Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভোটব্যাঙ্কের সৌজন্যেই জতুগৃহ অসম

আশঙ্কা আগেই ছিল। বাংলাদেশে জঙ্গি হানার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের আকাশে সিঁদুরে মেঘটা আরও লালচে হয়ে উঠেছে মাত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৮
Share: Save:

আশঙ্কা আগেই ছিল। বাংলাদেশে জঙ্গি হানার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের আকাশে সিঁদুরে মেঘটা আরও লালচে হয়ে উঠেছে মাত্র। এনআইএ, পুলিশ, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতারাও একমত, জতুগৃহে বাস করছেন অসমবাসী। যে কোনও দিন গুলশনের মতোই হামলা হতে পারে দিসপুর, পল্টনবাজার বা গণেশগুড়িতে। আইসিসের বার্তায় এর আগে একাধিকবার অসমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় হুজি ও জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের জঙ্গিরা। যা বেশি করে নজরে এসেছে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণোত্তর পর্বে। কিন্তু কাশ্মীরের পরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু জনসংখ্যা থাকা অসমে সক্রিয় জেএমবি সদস্যদের খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব বলে মেনে নিচ্ছে পুলিশও। তাই বাংলাদেশ কাণ্ডের পরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলি বিশেষ করে কাছাড়, করিমগঞ্জ, ধুবুরি এবং বরপেটা, নলবাড়ি, চিরাং, মরিগাঁও জেলার পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে। তার মধ্যেই এনআইএ জানতে পেরেছে বর্ধমান বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম ডোমকল থেকে অসমে পালিয়ে এসে আপাতত বরপেটা জেলায় গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে।

এনআইএ সূত্রে জানানো হয়েছে, বর্ধমান বিস্ফোরণে জড়িত রফিকুল এবং অসমের বরপেটা জেলার সর্থেবাড়ির জহিদুল ইসলাম এবং তরাবাড়ির শহিদুল ইসলাম এখনও ফেরার। রফিকুল মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বক্সিপুরে শ্বশুরের মিষ্টির দোকানে কাজ করার আড়ালে জেএমবির হয়ে কাজ করত। তার নামও চার্জশিটে রয়েছে। সম্প্রতি ফেরার রফিকুলের একটি ছবি আঁকেন স্কেচ শিল্পী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ছবিটি এনআইএ কলকাতা থেকে অসমে পাঠায়। পুলিশ সূত্রে খবর, রফিকুলের ছবি দেখে বরপেটা পুলিশের সূত্ররা জানিয়েছে, অনেকদিন থেকেই এমন চেহারার বহিরাগত এক যুবক সেখানে রয়েছে। বরপেটা, বাক্সা, চিরাং জেলা থেকে তিরিশ জনের বেশি জেএমবি সদস্যকে গত এক বছরে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ভাঙা হয়েছে তাদের তিনটি অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির। বিএসএফ সূত্রে জানা গিয়েছে রাজ্যের একটি রাজনৈতিক দল ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্য নিয়ে ধুবুরি থেকে বাছাই করা যুবকদের বাংলাদেশের চরে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বিএসএফের এক কর্তা জানান, এই অবস্থা এক দিনে হয়নি। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আগের সরকার ও সংখ্যালঘু দল-সংগঠনের সাহায্য নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশিদের বসতি। সেখানে নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশিরা। পেয়েছে প্যান কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্রও। সংবেদনশীলতার দোহাই দিয়ে সেখানে নিরাপত্তাবাহিনীকে কখনওই পুরোপুরি অভিযান চালাতে দেওয়া হয় না।

এনআইএর এক অফিসার জানান, এক দিকে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে অন্য দিকে ডিমাপুর থেকে এনএসসিএনের হাত ঘুরে অসমে অস্ত্রও ঢুকছে নাগাড়ে। শুধু জেএমবির হয়ে কাজ করাই নয়, চুরি-ডাকাতি-অপহরণ এবং চোরাশিকারে হাত রয়েছে এই অনুপ্রবেশকারীদের। এ দিকে আইসিস ও জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে। অবশ্য রাজ্যে নিশ্চিন্তে ঘাঁটি গেড়েছে বলেই অসমে বড় নাশকতা নাও করতে পারে জেএমবি। কিন্তু আইসিস যে ভাবে বৃহত্তর ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ার আদর্শ ছড়াচ্ছে সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও আশঙ্কা বেশি অসমের। রাজ্যের ২৭টি জেলার (সাম্প্রতিক জেলা বিভাজনের আগে) মধ্যে ন’টি জেলায় মুসলিমের সংখ্যা ৫০ থেকে ৭০ শতাংশের বেশি। মোট জনসংখ্যার ৩৪.২২ শতাংশ মুসলিম। সেই সঙ্গে রাজ্যে রয়েছে বিরাট বাংলাদেশি জনসংখ্যাও।

গত বছর রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট উপমন্যু হাজরিকা কমিশন গড়ে দিয়েছিল। হাজারিকা তিন দফায় রাজ্য ঘুরে দেখে চমকে যান। রাজ্যে বাংলাদেশিদের রমরমা ও দুর্বল সীমান্ত প্রহরা নিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও অবস্থা বদল হয়নি। তিনি জানান, কংগ্রেস আমলে সরকারের বদান্যতায় অবৈধ বাংলাদেশিরা শুধু রাজ্যে থাকার অধিকারই পায়নি, এ রাজ্যে তারা যে সুবিধে পাচ্ছে তা বাংলাদেশেও পায় না। দরং জেলার সিপাঝারে বহিরাগত বাংলাদেশিরা দখল করেছে ৭৭ হাজার ৪২০ বিঘা জমি। সেখানে থাকা ৭০ হাজার বাংলাদেশির মধ্যে ২৫ হাজারই এখন ভারতের ভোটার। অথচ ১৯৯৪ সালেই আদালত তাদের ‘অ-ভারতীয় ও বহিরাগত’ বলে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ করতে বলেছিল। ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে সরকার অনুপ্রবেশকারীদের জন্য গড়ে দিয়েছে ইন্দিরা আবাস যোজনার ১৫০০ ঘর, ৩২টি স্কুল, তিনটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, শৌচাগার। এমনকী সরকারের তিন হাজার বিঘা খাসজমিও তারা দখল করে রেখেছে। একই ভাবে মরিগাঁও জেলার মায়ং হাতিমূরিয়াতে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র কয়েকঘর বাংলাদেশি ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে হঠাৎ করে সেখানে তিন শতাধিক বাংলাদেশি পরিবার চলে এসেছে। উচ্ছেদ না করে তাদের জন্য সরকার সৌরশক্তির আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি উপমন্যুবাবু বলেন, “২০০৪ সালের ১৪ জুলাই ইউপিএ সরকার লোকসভায় তথ্য দিয়েছিল অসমে ৬৫ লক্ষ বিদেশি আছে। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত মাত্র আড়াই হাজার বাংলাদেশিকে বিতাড়ণ করা গিয়েছে। ভূমি রাজস্ব আইনের ১৬৫ ধারা অনুযায়ী রাজ্য সরকার ইচ্ছে করলেই অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করতে পারে। কিন্তু সেই সদিচ্ছের অভাবেই রাজ্য আরও জতুগৃহে পরিণত হচ্ছে। নাগরিকপঞ্জী তৈরি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না।”

রাজ্যের ডিজিপি মুকেশ সহায় বলেন, “রাজ্যে আইসিসের সরাসরি হুমকি না থাকলেও সক্রিয় আছে জেএমবি। এই ধরণের দলগুলিকে কাজে লাগাতে পারে আইসিস। তাই আমরা অতিরিক্ত সতর্কতা সবসময়ই নিচ্ছি। সীমান্ত জেলাগুলিতে কড়া নজরদারি আছে।” রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের এক আমলার কথায়, “বাংলাদেশি চিহ্নিত করা বা বিতাড়িত করা ফরেনার্স ট্রিবিউনালের ব্যাপার। আদালতের নির্দেশ পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam terror attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE