বর্ধমানের সীতাভোগ, মাইসুরুর মাইসোর পাক কিংবা মথুরার পেড়ার মতোই তাজমহলের শহর আগরার পেঠার নাম মিষ্টান্নপ্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের জেরে উত্তরপ্রদেশের সেই প্রাচীন মিষ্টান্নশিল্প চরম সঙ্কটের মুখে।
তাজদর্শনে আগরায় গেলে এই মিষ্টি চেখে দেখেন অনেকেই। আগরার পেঠা খেতে খানিকটা নরম ক্যান্ডির মতো। কখনও সাদা কখনও আবার রঙিন হয় পেঠা। মিষ্টির এই পদটি মূলত তৈরি হয় চালকুমড়ো দিয়ে। তার সঙ্গে মেশানো হয় এলাচদানা, পেস্তা বাদাম এবং জাফরান। আয়তকার সেই মিশেল চিনির রসে ঢিমে আঁচে ফুটিয়ে পেঠা তৈরি করা হয়। আর তা করতে গিয়ে দূষণ ছড়ায় বলে অভিযোগ।
তাজমহল থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে নূরি গেট এলাকাতেই মূলত পেঠার কারখানাগুলি রয়েছে। জনশ্রুতি মোগল সম্রাট শাহজাহনের জমানাতেই আগরার শাহি রসুইয়ে প্রথম তৈরি হয়েছিল পেঠা। মোগল জমানায় সেই কারিগরদের বংশধরেরা পরবর্তী সময় ডেরা বেঁধেছিলেন নূরি গেট এলাকায়। এখন সেখানে রয়েছে প্রায় এক হাজার পেঠা কারখানা। ৫০০ কোটি টাকার পেঠা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ৫০০০-এরও বেশি মানুষ।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশপ্রেমী সংগঠনগুলি অভিযোগ তুলেছে, যমুনা নদীর তীরে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম সৌধটির শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথরকে ‘কালিমালিপ্ত করছে’ অদূরের পেঠা শিল্পতালুক! যদিও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর দু’বছর আগেকার রিপোর্ট বলছে, ‘তাজের কলঙ্কের’ নেপথ্যে দূষণই এক মাত্র কারণ নয়। সাদা মার্বেল পাথরের রং বদলে যাওয়ার নেপথ্য রয়েছে ‘গোল্ডিকিরনোমাস’ নামক বিশেষ এক ধরনের পোকা। যমুনা নদীর দূষিত জলই সেই পোকার আঁতুড়ঘর বলেও জানানো হয়েছিল পুরাতত্ত্ববিদ রাজকুমার পটেলের নেতৃত্বাধীন গবেষকদলের রিপোর্টে।
কিন্তু গত এপ্রিলে শীর্ষ আদালত একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে সমস্ত পেঠা কারখানাকে ‘তাজ ট্র্যাপিজিয়াম জ়োন’-এর বাইরে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। অগস্টের শেষ থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার তা কার্যকর করতে তৎপরতা শুরু করেছে। ‘তাজ ট্র্যাপিজিয়াম জ়োন’ হল আগরা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাকে ঘিরে থাকা ১০৪০০ বর্গ-কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এলাকা। যেখানে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল’ হিসাবে স্বীকৃতি মোগল যুগের তিনটি সৌধ রয়েছে— তাজমহল, আগ্রা দুর্গ এবং ফতেপুর সিক্রি। রয়েছে, মোগল সম্রাট আকবরের সমাধি সেকেন্দ্রা-সহ জাতীয় স্তরের স্বীকৃত আরও ৪০টি সৌধ। এই পরিস্থিতিতে পেঠা কারখানাগুলিকে আগরা শহরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পুনর্বাসন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার।
২০১৩ সালে দূষণ ঠেকাতে উত্তরপ্রদেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পেঠা শিল্পে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। এর পরে কারখানাগুলি গ্যাসের ব্যবহার চালু করে। পেঠা নির্মাতা গিরিশ সিঙ্ঘলের অভিযোগ, প্রায় দু’দশকের পুরনো একটি সমীক্ষা রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল পেঠা শিল্পকে নিশানা করেছে। তিনি বলেন, ‘‘এখন আর আমাদের কারখানাগুলি কোনও দূষণ ছড়ায় না।’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, আগরা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে পুনর্বাসন দেওয়া হলে, অধিকাংশ কারখানা মালিকই সেখানে যাবেন না। কারণ, সে ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওখানে যাওয়ার চেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া অনেক ভাল।’’