ডিটেক্ট (চিহ্নিতকরণ), ডিলিট (ভোটার তালিকা থেকে নাম বাতিল) ও ডিপোর্টেশন (বিতাড়ন)— এই তিন ডি-এর সূত্র ধরে দেশকে অনুপ্রবেশকারী-মুক্ত করার পরিকল্পনা হয়েছে বলে জানালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আজ দিল্লির একটি আলোচনাসভায় তিনি বলেন, ‘‘শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীদের এক পাল্লায় বসানো অনুচিত।’’
শাহের দাবি, অনুপ্রবেশের কারণে দেশে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আজ না হোক কাল তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যেতেই হবে। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু শরণার্থীদের এ দেশের ততটাই অধিকার রয়েছে যতটা এক জন ভারতীয়ের রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে শাহের ওই মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনীতিকেরা। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা মতুয়া জনসংখ্যার চিন্তার যে কিছু নেই তা আজ ফের পরোক্ষে বুঝিয়েদিলেন শাহ।
অনুপ্রবেশ প্রশ্নে তৃণমূলের যুক্তি, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকে বিএসএফ। যা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে। তাই এ দেশে অনুপ্রবেশের দায় অমিত শাহের। আজ যাবতীয় অনুপ্রবেশের দায় স্বীকার করে নিয়ে শাহ বলেন, ‘‘বিএসএফ আমার
আওতায়। তাই দায়ও আমার। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এমন এলাকা রয়েছে যেখানে ভূপ্রকৃতি বন্ধুর। কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত লাগানো সম্ভব নয়। নদী-নালা, জলাভূমি রয়েছে। ফলে অনুপ্রবেশ রোখার চেষ্টা করলেও, হয়েই যায়।’’ শাহের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ধরে নিলাম অনুপ্রবেশ হল, কিন্তু সেই ব্যক্তি যাবে কোথায়? প্রথম যে জেলা রয়েছে সেই জেলার গ্রামে যাবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী গ্রামের পটওয়ারি (স্থানীয় প্রশাসনের লোক) পুলিশের কাছে কোনও অনুপ্রবেশকারীর নামে কোনও অভিযোগ জানায়নি। কেন? তা ছাড়া ওই অনুপ্রবেশকারীদের আধার কার্ডের ছাড়পত্র কে দেয়? স্থানীয় জেলা প্রশাসন। ফলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য কোনও ভাবেই দায় এড়াতে পারে না। আসলে অনুপ্রবেশকারীদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে দেখতে শুরু করলেই সমস্যার শুরু হয়।’’
পরিসংখ্যান তুলে ধরে শাহ আজ দাবি করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশে মুসলিম জনসংখ্যার অংশ ২৪.৬ শতাংশ বেড়েছে। সেখানে হিন্দু জনসংখ্যার অংশ ৪.৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। তাঁর বক্তব্য, মুসলিমদের ওই সংখ্যা জন্মহারের কারণে নয়, অনুপ্রবেশের ফলে লাফিয়ে বেড়েছে। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এবং কিছু এলাকায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। যা দেশের নিরাপত্তার জন্য চিন্তার বলেই মনে করেন স্বরাষ্ট্রকর্তারা। তাই অনুপ্রবেশকারীরা নন, দেশের প্রকৃত বাসিন্দা যাঁরা, তাঁরাই যাতে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিতে পারেন সে কারণে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনে হাত দিয়েছে বলে আজ দাবি করেন শাহ।
বিহারের পরে দেশ জুড়ে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনে হাত দিতে চলেছে নির্বাচন কমিশন। যা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে বিরোধী দলগুলি। আগুন নিয়ে না খেলার হুমকি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহের মতে, কংগ্রেস বা তৃণমূলের মতো দলগুলি তালিকা সংশোধনের ফলে ‘অনুপ্রবেশকারী ভোটব্যাঙ্কে’ ধসের আশঙ্কাতেই বিরোধিতা শুরু করেছে। শাহের কথায়, ‘‘অনুপ্রবেশকারীরা এ দেশে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি করছে, স্থানীয়দের কাজের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। জনজাতির জমি কব্জা করে নিচ্ছে। তাই দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে ভোটার তালিকার সংশোধনের মাধ্যমে এদের প্রথমে চিহ্নিতকরণ, দ্বিতীয় ধাপে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, তৃতীয় ধাপে নিজেদের দেশে পাঠানো হবে। এই কাজ হবেই। কেউ যেন কোনও সংশয় না রাখে।’’
বিরোধীদের অনেকের বক্তব্য, হিন্দুরা অন্য দেশ থেকে এলে শরণার্থীর মর্যাদা পান। সেখানে মুসলিমেরা এ দেশে পালিয়ে এলে কেন শরণার্থীর তকমা পাবেন না। আজ শাহ বলেন, ‘‘শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীদের একাসনে বসানো অনুচিত। স্বাধীনতার সময়ে পাকিস্তানে ১৩% হিন্দু ছিলেন। এখন মাত্র ১.৭৩%। বাংলাদেশও একই ভাবে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে। প্রতিবেশী দেশগুলির হিন্দু জনসমাজ ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছেন। তা ছাড়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু শরণার্থীদের এ দেশের উপর অধিকার রয়েছে। অনুপ্রবেশকারীদের তা নেই। তাই তাদের ফেরত পাঠানো হবে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)