Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হিলারি স্টেপ নেই, দাবি আনসুর, চোখে ভাসছে বন্ধু গৌতমের মরদেহ

সদ্য গুয়াহাটি ফেরা আনসু আজ এক আলাপচারিতায় নিজের এভারেস্ট অভিযানের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। হিলারি স্টেপ নেই বলে এবারের পশ্চিমী পর্বতারোহীরা দাবি করলেও পরে নেপালি শেরপাদের একাংশ দাবি করে 'হিলারি স্টেপ' রয়েছে। চূড়ার কাছে কার্নিসের মতো বেরিয়ে থাকা এক প্রস্তরখণ্ডের নাম হিলারি স্টেপ।

বিশ্ব রেকর্ড গড়া আনসু জানসেমপা। নিজস্ব চিত্র

বিশ্ব রেকর্ড গড়া আনসু জানসেমপা। নিজস্ব চিত্র

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৭ ১১:২২
Share: Save:

না, এত দিনের পরিচিত 'হিলারি স্টেপ' নেই। নিশ্চিত করেই বলছেন পাঁচ দিনের মধ্যে দু'বার এভারেস্ট চড়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়া আনসু জানসেমপা। সেই সঙ্গে তিনি জানান, নজির গড়েও সে ভাবে আনন্দে শরিক হতে পারছেন না তিনি। কারণ সর্বক্ষণ চোখে ভাসছে এভারেস্ট জয় সেরে ফেরার পথে রাস্তায় দেখা বন্ধু পর্বতারোহী গৌতম ঘোষের মৃতদেহের ছবিটা।

সদ্য গুয়াহাটি ফেরা আনসু আজ এক আলাপচারিতায় নিজের এভারেস্ট অভিযানের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। হিলারি স্টেপ নেই বলে এবারের পশ্চিমী পর্বতারোহীরা দাবি করলেও পরে নেপালি শেরপাদের একাংশ দাবি করে 'হিলারি স্টেপ' রয়েছে। চূড়ার কাছে কার্নিসের মতো বেরিয়ে থাকা এক প্রস্তরখণ্ডের নাম হিলারি স্টেপ। আনসু বলেন, "এবার আমি দু'টি অভিযানের সময়ই ভাল করে দেখেছি। কিন্তু অতি পরিচিত হিলারি স্টেপ ছিল না। সে জন্য প্রথম বার ওঠার সময় আমি রাস্তাই চিনতে পারছিলাম না। ওই কার্নিসটা এভারেস্ট আরোহণকারীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা না থাকায় নর্থ রিজ দিয়ে ঘুরপথে আমায় উঠতে হয়েছে।" তিনি জানান, ভূমিকম্পের ফলে এভারেস্টের রাস্তায় বিস্তর বদল চোখে পড়েছে তাঁর। ২০১১ সালে দু'বার, ২০১৩ সালে তৃতীয়বার এভারেস্টজয়ী আনসু ২০১৪ সালের বিপর্যয় ও ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে প্রাণ নিয়ে বাঁচেন। তিনি এ দিন জানান, এভারেস্টের পথে হীমবাহ দ্রুত গলছে, চরিত্র বদলাচ্ছে। অনেকটা ওঠার পরে মই পাততে হচ্ছে। সাবধানে খুঁজতে হচ্ছে নতুন পথ।

গৌতম ঘোষের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "ওঠার সময় ১ ও ২ নম্বর বেসক্যাম্পে অনেক গল্প হয়েছিল। আমরা একসঙ্গে ছবি তুললাম। খুবই উত্তেজিত ছিলেন তিনি। যে হেতু আমি আগে যাচ্ছিলাম, বলেছিলেন আপনি রাস্তাটা তৈরি করে দিয়ে আসুন। আমি সেই পথেই যাব। ফেরার সময় আবার দেখা হবে। ফেরার পথে দেখা হল বটে। কিন্তু গৌতমের প্রাণহীন দেহটা দেখলাম। মাথা থেকে স্মৃতিটা যাচ্ছে না।"

নজির গড়েও বিশ্রাম নেবেন না তিনি। অরুণাচলের বাসিন্দা বলে চিন 'নর্থ কল' দিয়ে এভারেস্ট ওঠার ভিসা দেবে না তাঁকে। তাই ওই ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্টে ওঠা এবং অরুণাচলের দুর্গম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাংতে জয় করা তাঁর লক্ষ্য। কাংতেতে কেউ এখনও ওঠেনি। এখন রেইকি দল সেখানে বেস ক্যাম্পের জায়গা খুঁজতে গিয়েছে। পাশাপাশি, ভারতীয় মেয়েদের দল নিয়ে এভারেস্ট অভিযানে নেতৃত্ব দিতে চাইছেন আনসু।


ইতিহাস গড়ার সে দিন।

যে ভাবে এখন প্রচুর অনভিজ্ঞ লোক এভারেস্ট অভিযানে ভীড় বাড়াচ্ছেন- তার তীব্র প্রতিবাদ করে এ নিয়ে নেপাল সরকারকে কড়া পদক্ষেপ করার আবেদন রাখেন আনসু। তিনি বলেন, "অনভিজ্ঞরা রাস্তা আটকে দেন অনির্দিষ্টকাল। নিজেরা বিপদে পড়েন, অন্যদেরও বিপদে ফেলেন। অনেকে তো পায়ের ক্ল্যাম্পও বাঁধতে জানেন না। ভাবেন শেরপারা সব করে দেবে। প্রাণ বাঁচানোর উপায়গুলোও শিখে আসেন না তাঁরা।" তাঁর মতে, টাকা থাকলেই এভারেস্ট জয়ের স্বাদ নেব- এমন মানসিকতা ছাড়া উচিত।

২০০৯ সালে পর্বতারোহণে হাতিখড়ি। ২০১১ সালেই দুবার এভারেস্ট জয়ের অসাধ্য সাধন। তারপর থেকে নজিরের পর নজির। এই সাফল্য ও গ্ল্যামারের পিছনের কথা নিয়ে বই লেখার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর। বড় মেয়ে পাসাং দ্রোমা ইতিমধ্যে মা কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, মায়ের চেয়েও বেশিবার এভারেস্টে উঠবে। নিজের মেয়েরা মৃত্যুর মুখে যেতে চাইলে আটকাবেন না? সাহসিনী আনসু বলেন, "নিজের ইচ্ছে মেয়েদের উপরে চাপাই না। মেয়ে যেতে চাইলে উৎসাহই দেব। মা-মেয়ে একসঙ্গে একবার এভারেস্ট অভিযান করলেও মন্দ হয় না।"

আরও পড়ুন: পাঁচ দিনের ব্যবধানে দু’বার এভারেস্ট জয়, ইতিহাস আনসুর

নারী সবলীকরণের প্রথাগত ধারণাকে উড়িয়ে আনসু বলছিলেন, একবার নিজে গাড়ি চালিয়ে অরুণাচলের তুতিন যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ব্রেক ফেল। ভাগ্যক্রমে নদীর খাদে পড়ার মুখে নিজেই দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। পাশে বসা বান্ধবী তখন ভয়ে কাঁপছে। ওকে বললাম নীচে নেমে সামনের চাকার সামনে একটা পাথর রাখ। আমি গাড়ি ব্যাক করাব। গাড়ি পেছোনোর পরে, ওই পাথরটা সরাতে গিয়ে দেখি বান্ধবী একাই যে পাথর এনে চাকার সামনে রেখেছিল, এখন বিপদ কাটার পরে দু'জনে মিলেও তা সরাতে পারিনি। আসলে বিপদের মুখে পড়লে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল এক অসম্ভব শক্তি আসে ভিতরে। এতদিনের চাপের মুখে থেকে এ বার মেয়েদের মধ্যেও সেই শক্তি অনুভব করার সময় এসেছে। নিজেকেই সবল করতে হবে তাঁদের। আইন করে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের সঙ্গে লড়া যাবে না।

অরুণাচলে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস অ্যাকাডেমি খোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জনিয়েছেন তিনি। আনসু চান, অরুণাচলের অনামা, কিন্তু উঁচু শৃঙ্গগুলিতে পর্বতারোহীদের টানতে। তাঁর মতে, তেমনটা হলে রাজ্যের মানুষ, বিশেষ করে পাহাড়ের আশপাশে থাকা মানুষের রোজগার অনেকটা বাড়বে। রাজ্য সরকারও রাজস্ব পাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE