সবকো নিপটা দো। শেষ করে দাও সবাইকে। একটি কণ্ঠ নির্দেশ দিচ্ছিল। মুহূর্তে জবাব এল, পাঁচ তো মর গয়ে...।
বিতর্ক চলছিল শুরু থেকেই। এ বার ফাঁস হওয়া নতুন একটি অডিও টেপ আট সিমি সদস্যের মৃত্যু- রহস্যকে বাড়িয়ে দিল অনেকটাই। নতুন করে বিতর্ক বাড়াল জেল প্রশাসনের একটি চিঠি। যেখানে ভোপাল জেলের সুপার সেন্ট্রাল জেলের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তু উপর মহল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে জেলে একটা বড় সংখ্যার নিরাপত্তা কর্মীর অনুপস্থিতি নিয়েও। সব মিলিয়ে একেবারে শাঁখের করাতে কাটার দশা মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানের সরকারের।
মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার তথা পুলিশ কর্তারা সিমি কাণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই বয়ান বদল করছেন। প্রথমে বলা হয়, আট বন্দি জেল থেকে পালানোর পরে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এর পর ভিডিও টেপ ফাঁস হলে দেখা যায় গ্রামের থেকে দূরে একটি টিলায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। নিহত সিমি সদস্যদের হাতে অস্ত্র ছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শুরুতে পুলিশ এই দাবি করলেও মধ্যপ্রদেশের জঙ্গি দমন শাখার প্রধান জানিয়ে দেন, সিমি সদস্যরা নিরস্ত্র ছিল। তবে তিনি যুক্তি দেন, হাতে অস্ত্র না থাকলেও যে হেতু তারা সন্ত্রাসবাদী কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাই সংঘর্ষে তাদের নিকেশ করা অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। অডিও টেপটি কিন্তু অন্য কথাই বলছে। ইঙ্গিত দিচ্ছে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের দিকে এগিয়েছিল পুলিশ।
কী রয়েছে অডিও টেপটিতে?
একটি কণ্ঠ বলছে, শেষ করে দাও সবাইকে।
জবাব মিলছে, পাঁচ জন তো মরে গিয়েছে।
কিছু ক্ষণ পরে আবার: আটো মারে গয়ে। আট জনই মরে গিয়েছে।
স্যার, বাধাই হো। আটো মারে গয়ে।
অন্য কণ্ঠ বলছে, ভেরি গুড। ভেরি গুড। আমরা ওখানে পৌঁছচ্ছি।
সিমি কাণ্ডে শুরু থেকেই বিতর্কে জড়িয়েছিল পুলিশ। দেখা গিয়েছিল, একটি নির্জন, বিচ্ছিন্ন জায়গায় আট জনকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জানিয়েছে, কোমরের উপরে এমনকী পিছন থেকেও গুলি করা হয়েছে। সেই বিতর্ককে আরও বাড়িয়ে দিল নতুন অডিও টেপ। এটি সামনে আসায় ভোপাল জেলের কর্মীটির মৃত্যু নিয়েও নতুন করে রহস্য তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, যে ভাবে এখানে কথোপকথন এগিয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, মধ্যপ্রদেশ পুলিশের কর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। অডিও টেপটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে মধ্যপ্রদেশ সরকার আজ জানিয়েছে, সিমি কাণ্ড নিয়ে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এস কে পাণ্ডে তদন্ত করবেন। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিমি সদস্য বন্দিরা কী ভাবে জেল থেকে পালালো ও পুলিশের সঙ্গে কী পরিস্থিতিতে তাদের সংঘর্ষ হল, তা বিচারপতি পাণ্ডে তদন্ত করে দেখবেন। অডিও টেপটি নিয়ে নিয়ে বিতর্ক চরমে পৌঁছনোয় এটিও তদন্তের আওতায় আসবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সিমি সদস্যদের জেল পালানোর তত্ত্ব শুরু থেকেই সামনে নিয়ে এসেছিল রাজ্যের বিজেপি সরকার। তবে জেলে নিরাপত্তা কর্মীর অভাব, সিসিটিভি কাজ না করা, চামচকে অস্ত্র করে রক্ষীর গলা কেটে খুন করে একসঙ্গে বন্দিদের পালানো ও পরেও তাদের একসঙ্গে থাকা, চাদর ব্যবহার করে জেলের ৩০ ফুটের দেওয়াল টপকে যাওয়া, কয়েদির পোশাক বদলে বেল্ট, প্যান্ট, জিপিএস দেওয়া ঘড়ি অথচ অস্ত্র সেই চামচ— এমন অসংখ্য প্রশ্ন প্রথম থেকেই উঠছে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ কর্তারা কিংবা পুলিশ যুক্তি দিয়েছে, জেলকর্মীকে হত্যা করে পালিয়েছে বন্দিরা। আর এমন পরিস্থিতিতে তাদের গুলি করা হয়েছে, যেখানে অন্য কোনও উপায় ছিল না। কেননা, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত এই বন্দিরা দেশের নিরাপত্তার সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া ভোপাল সেন্ট্রাল জেলের সুপারেরই একটি চিঠি শিবরাজ সরকারকে নতুন প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। জেল পালানোর ঘটনার ঠিক ২৪ দিন আগে লেখা এই চিঠিতে ভোপাল জেলের দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। বলা হয়েছে, সিমি, নকশালপন্থী ও অনেক কুখ্যাত বন্দিদের ঠাসাঠাসি করে জেলে রাখা হয়েছে। জেলের নিরাপত্তা বাড়ানো খুবই জরুরি। এ জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবস্থা করার আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জেল সুপারের সেই অনুরোধে কান দেননি কারা দফতরের ডিজি।
জেলের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাবে কান না দেওয়াই শুধু নয়, ওই দিন জেলে ঠিক কত জন কর্মী অনুপস্থিত ছিলেন— সেই প্রশ্নও বিপাকে ফেলেছে শিবরাজ সরকারকে। কেন না, অভিযোগ উঠেছে ওই দিনটিতে জেলে ৮০ জন নিরাপত্তা রক্ষী হাজিরই ছিলেন না। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ও দফতর, কারামন্ত্রী এমনকী প্রাক্তন কারামন্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যস্ত ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের কারামন্ত্রী কুসুম মেহেদেলে দাবি করেছেন, এ সবই বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। কিন্তু সব মিলিয়ে সিমি বিতর্কে নাজেহাল মধ্যপ্রদেশ সরকার।