Advertisement
E-Paper

কোন খবর পাঠাব? কিছুই জানি না

৯ দিন যোগাযোগই করা যায়নি। অবশেষে ই-মেল পাঠাতে পারলেন আনন্দবাজারের সাংবাদিক৯ দিন যোগাযোগই করা যায়নি। অবশেষে ই-মেল পাঠাতে পারলেন আনন্দবাজারের সাংবাদিক

সাবির ইবন ইউসুফ

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০৩:৫৮
জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক পাহারায় সিআরপিএফ। ছবি: পিটিআই

জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক পাহারায় সিআরপিএফ। ছবি: পিটিআই

এই কপি পাঠাচ্ছি সরকারের তৈরি করে দেওয়া মিডিয়া সেন্টার থেকে। এটা একটা হোটেল। চারটে কম্পিউটার আছে। যদিও এখানে বসার সুযোগ পেতে-পেতেই একটা দিন কেটে গেল। কিন্তু কী খবর পাঠাব? আমি তো জানিই না, আমার পাশের পাড়ায় কী ঘটছে। আগামিকাল এই পরিষেবা ব্যবহারের সুযোগ পাব কি না, জানি না তা-ও।

জীবনে এই প্রথম বার ইদের আগের দিনে মায়ের সঙ্গে দেখা হল না। শ্রীনগর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে আমার ভাইয়ের কাছে থাকেন মা। জানি না মায়ের শরীর কেমন আছে। ভাই ডাক্তার। স্নাতকোত্তর পড়ছে শিশুরোগ চিকিৎসা নিয়ে। যোগাযোগ করা যায়নি ওকেও। আমার ৬ বছরের ছেলেটা জানতে চাইছে, কেন ওকে স্কুলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, কেন স্কুলবাস আসছে না, কেন ওর কাকা আর বন্ধুদের ফোন করা যাচ্ছে না। কী বোঝাব ওকে? বাইরে বেরোনোই তো মুশকিল। জীবনটা নরক হয়ে উঠেছে। ঘরে রসদ নেই, অসুস্থেরা হাসপাতালে যেতে পারছেন না। প্রতিটি রাস্তায় আধ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে কাঁটাতারের ব্যারিকেড। হাজার হাজার পুলিশ, আধাসেনা আর সেনার টহল।

১০ দিন ধরে কাশ্মীরে পুরোপুরি বন্‌ধের চেহারা। সরকার বলছে, গত রবিবার রাত থেকে উপত্যকায় ‘কড়া বিধিনিষেধ’ জারি হয়েছে। যেটা ইদের সকালে আরও বেড়েছে। কড়াকড়ি মানে তো কার্ফু। লোকের রাস্তায় বেরোনো বারণ। কয়েক জন সরকারি কর্তাকে কার্ফুর পাশ দেওয়া হয়েছে। অথচ সংবাদমাধ্যমকে তা দেওয়া হয়নি। মোবাইল, ল্যান্ডলাইন, ইন্টারনেটের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় খবরের কাগজ বেরোচ্ছে না। সর্বভারতীয় দৈনিকগুলোয় কী লেখা হচ্ছে জানি না। বাইরের খবর জানতে আমার এখন একমাত্র ভরসা টিভি। কিন্তু স্থানীয় খবর কোথায় পাব? কেব‌্‌ল টিভির খবরের চ্যানেল তো বন্ধ।

বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই গত সোমবার থেকে। সাংবাদিকদেরও গ্রেফতার করা হতে পারে, এই আশঙ্কায় ভুগছি। এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যেখানে কাশ্মীরের একটা শহরের মানুষ জানে না, অন্য শহরে কী ঘটছে। এর মধ্যেই মৃত্যু আর বিক্ষোভের গুজব রটছে। আর এই প্রথম বার এখানকার সাংবাদিকেরা (বিশেষত খবরের কাগজের) স্থানীয় পরিস্থিতি নিয়ে কোনও খবরই করতে পারছেন না। অফিস বা সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় নেই। সরকারি কর্তাদের কাছে গিয়েও লাভ হচ্ছে না। কাশ্মীর প্রেস ক্লাবের তরফে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এবং প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়াকে আর্জি জানানো হয়েছে, খবর চাপা দেওয়ার এই চেষ্টার বিরুদ্ধে তারা যেন সরব হয়।

মিডিয়া সেন্টারে এসে জানতে পারলাম, প্রবীণ এক সাংবাদিক দোরে দোরে ঘুরেছেন দিল্লিতে চাকরি করা মেয়ের সঙ্গে একটি বার যোগাযোগ করবেন বলে। জানলাম, মহসিন আহমেদ নামে বারামুলার এক বাসিন্দা গত তিন দিন ধরে শ্রীনগরে আটকে। বৌ-বাচ্চা আর অসুস্থ বাবা কেমন আছেন, জানেন না। গত বুধবার সন্ধ্যায় তিন বছরের অসুস্থ ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে গিয়ে রাস্তায় জনতা আর নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে আটকে পড়েছিলেন পুরনো শ্রীনগরের আইজাজ আহমেদ মির। এই অবস্থায় কে-ই বা আগাম সাবধান করবে ওঁকে? গাড়ি ফেলে ৫ কিলোমিটার হেঁটে হাসপাতালে পৌঁছেছেন আইয়াজরা।

কয়েক দিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে তারই গাড়িতে করে যেতে হয়েছিল শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হরি সিংহ হাসপাতালে। দেখেছিলাম হাসপাতাল খাঁখাঁ করছে। অধিকাংশ রোগীকেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, সপ্তাহখানেক আগে শহরের নানা এলাকা থেকে ছররায় আহত ১০ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। সেই শেষ। হাসপাতালের শীর্ষ পদাধিকারীদের আপাতত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা বারণ। তবে হাসপাতালেই আলাপ হয়েছিল নিশাত শহরতলির ইফতিকার আহমেদের সঙ্গে। ৫৫ বছরের প্রৌঢ় বলেছিলেন, ‘‘অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ক্রমাগত পুলিশের কাছে কাকুতি-মিনতি করে হাসপাতাল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তা আসতে আমার তিন ঘণ্টা লেগেছিল। এখন স্ত্রীর ছুটি হয়েছে, কিন্তু আমাদের বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। কারণ অ্যাম্বুল্যান্স বা ভাড়ার গাড়ি কোত্থাও নেই।’’

আসলে চারপাশের পরিস্থিতি দেখে স্থানীয় লোকেরা হতভম্ব। দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এবং মেহবুবা মুফতি-সহ উপত্যকার প্রথম সারির শতাধিক নেতা গ্রেফতার, আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা গৃহবন্দি, বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুককে গ্রেফতার করে কোনও গোপন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পিডিপি-র যুব সভাপতি ওয়াহিদুর রহমান এক সময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সভায় লোক জড়ো করেছেন। এখন একটি চ্যানেলে মুখ দেখানোর পরেই গ্রেফতার করে জনসুরক্ষা আইনে মামলা করা হয়েছে তাঁর নামে। এক সরকারি অফিসার বলেই ফেললেন, ‘‘যা ছিল, বিজেপি কেড়ে নিল। সব শেষ।’’

আপাতত এই আমাদের দিনযাপন। কিছুই জানি না। কোথায় কী ঘটছে, কবে সব স্বাভাবিক হবে, কিচ্ছু না!

Article 370 scrapped Media shut down Irregular internet connection
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy