Advertisement
E-Paper

‘হিন্দু-মুসলমান একই ব্যবসা করি, এমন হবে কোনও দিন ভাবতে পারিনি’

তিন দিন পরে রেললাইনে হদিশ মিলেছিল সাঁইত্রিশ বছরের ওমরের গুলিবিদ্ধ এবং গলার নলি কাটা দেহ।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:০৬
‘গো-রক্ষক’দের হাতে মৃত ওমর খানের মা চান্দেরি বেওয়া।

‘গো-রক্ষক’দের হাতে মৃত ওমর খানের মা চান্দেরি বেওয়া।

চান্দেরি বেওয়ার গোটা মুখ অসংখ্য বলিরেখায় ভর্তি। বয়স আর অভিজ্ঞতার চিহ্ন বহন করছে চামড়ার ওপর নিপুণ ভাবে এঁকে দেওয়া এক একটি রেখা। কিন্তু সেই সব অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে গিয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে।

ছেলে ওমর খান গিয়েছিলেন আলওয়ার থেকে দু’টি গাই গরু কিনে আনতে। সঙ্গে ছিলেন ওই গ্রামেরই বাসিন্দা জাভেদ এবং তাহির। গত বছরের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখের রাতের কথা এখনও ভোলেননি পঁচাত্তর পেরনো এই বৃদ্ধা, “জাভেদ এসে খবর দিল রাস্তায় ওদের উপর কিছু লোক গুলি চালিয়েছে। তাহিরের হাতে গুলি লেগেছে। কোনও মতে জাভেদ তাহিরকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। ওমরকে পাওয়া যাচ্ছে না।” তিন দিন পরে রেললাইনে হদিশ মিলেছিল সাঁইত্রিশ বছরের ওমরের গুলিবিদ্ধ এবং গলার নলি কাটা দেহ।

পরে কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছিল, যারা প্রত্যেকেই বজরং দলের সদস্য। প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে রাজস্থানের কুখ্যাত ‘গো-রক্ষক’দের ভূমিকা।

আরও পড়ুন: রানির গদি ওল্টাতে রানিই ভরসা কংগ্রেসের, ভয়ও তাঁর...

আলওয়ার থেকে ভরতপুর যাওয়ার রাস্তায় ভীমা। সেখান থেকে বাঁ দিকে নেমে একশ গজ এগোনর পরই বোঝা গেল, এ রাস্তায় ট্রাক্টর দিব্বি চলতে পারলেও, সেডানের চাকা গড়াবে না। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে, গলি-তস্য গলি পেরিয়ে, ঘাটমিখা গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম ওমরের বাড়ি। হরিয়ানা সীমানায় রাজস্থানের শেষ গ্রাম। তত ক্ষণে খেয়াল হল জুতো ছাড়িয়ে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ধুলোর পুরু আস্তরণ। এক টুকরো জমির এক কোণ খড়ে ছাওয়া একটেরে ঘুপচি দু’কামরার বাড়ি। সামনের উঠোনে খাটিয়ায় বসে ছিলেন ওমরের মা চান্দেরি। ছেলের কথা বলতে গিয়েই বলে উঠলেন, “আমরা মেওয়াটি। গরু পুষে দুধ বিক্রি করাই গোটা মেওয়াটের মানুষের জীবিকা। কয়েক-শো বছর ধরে এখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে একই ব্যবসা করছি। এমন হবে কোনও দিন ভাবতে পারিনি।”

দেখুন ভিডিয়ো:

বৃদ্ধার কথা শুনেই মনে পড়ল গ্রামের গলি দিয়ে হাঁটার সময় পোড়ো হাভেলির মধ্যে মসজিদের মিনার দেখেছি। আর তার ঠিক পাশ থেকেই ভেসে আসছিল ভজনের সুর। ইতিমধ্যে হাজির ওমরের বড় ছেলে মকসুদ। গোঁফের রেখাটা খুব স্পষ্ট না হলেও, সে-ই এখন ঠাকুমা আর মা খুর্শিদাকে নিয়ে আট জনের পরিবারের কর্তা। টলোমল পায়ে তত ক্ষণে মকসুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মকসুদের ছ’ভাইবোনের মধ্যে ছোট জন।

ওমরের বড় ছেলে মকসুদ। এই এখন পরিবারের কর্তা।

মকসুদের অভিযোগ, তাঁর বাবার খুনিদের আড়াল করছে পুলিশ। খুনের মামলায় অভিযুক্তও দু’মাসের মাথায় জামিন পেয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ উগরে দিয়ে মকসুদ বলেন, “ক্ষতিপূরণ দেওয়া দূরের কথা, সরকার থেকে কেউ আমাদের দেখতেও আসেনি।” মকসুদের মতই গোটা পাড়ার বক্তব্য— গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে দশ-পনেরোটা করে গরু বা মোষ আছে। তাদের দুধ বিক্রি করাই পেশা গোটা গ্রামের। মাংস বিক্রি তাঁরা করেন না। মকসুদ বলেন,“ মোদী ভাল করবে ভেবেছিলাম। তাই আমরা সবাই লোকসভায় মোদীকে ভোট দিয়েছি। এ বার আর নয়। এবার কংগ্রেসকেই ভোট দেব।” প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বাস ওই গ্রামে। তাঁরা সবাই কামান বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী জ়াইদা খানকে ভোট দেবেন বলে মনস্থির করেছেন। এলাকার সরপঞ্চ শৌকত খান বলেন, “শুধু এই গ্রাম নয়, আশপাশের সব গ্রামের মুসলমান ভোটাররা এ বার বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন।”

গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে গরু-মোষ এবং মানুষ একসঙ্গেই বাস করেন।

আরও পড়ুন: ভোপালের স্ট্রং রুমে এক ঘণ্টারও বেশি বন্ধ ছিল সিসিটিভি, মেনে নিল নির্বাচন কমিশন

সংখ্যালঘু জনসংখ্যা রাজস্থানে মাত্র ৯ শতাংশ হওয়ায়, এর আগে কোনও দিন এই মাত্রায় ধর্মীয় মেরুকরণ দেখা যায়নি। বরং ধর্মের আগে স্থানীয় রাজনৈতিক সমীকরণকে মাথায় রেখেই ভোট দিয়েছেন এখানকার মুসলমান ভোটাররা। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে পহলু খান, ওমর খান বা রাকবর খানের খুন হওয়ার ঘটনা যে অনেকটাই ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরি করেছে তা স্বীকার করলেন জ়াইদা খান। ওমরের গ্রাম থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে রাজস্থান সীমানায় হরিয়ানার কোলগাঁওতে বাড়ি রাকবরের। তাঁর বিধবা স্ত্রী আশিয়ানা এবং বাবা সুলেমান এক সুরেই বললেন, “লোকসভা ভোটে বিজেপিকে এখান থেকে আর কেউ ভোট দেবে না।” রাজস্থানের যে জেলাগুলিতে সংখ্যালঘু ভোট নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে, সেই আলওয়ার (১৫ শতাংশ), জয়শলমের (২৫ শতাংশ), ভারতপুর (১৪ শতাংশ), নাগৌর (১৪ শতাংশ) এবং শেখাওয়াটি এলাকার শিকর, চুরু এবং ঝুনঝুনির মত সাতটি জেলার বাইরেও এই ধর্মীয় মেরুকরণের প্রভাব পড়েছে হরিয়ানা-উত্তর প্রদেশের একটা বড় এলাকায়। যদিও তা নিয়ে একটুও ভাবিত নন তথাকথিত গো-রক্ষকরা। আলওয়ারের রামগড় বাজারে, যেখানে রাকবরকে খুন করা হয়েছিল, সেখানে দেখা হল মোহন শর্মার সঙ্গে। নিজেকে বজরং দলের স্থানীয় নেতা হিসাবে পরিচয় দেওয়া মোহনের দাবি, “গো-হত্যা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না। যা হয়েছে তা জনগণের রোষে হয়েছে।” তাঁর আরও দাবি, “দুধের জন্য নয়, মাংসের জন্যই গরু পালন করে ওই মেওয়াটি সংখ্যালঘুরা।”

আরও পড়ুন: দাপটের ইতিহাসটুকুই সম্বল, পিঙ্ক সিটির কয়েক লাখ বাঙালির প্রায় ভূমিকাই নেই ভোটে

স্বঘোষিত এই গোরক্ষকদের কথা শুনে মনে পড়ল, দিল্লি এবং জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে মেওয়াটিদের দুর্নাম রয়েছে গবাদি পশুর লুঠেরা হিসাবে। ট্রাক নিয়ে গরু লুঠ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণও গিয়েছে অনেক দুষ্কৃতীর। তবে দিল্লি বা উত্তর প্রদেশের কোনও পুলিশ কর্তাই দাবি করেননি যে, ওই লুঠেরাদের তালিকাতে কোনও হিন্দুর নাম নেই।

ওমরের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সরপঞ্চ শৌকতের কাছে জানা গেল— তাঁদের গ্রামে কোনও জল নেই। দশ কিলোমিটার দূর থেকে ট্যাঙ্কার এসে জল ভরে দিয়ে যায় গ্রামের ট্যাঙ্কে। সেই কেনা জলই সম্বল গ্রামের মানুষ থেকে গবাদি পশু সবার। মনে হচ্ছিল, সত্যিই কী বিচিত্র এই রাজনীতির খেলা। নির্জলা গ্রামের ইস্যু কত অনায়াসে চাপা পড়ে যায় ধর্ম নিয়ে অন্ধ উন্মাদনার সামনে।

গোবর আর গোমূত্রে ভরা মেঠো রাস্তায় ইতস্তত বাঁধা গরু মোষ পাশ কাটিয়ে হাটঁছিলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম কলকাতার ট্যাংরার স্লটার হাউস বা কসাইখানের কথা। কই, সেই অনুভূতিটা তো এখানে একটুও হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছিল, গোটা গ্রামটাই একটা গোশালা।

ছবি: সিজার মণ্ডল।

Rajasthan Assembly Election 2018 Assembly Elections 2018 Rajasthan Mob Lynching Cow Vigilance BJP Congress Alwar বিধানসভা নির্বাচন ২০১৮
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy