আবু রাজস্থানের সিরোহী জেলার সাবডিভিশনাল পার্ট বলে গণ্য হয়।

সুধীজন, এতক্ষণে নিশ্চই আপনারা ভাবছেন, কেন মাউন্ট আবু নিয়ে এত কথা লিখে চলেছি। এপ্রিলের মাঝামাঝি যে চার পাঁচদিন ছুটি ছিল, সেই ছুটিতে চলে গিয়েছিলাম মাউন্ট আবু। মুম্বইয়ের বান্দ্রা টার্মিনাস স্টেশন থেকে চেপে বসলাম সূর্যনগরী এক্সপ্রেসে। ট্রেণ ছাড়ল দুপুর দেড়টায়। বারো ঘন্টা পর আবুরোড স্টেশনে ট্রেণ যখন ঢুকল রাত তখন দেড়টা। সেই রাতে লটবহর নিয়ে স্টেশনের বাইরে হোটেল খুঁজতে যাওয়ার থেকে স্টেশনে রাত কাটানোই ভাল। এও এক অভিজ্ঞতা! মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখি, বসার জায়গায় সব চাদর বিছিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কেউ কেউ মাটিতেও। অগত্যা আবার প্লাটফর্মের বেঞ্চে। রাতের স্টেশন শুনশান, তবে মোটামুটি পরিষ্কার। রাত যত বাড়ছে, ঠান্ডা হাওয়ার শিরশিরানি। ঘুম তো হবে না জানি, ঐ কোনরকমে অপেক্ষা করা কখন পাঁচটা বাজবে, গাড়ি নিয়ে ছুটব আবু পাহাড়ের ওপর। স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ছিল আমার ছোট্ট ছেলে। মাথার ওপর নিশ্চিন্ত আরামের ছাদ নেই, নেই নরম বিছানা – সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে ভালই অভিজ্ঞতা। মনে মনে ভাবি সেইসব শিশুদের কথা, যাদের পথই ঠিকানা। যাই হোক, রাতটা কাটল অবশেষে। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে একটা গাড়ি পাওয়া গেল। গাড়ি যখন আবু পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ বেয়ে ওপরে উঠছে ভোরের আলো ফুটছে চারপাশে। ঊষাকাল। অদ্ভূত এক পরিবেশ রচিত হয়েছে। এই ঊষাকাল, এই অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে চলা – প্রকৃতি জুড়ে ঘটে চলা এক নীরব রূপান্তরের সাক্ষী হয়ে থাকা।

হোটেলে পৌঁছতেই চোখ জুড়িয়ে গেল, সেইসঙ্গে মনও। হোটেল আগেই বুক করা ছিল। নাম সিলভার ওক। হোটেলের গা ঘেঁষে উঠে গেছে বিরাট এক পাথরের ঢাল। কিংবা বলা যায় ঐ পাথরের ঢালেই হোটেলটা। পাথরের গা রুক্ষ, কেবল দুটো চারটে লতানো গাছে বেগুনী রঙের ফুল ধরেছে। অজস্র কাঠবিড়ালীর ব্যস্ত ছুটোছুটি এদিক ওদিক। পাশেই একটা ঝাঁকড়া গাছ। সেখান থেকে ভেসে আসছে বুলবুলির মিঠে আওয়াজ। হোটেলের ঠিক সামনেই মাথা প্রায় আকাশে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে একটা গাছ। পরে জেনেছিলাম এই গাছটির নামই সিলভার ওক – স্থানীয় ভাষায় বলে গুরবেল। এরকম অজস্র গাছ পরে দেখেছি আবু পাহাড় জুড়ে। চমৎকার হলদেটে কমলা রঙের ফুল ধরেছে গাছগুলোতে। ঘুম তো আর হবে না, কাজেই ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরোলাম আশপাশটা ঘুরে দেখতে।

যদিও মাউন্ট আবুর উচ্চতা ১২২০ মিটার এবং আবহাওয়া বেশ আরামপ্রদ, তবু এই সময় রোদ চড়লে হাঁটা মুশকিল ওঠে। গেলাম তা সত্ত্বেও রোদচশমায় চোখ ঢেকে। আমাদের হোটেল থেকে পনেরো মিনিটের হাঁটাপথে নাক্কি লেক। যেতে যেতে চোখে পড়ল স্টেডিয়াম। স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে দূরে অপূর্ব হালকা বেগুনি ফুলে ছাওয়া এক গাছ। আকাশটা এখন কি নীল, কি নীল – মেঘগুলো কেমন সূর্যের রশ্মির মত লম্বা রেখায় হালকাভাবে ছড়িয়ে আছে। রোদের ছটা ঝকঝক করছে পালিশ করা কাচের মত। আর চারদিকে চোখে পড়ছে অজস্র খেজুর গাছ এবং সে গাছ মোটেই আমাদের বাংলার মত বেঁটে বেঁটে নয়, নারকোল বা তালগাছের মত বিশাল লম্বা, মাথা প্রায় আকাশে ঠেকছে। যেখানে যেমন, সেখানে তেমন!

ছবির মত সুন্দর পাহাড়ে ঘেরা এই হ্রদ, নাম যার নাক্কি লেক। এই নামের পেছনে এক কাহিনি আছে। বালম রসিয়া নামে এক মুনি না কি নখ দিয়ে খুঁড়েছিলেন এই লেক, তাই এর নাম হয় নখি লেক এবং তা থেকে অপভ্রংশে নাক্কি লেক। হিন্দুরা গঙ্গার মতই পবিত্র মনে করেন এই হ্রদের জল। লেকের কাছে সুন্দর একটা বাগানও তৈরি করা হয়েছে। গান্ধী পার্ক। ১৯৫৩ সালে আবুরোড মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে এটি তৈরি হয়। এখানে নানা ধরণের গাছপালা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই নাক্কি লেকের জলেই মহাত্মা গান্ধীর দেহভস্ম বিসর্জন দেওয়া হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই লেকের উচ্চতা ১২০০ মিটার। আরাবল্লী পার্বত ক্ষয়জাত পর্বত, সেই কারণে এই পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে নানা আকৃতি তৈরি হয়েছে। তা কখনো পশুপাখি বা কখনো মানুষের। নাক্কি লেকের দক্ষিণ দিকেও পাহাড়ের ওপর এমন এক পাথরের আকার দেখে মনে হয় যেন কোলাব্যাঙ লাফ দিচ্ছে – তাই একে বলা হয় ‘টোড রক’। লেকে বোট, প্যাডল বোট, শিকারা ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে। তবে ঐ চড়া রোদ আর সহ্য হচ্ছিল না তার ওপর রাত জাগার ক্লান্তি। হোটেলে ফিরে রাজস্থানি গুট্টা কারি, ডাল, ভাত, আলু জিরা, মসালা খিচিয়া পাপড় আর দই দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনটি সেরে একটা জম্পেশ ঘুম।

বিকেলে হুড়ুম দাড়ুম করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ছেলেকে বগলদাবা করে ছুটলুম সানসেট পয়েন্ট দেখতে। আমার বেটার হাফ তাড়া দেওয়ার মাস্টার। বাড়িতে বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে থাকবে আর বেড়াতে গেলেই চল, চল, চল, চল – একটা কিছুও যেন মিস না হয়। স-ব দেখে নিতে হবে একবারে, তা না হলে বেড়াতে আসা কেন বাপু। আমাদের মেয়েদের তো শাঁখের করাত, আসতে কাটে, যেতে কাটে – সবদিক রক্ষে করে চলা চাই। মা দুগ্গার জাত কি না – দশ হাতে দশ দিক সামলাতে হয়। আমাদের কি আর পায়ের ওপর পা তুলে বিশ্রাম নেওয়া সাজে? সেসব আমাদের বেটার হাফ মহাদেবদের জন্য তোলা থাক; জয় বাবা ভোলেনাথ, তুমি আবার রাগ কোর না যেন!

তা সে যাই হোক, একটা ট্রেকার নিয়ে চললুম সানসেট পয়েন্ট। আমি পেছনে বাবা, মা দুই বুড়োবুড়ি আর ছোট খোকাকে নিয়ে বসলুম আর উনি সামনে ড্রাইভারের পাশে বীরদর্পে। ঝকর ঝকর করতে করতে এলুম এক পাহাড়ের পায়ের তলায়। সেখান থেকে এক কিলোমিটার হাঁটা। ঘোড়া আর ছোট ছোট ঠেলা গাড়ির মত রিক্সায় ভর্তি জায়গাটা। সবাই ছেঁকে ধরছে – ঘোড়া না রিক্সা, রিক্সা না ঘোড়া! এদের খপ্পড়ে না গিয়ে হাঁটতে শুরু করলুম। আমার ছেলের বেশ মজা। ঘোড়া দেখতে দেখতেই বেমালুম মেরে দিচ্ছে পথ, বলছেও না একবারও পায়ে ব্যথা কি জলতেষ্টা – কোন বাহানা নেই! আমি মাছের মত খাবি খেতে খেতে উঠলুম খানিকটা খাড়া চড়াই। ফিটনেসের যা বহর হয়েছে, চেহারাটা অন্ততঃ আদ্দেক না করলে আর চলছে না। এত কাণ্ড করে উঠে দেখি সূর্য হি হি করে হাসছে, মজা করে বলছে, ডুবতে আমার এখনো অনেক দেরি। সবে তো কলির বিকেল! ঘড়িতে দেখি সাড়ে ছটা। সাতটার আগে তো উনি ডুববেনই না। তাছাড়া অপেক্ষা করেও লাভ নেই। কেমন একটু মেঘ মেঘ ভাব। হয়তো কিছুই দেখতে পাব না। লাভের মধ্যে হল পাহাড়ের ওপর থেকে নীচের খাদের সৌন্দর্য আর নানা রঙ বেরঙের ফুলে ভরা গাছ দেখা। হনুমানরাও আমাদের সঙ্গে বসেছিল সেখানে। আমার ছেলের তো আরো মজা। ঘোড়ার সঙ্গে হনুমান ফ্রি!

তা সে যাই হোক, সানসেট দেখা হল না, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আফশোষ হ’ল না আমার, জীবনে কত কিছুই দেখা হয় না। হুমম, তবে সন্ধেবেলা সূর্য ডোবার পর নাক্কি লেকের জলের মধ্যে রেষ্টুর‍্যান্টে বসে চা পকোড়া খেতে খেতে দেখলাম লেকের ভার্জিন বিউটি। দূরে পাহাড়, আকাশে অস্তরাগের মায়াবী আলো আর জলে সিল্যুয়েটের মত ভাসছে শিকারা। মনের সেলুলয়েডে বন্দী হ’ল সে দৃশ্য। সে দৃশ্য আমার একান্ত আপন এবং গোপন আর হ্যাঁ, কেবল একজনের কাছেই খুলব সে দৃশ্যের পর্দা...আমার রাজ...এই সফরে যদি সে আসে কখনো...।

পরদিন গাড়ি ঠিক করা হয়েছিল মাউন্ট আবুর আশেপাশে যেসব দ্রষ্টব্য আছে, সেগুলো ঘুরে দেখার জন্য। এদিক সেদিক যেসব জায়গা আছে, চটাপট দেখে নিলাম। সংক্ষেপে সেগুলোর বিবরণ দিয়ে নিই, কারণ এক বিরাট বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। আসছি সে কথায় পরে।

শংকর মঠ – এই মন্দিরটি লাল পাথরে তৈরি এবং মন্দিরের চূড়াটি শিবলিঙ্গের আকারে নির্মিত। বলা বাহুল্য, মন্দিরে বিগ্রহ অবশ্যই শিবলিঙ্গ।

অর্বুদা দেবী বা আধার দেবী মন্দির – চার হাজার দুশো আটষট্টি ফিট উঁচুতে অবস্থিত আবু পাহাড়ের রক্ষাকর্ত্রী অর্বুদা দেবীর এই মন্দির। মন্দিরে ওঠার জন্য তিনশো ষাটটি সিঁড়ি রয়েছে। অর্বুদা দেবীকে আধার দেবীও বলা হয়, কারণ লোকের বিশ্বাস যে, এই মন্দির কোন অবলম্বন ছাড়াই অবস্থান করছে। হিন্দিতে ‘আধার’ অর্থ অবলম্বনহীন।

অচলগড় – মাউন্ট আবু থেকে এগারো কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই অচলগড়। এখানে চতুর্দশ শতকে রানা কুম্ভর তৈরি একটি দুর্গ রয়েছে। এছাড়াও এখানে আছে অনেক হিন্দু ও জৈন মন্দির। এখানে অচলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরটি সবচেয়ে প্রাচীন। আটশো তেরো খ্রীস্টাব্দে নির্মিত হয় এটি। অচলেশ্বর মহাদেবও আবুর প্রসিদ্ধ দেবতা। এখানে কোন মূর্তি নেই, গর্ভগৃহে আছে শুধু এক গভীর গর্ত। বিশ্বাস যে, এই গর্তে শিবের পায়ের আঙুলের ছাপ রয়েছে।

গুরুশিখর – রাজস্থানের অর্বুদা পাহাড়ের শৃঙ্গ গুরুশিখর আরাবল্লী পর্বতশ্রেণীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এর উচ্চতা পাঁচ হাজার ছয়শো ছিয়াত্তর ফিট বা ১৭২২ মিটার। মাউন্ট আবু থেকে এর দূরত্ব পনেরো কিলোমিটার। গুরুশিখরে রয়েছে গুরু দত্তাত্রেয়র মন্দির। গুরু দত্তাত্রেয় ছিলেন শ্রীবিষ্ণু অবতার এবং ঋষি দম্পতি অত্রি ও অনুসূয়ার পুত্র।

সোমনাথ মহাদেবের মন্দির – এই মন্দিরটির পরিবেশও শান্ত। মন্দিরের ছাদের অঙ্কনশৈলী অভিনব।

ওম শান্তি ভবন – মাউন্ট আবুতে ব্রহ্মকুমারীর ওয়ার্ল্ড স্পিরিচুয়াল ইউনিভার্সিটি এবং মিউজিয়াম রয়েছে। এই স্পিরিচুয়াল ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে আর্ট গ্যালারি, স্পিরিচুয়াল মিউজিয়াম, রাজ যোগ মেডিটেশন হল, ইউনিভার্সাল পিস হল। এই হলে একসঙ্গে তিন থেকে চার হাজার মানুষ বসতে পারেন।

পিস পার্ক – গুরুশিখর এবং অচলগড়ের মধ্যে অবস্থিত এই পিস পার্ক, ব্রহ্মকুমারীর দ্বারাই নির্মিত। এই পার্কের অপূর্ব ফুলের শোভা এবং শান্ত পরিবেশ মনকে মুগ্ধ করে।

হানিমুন পয়েন্ট – এই জায়গাটি নাক্কি লেকের উত্তর পশ্চিমে পাহাড়ের ওপর। এখান থেকে পাহাড় আর উপত্যকার সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। নববিবাহিত বা প্রেমিক প্রেমিকার জন্য আদর্শ জায়গা।

এবার চলে আসি মাউন্ট আবুর প্রধান আকর্ষণ, যার জন্য দেশ বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসেন – সেই দেলওয়াড়া মন্দিরের কথায়। এই সেই পরম আশ্চর্য, যা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম। বাইরে থেকে দেখলে মন্দিরের বিশেষত্ব সেভাবে হয়তো চোখে পড়বে না। পাহাড় এবং গাছ গাছালির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই মন্দির তখনই নিজেকে মেলে ধরবে যখন আপনি প্রবেশ করবেন এর ভেতরে। এটুকু লিখে আমার মনে হল এ কি ভারতীয় দর্শনের কথা নয়? বাইরের রূপ নয়, অন্তরের সৌন্দর্য অনুভব করো, তবেই তো শুনতে পাবে তাঁর পায়ের শব্দ। এই মন্দির চত্বরে মোট পাঁচটি জৈন শ্বেতাম্বর মন্দির রয়েছে। ভিমল ভাসাহি, লুনা ভাসাহি, পিত্তলহর, খট্টর ভাসাহি (পার্শ্বনাথ) এবং মহাবীর স্বামী। এই পাঁচটি মন্দিরই ভিন্ন ভিন্ন শতকে নির্মিত হয়েছিল। প্রথম দুটি মন্দির তৈরি হয় সম্পূর্ণ সাদা মার্বেল পাথর খোদাই করে। এই দুটি মন্দিরের থাম, দরজা, দেওয়াল, মণ্ডপ, তোরণ, ভেতরের ছাদ – কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা হয়তো খালি নেই, যেখানে নেই মার্বেলের অসাধারণ কারুকার্য। ফুলের নকশা, পদ্মফুলের লকেটের মত ঝুলন্ত নকশা, বিভিন্ন জৈন তীর্থংকরদের জীবন কাহিনি, বিভিন্ন দেব দেবী, হিন্দু ও জৈন পুরাণ কাহিনি, নানা ধরণের নৃত্যরত মূর্তি অপূর্ব ভঙ্গিমায় অনেকটা ত্রিমাত্রিকভাবে এখানে খোদাই করা হয়েছে সাদা মার্বেল পাথরে। মন্দিরের ভেতরে যখন প্রবেশ করলাম তখন আমি আর আমাতে নেই, হারিয়ে গেছি ঐ অপূর্ব শিল্পসৌন্দর্যের অনুপম অশ্রুত সঙ্গীতের মধ্যে। সবথেকে আশ্চর্য ভেতরের ছাদের কারুকার্য। কি অমানুষিক দক্ষতায় শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছেন সেগুলি কল্পনাতেও আনতে পারি না। চোখে জল আসছিল আমার – আবেগে আর উন্মাদনায় – এই আমার ভারতবর্ষ। বছরের বছর দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির অগণিত শিল্পীর অনবদ্য সৃষ্টিকে বুকে নিয়ে, যাঁদের নাম আজ হয়তো কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা বিদেশে যাই, সেখানকার গল্প ফলাও করে বলি, লিখি কিন্তু আমারই দেশে যে শিল্পসুষমা পথে ঘাটে ছড়িয়ে আছে, তার খবর রাখি কই? এই দেলওয়াড়া মন্দিরের মার্বেল পাথরের অনুপম সঙ্গীত ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। আমাদের সঙ্গে দেখতে থাকা ইংল্যাণ্ডের ব্র্যাডফোর্ড থেকে আসা এক বৃটিশ নাগরিকের অভিব্যক্তিতে বলি – ‘Unimaginable’ – ‘অকল্পনীয়’, চোখে না দেখলে এই সৌন্দর্য অনুভব করা যায় না। আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এই মন্দির দেখে বলে ছিলেন, ‘I do not think that any Indian should miss paying a visit to those temples, which are among the most beautiful sight of this country.’

এই দেলওয়াড়া মন্দির সম্পর্কে অল্প কথায় লেখা প্রায় অসম্ভব। তবু এই স্বল্প পরিসরে মন্দিরের সামান্য কিছু ইতিহাস বলে নিই। ভিমল ভাসাহি মন্দিরটি প্রথম জৈন তীর্থংকর আদিনাথজীর প্রতি উৎসর্গীকৃত। এটি সবথেকে প্রাচীন মন্দির – তৈরি হয় এক হাজার একত্রিশ খ্রীস্টাব্দে। গুজরাতের সোলাংকিরাজ প্রথম ভীমদেবের মন্ত্রী ভিমল শাহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। চোদ্দ বছর ধরে পনেরোশো শিল্পী এবং বারোশো শ্রমিক এটি তৈরি করেন। বিখ্যাত স্থপতি কীর্থিধরের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে এই মন্দির। আবুরোড থেকে চোদ্দ কিলোমিটার দূরে অম্বাজীর কাছে আরাসুরি পাহাড় থেকে হাতির পিঠে করে মার্বেল আনা হত এখানে।

লুনা ভাসাহি মন্দিরটি নির্মাণ করেন সোলাংকিরাজ দ্বিতীয় ভীমদেবের মন্ত্রীদ্বয় বাস্তুপাল এবং তেজপাল। তেজপাল তার মৃত ভাই লুনার স্মৃতিতে তৈরি করেন এই মন্দির। স্থপতি ছিলেন শোভনদেব। মন্দির উৎসর্গীকৃত হয় বাইশতম তীর্থংকর নেমিনাথের প্রতি। এখানে আছে দশটি হাতি – অনবদ্য সৃষ্টি মার্বেলের। তবে তা জাফরির মধ্য দিয়ে দেখতে হল। ওটি হস্তীশালা।

তৃতীয় মন্দির পিত্তলহর নির্মিত হয় আহমেদাবাদের সুলতান বেগাদার মন্ত্রী ভীম শাহের দ্বারা। পাঁচটি ধাতু বিশেষ করে পিতল দিয়ে তৈরি ঋষভদেবের একটি বিশাল মূর্তি আছে এখানে। তাই এর নাম পিত্তলহর। মনে করা হয় ১৩১৫ থেকে ১৪৩৩ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে নির্মাণ হয় এই মন্দির।

পার্শ্বনাথ মন্দিরটি তেইশতম জৈন তীর্থংকর পার্শ্বনাথের প্রতি উৎসর্গীকৃত। এই মন্দির ১৪৫৮-৫৯ খ্রীস্টাব্দে মাণ্ডিক ও তার পরিবারের দ্বারা তৈরি হয়।

শ্রী মহাবীর স্বামীর মন্দিরটি সবথেকে ছোট এবং এটি পার্শ্বনাথ মন্দিরের কাছেই অবস্থিত।

দেলওয়াড়া মন্দিরের সৌন্দর্য লিখে বোঝানো যায় না। এই মন্দিরে ক্যামেরা নিষিদ্ধ, তাই মনেই বন্দী করে রাখলাম এই অনুপম শিল্পশৈলীকে। দেলওয়াড়ার পর আর কোন কিছুই চোখে লাগে না। মাউন্ট আবু দর্শন একরকম সমাপ্ত যদিও বাকি রয়ে গেল অনেককিছুই। পরের সংখ্যায় আসব রাজস্থানের আর এক আকর্ষণকে সঙ্গে নিয়ে। পায়ে তো চাকা লাগানোই আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE