রাষ্ট্রপতি ভবনটা যদি একবার ঘুরে দেখা যেত...!
বাবা-মা জানেনই, তাঁদের বড় ছেলের উদ্ভট সব ইচ্ছে। তাই এই কথাটা শুনেও ঘাবড়ে যাননি। তাঁরা বরং ছেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেই ভয় পেয়ে যান। ভাবেন, সব ঠিকঠাক আছে তো।
আদৌ রাষ্ট্রপতি ভবন ঘুরে দেখা সম্ভব কি না, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না তখন। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারছিল না ঠিক করে। আমিও একবগ্গা। প্রয়োজনে কীর্ণাহারের মুখুজ্জে বাড়ি থেকে একখানা চিঠিপত্র বাগিয়ে রাইসিনা হিল
যাবই যাব।
সহকর্মী সুজিতদাকে চেপে ধরতেই আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলেন। এ দিকে ইন্টারনেট ঘেঁটেঘুঁটে মোটামুটি সব রেডি করে ফেলি। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি ভবন পরিদর্শন শুধু সম্ভবই নয়, চাইলে ঘরে বসেই ইন্টারনেটে আগাম বুকিং করতে পারেন। সপ্তাহে তিন দিন, শুক্র, শনি ও রবিবার। আপনার ছবি ও আইডি আপলোড করতে হবে। সেই সঙ্গে সামান্য প্রবেশ মূল্য।
হিমগিরি এক্সপ্রেসের টিকিট আম্বালা অবধি। প্রথমে যাব কুরুক্ষেত্র, দিন দুয়েক ওখানে কাটিয়ে দিল্লি। তবে কুরুক্ষেত্রের গল্প বলছি না, এখানে শুধুই দিল্লি। যে রাতে দিল্লি পৌঁছলাম, বেশ ঠান্ডা। পাহাড়গঞ্জের দিকে বেরিয়ে বাজারের মধ্যেই হোটেল নিয়ে নিলাম। কেলেঙ্কারিটা হলে ফ্রেশ হওয়ার পরেই। সাদা ধবধবে বিছানায় একটা বিছে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। হোটেলের কর্মী ও আমরা একযোগে চিরুণী তল্লাশি চালিয়েও খুঁজে পেলাম না। ফলে ম্যানেজার কিছুতেই মানতে চাইলেন না তাঁদের হোটেলে বিছে আছে। খাওয়া দাওয়ার পর তাই অগত্যা বিছের হাতে সঁপে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল পরের দিন সকাল ছ’টা নাগাদ। নিজে তৈরি হয়ে ডেকে দিলাম সুজিতদাকে। সকাল ন’টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনের ৩৭ নম্বর গেটে উপস্থিত হতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি গন্তব্য হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
চেপে বসলাম টুকটুকে। একটা ক্রসিংয়ের কাছে নামিয়ে দিলেন চালক। জানালেন, এর পর হেঁটে যেতে হবে। দিল্লি দেখতে দেখতে দাদা-ভাইয়ে হাঁটতে লাগলাম। অনেকটাই পথ। অবশেষে পৌঁছলাম ৩৭ নম্বর গেটে। একপ্রস্থ খানাতল্লাশির পর বাহারি গাছগাছালির বাগান পাশে নিয়ে হাঁটতে থাকি। সামনে তাকিয়ে দেখি একটু একটু করে পুরনো ভাইসরয় হাউস, অধুনা রাষ্ট্রপতি ভবন ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কী যেন কেন, বুক ঢিপঢিপ করে উঠল, গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে এল। আনন্দ-উত্তেজনাতেই বোধ হয়।
কখন যে হাঁটা বন্ধ করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ও ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক জন ডাকল। —‘‘কী ব্যাপার? কী চাই?’’ দেখালাম টিকিট। উনি একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ছবি তুলে নেওয়া হলো। তার পর আর এক রাউন্ড তল্লাশি করা হল। এ বার অপেক্ষা। কখন অনুমতি মিলবে।
আমাদের মতো অপেক্ষায় ছিলেন আরও অনেকে। দিল্লি শহরতলির একদল ছাত্রী এসেছিল। সঙ্গে দিদিমণিরাও। আবার কেরল থেকে এসেছিলেন একদল মহিলা। একই শাড়ি, সোনালি রঙের। শাড়ি পরার ধরনটাও এক রকম। মাথায় রঙবেরঙের ফুল। আলাপের আগ্রহ জন্মালেও ভাষাগত বুৎপত্তির অভাবে এগোতে সাহস হল না।
অবশেষে মিলল অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি। বিরাট বিরাট ঘর। শুনেছি রাষ্ট্রপতি ভবনে ৩৪০টি ঘর আছে। বৈভব, বিত্ত ও প্রাচুর্যের সমাহার। নানা তৈলচিত্র, পাণ্ডুলিপি, দেশবিদেশের নানা উপহার। গাইড ভদ্রলোক ভবনের যে অংশে রাষ্ট্রপতি সপরিবার থাকেন, সে দিকে নির্দেশ করলেন। দেখালেন রাষ্ট্রপতি ভবনের বিশাল লাইব্রেরিটাও। মুঘল গার্ডেনটা দেখে বিশেষ মন ভরল না। ফুল ধরেনি যে।
ইন্ডিয়া গেট থেকে আপাত খাড়া হয়ে উঠে যাওয়া রাস্তা বরাবর তাকালেই রাইসিনা হিলের মুকুট রাষ্ট্রপতি ভবন। দুই হাতে নর্থ ও সাউথ ব্লক। অর্থাৎ এক হাতে দিনযাপনের কড়ি, আর অন্য হাতে নাগরিক নিরাপত্তার বজ্র নিয়ে ইন্ডিয়া গেটের দিকে তাকিয়ে গণতান্ত্রিক ভারতের তামাম ভারতবাসীকে বরাভয় দিচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy