E-Paper

বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হানা হতেই এল পাক ফোন

‘অপারেশন সিঁদুর’-এ আপাতত বিরতি পড়লেও নয়াদিল্লি মনে করছে, পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে পাকিস্তানের উপরে সামরিক প্রত্যাঘাতে তিনটি লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। পাকিস্তানের সেনা হামলার জবাবে ভারতের প্রত্যাঘাতে ৩৫-৪০ জন পাকিস্তানি সেনার মৃত্যু হয়েছে।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ০৭:২০

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

তিনটি লক্ষ্য। সামরিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক।

‘অপারেশন সিঁদুর’-এ আপাতত বিরতি পড়লেও নয়াদিল্লি মনে করছে, পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে পাকিস্তানের উপরে সামরিক প্রত্যাঘাতে তিনটি লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। পাকিস্তানের সেনা হামলার জবাবে ভারতের প্রত্যাঘাতে ৩৫-৪০ জন পাকিস্তানি সেনার মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়েছে। যদিও পাকিস্তানের সেনাকে নিশানা করা ভারতের উদ্দেশ্য ছিল না। আসল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদী শিবিরে হামলা। সামরিক ভাবে পাকিস্তানে বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে, মুজফ্‌ফরাবাদের জঙ্গি ঘাঁটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে ভারত বার্তা দিয়েছে, সন্ত্রাসকে আর স্বাভাবিক রোজকার ঘটনা হিসেবে ধরা হবে না। সীমান্ত পারের সন্ত্রাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সিন্ধু জল চুক্তিও স্থগিত থাকবে। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ভারত এ বার পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের সীমা পেরিয়ে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে হানা দিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই ভারত এ বার পাকিস্তানকে ‘ঘরে ঢুকে’ মেরেছে।

সরকারি সূত্রের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশ ছিল, ও-দিক থেকে গুলি চললে এ-দিক থেকে গোলা চলবে। সেই নীতি মেনেই পাকিস্তান ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন, ইউএভি নিয়ে হামলা করায় এবং ভারতের বায়ুসেনা ঘাঁটির ক্ষতির চেষ্টা করায় পাল্টা জবাবে পাকিস্তানের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। সেনা সূত্রে বলা হয়, ভারত ১১টি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হানা দেয় ও লাহোর-সহ একাধিক রেডার ব্যবস্থা ধ্বংস করে। তার পরই পাকিস্তানের ডিজিএমও ফোন করে সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব দেন।

শনিবার পাকিস্তানের ডিজিএমও (ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস) ভারতের ডিজিএমও-র সঙ্গে কথা বলার পরে দু’দেশ আপাতত সামরিক আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পরেই ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ আপাতত বিরতির সিদ্ধান্ত হয়। সোমবার বেলা ১২টায় ফের দু’দেশের ডিজিএমও কথা বলবেন। এর পরে, তাতে এই সংঘর্ষবিরতির মেয়াদ কী ভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে।

কিন্তু এই আচমকা সংঘর্ষবিরতির পরে প্রশ্ন ওঠে, এতে ভারতের কোন লক্ষ্য পূরণ হল?

খোদ প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল ভি পি মালিক এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মত ছিল, ভারত ফের একবার পাকিস্তানকে বাগে পেয়েও পিছু হটল। আজ সেনার ডিজিএমও, বায়ুসেনার ডিজিএও (ডিরেক্টর জেনারেল অব এয়ার অপারেশনস) ও নৌসেনার ডিজিএনও (ডিরেক্টর জেনারেল অব নেভাল অপারেশনস) একসঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেছেন, ‘অপারেশনস সিঁদুর’ তার লক্ষ্য পূরণে সফল। ডিজিএমও লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাইয়ের বক্তব্য, ‘‘অপারেশন সিঁদুর-এর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিকে নিশানা করা। সেই লক্ষ্য অবশ্যই পূরণ হয়েছে।’’ তাঁর যুক্তি, সামরিক হানায় ইউসুফ আজহার, আবদুল মালিক রউফ, মুদাস্সির আহমেদের মতো সন্ত্রাসবাদীরা নিহত হয়েছে। যারা আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণ ও পুলওয়ামার সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ন’টি জঙ্গি ঘাঁটিকে নিশানা করা হয়েছে। ১০০ জনের বেশি সন্ত্রাসবাদী নিহত। তবে ডিরেক্টর জেনারেল এয়ার অপারেশনস এয়ার মার্শাল এ কে ভারতী বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য প্রাণহানি ছিল না। প্রাণহানি হয়ে থাকলে তার সংখ্যা গোনা ওদের কাজ। আমাদের কাজ ছিল লক্ষ্যে নিশানা।’’

কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে এ বার ভারত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে দিয়েছে। সেই অভিযানে বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে ও মুজফ্‌ফরাবাদের জঙ্গি ঘাঁটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সন্ত্রাসের ঘাঁটি মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। তাই হয়েছে। এর মধ্যে জইশ-ই-মহম্মদের বাহাওয়ালপুরের শিবিরে হামলা আসলে আইএসআই-কে শাস্তি হিসেবে দেখছে ভারতের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনী। কারণ আইএসআই জইশ-ই-মহম্মদ তৈরি করেছিল। সামরিক বাহিনীর এক কর্তা বলেন, ‘‘এ বার সাপের মাথায় লাঠি মারা হয়েছে।’’ ডিজিএমও বলেন, ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরে পাকিস্তানের সেনা ড্রোন, ইউএভি-র মাধ্যমে ভারতে হামলা চালিয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি চালানো হয়েছে। তাই পাল্টা জবাব দিতে হয়েছে ভারতকে। ভারতের পাঁচ জন জওয়ান মারা গিয়েছেন। পাকিস্তানের ৩৫-৪০ জন সেনা মারা গিয়েছেন। যদিও ভারতের সেনা পাকিস্তানি সেনার মৃত্যুর সংখ্যা গুনছে না। কারণ, লক্ষ্য পাকিস্তানের সেনা ছিল না।

সরকারি সূত্রের বক্তব্য, রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে ভারত সন্ত্রাসের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তিকে জুড়ে দিয়েছে। পহেলগামের পরেই সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছিল বিদেশ মন্ত্রক। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ বিরতি পড়লেও সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতই থাকছে, যত দিন না সীমান্ত পারের সন্ত্রাস বন্ধ হবে। পহেলগামের পরে ভারতের অবস্থানই হল, আগের মতো সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে চলবে না। যথেষ্ট হয়েছে বলে ভারত এ বার পাকিস্তানকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসে মদত দেবে, অথচ জল বণ্টনে সহযোগিতা আশা করবে, তা চলবে না। এটাই ‘নিউ নর্মাল’।

মনস্তাত্ত্বিক লক্ষ্য পূরণ হিসেবে মোদী সরকারের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, ভারত এ বার থেকে সন্ত্রাসকে যুদ্ধ হিসেবে দেখবে বলে নতুন রণনীতি নিয়েছে। যার অর্থ, যুদ্ধের মোকাবিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই করা হবে। শুধু তা-ই নয়। ভারত এ বার পাকিস্তানের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভারতে ঢুকে হামলা চালিয়েছে। প্রথমে সন্ত্রাসবাদী শিবির। তার পরে সারগোদার মতো পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বায়ুসেনা ঘাঁটিতে ভারত হামলা চালিয়েছে। যেখানে পাকিস্তানের অত্যাধুনিক বিমান থাকে। বার্তা স্পষ্ট, যতই পাকিস্তানের গভীরে সন্ত্রাসবাদীরা লুকিয়ে থাকুক, তাকে নিশানা করা হবে। পাকিস্তান এ বার কিছু করার আগে দু’বার ভাববে। তারা জেনে গিয়েছে, কী জবাব আসছে। ভারতের সামরিক ক্ষমতা, কৌশল ও প্রস্তুতিও পাকিস্তান টের পেয়েছে। ডিরেক্টর জেনারেল অব নাভাল অপারেশনস ভাইস অ্যাডমিরাল এ এন প্রমোদ বলেন, ‘‘এ বার পাকিস্তান যদি কোনও পদক্ষেপের দুঃসাহস দেখায়, তা হলে পাকিস্তান জানে কী হতে চলেছে।’’

আজ প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর কর্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। তার পরে সেনাপ্রধানও সেনাকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। শনিবার সংঘর্ষবিরতির সিদ্ধান্তের পরেও পাকিস্তান তা লঙ্ঘন করেছিল। ডিজিএমও-র বক্তব্য, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। রবিবারও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেনাপ্রধান তার আগেই নির্দেশ দেন, ইউএভি বা ড্রোনের মাধ্যমে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন হলে পাল্টা মার দিতে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বায়ুসেনাও জানায়, ‘অপারেশন সিঁদুর’ শেষ হয়নি। সেনা সূত্রের বক্তব্য, ওরা গুলি চালালে পাল্টা গুলি চলবে। ওরা হামলা চালালে, পাল্টা হামলা চলবে। যদিও সংবাদসংস্থা সূত্রে খবর, রবিবার এক বিবৃতিতে পাকিস্তান জানিয়েছে, তারা ভারতের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে সংঘর্ষবিরতি বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের বাহিনীও পুরো বিষয়টি দায়িত্বশীল ও সংযতভাবেই দেখছে।

আজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ লখনউতে নতুন ব্রহ্মোস এরোস্পেস টেস্টিং ফেসিলিটির উদ্বোধনে বলেন, ‘‘অপারেশন সিঁদুর শুধু সামরিক পদক্ষেপ নয়। সামরিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। জঙ্গি ও তার প্রভুদের জন্য এখন সীমান্তের ও পারের মাটিও সুরক্ষিত নয়।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Operation Sindoor India-Pakistan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy