চিনের ‘আগ্রাসনে’ ধুঁকছে ভারতের বাঁশ শিল্প।
চিনে উৎপাদিত বাঁশের উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ভারতের ধূপকাঠি শিল্প। অথচ বাঁশ শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশে তৈরি কেন্দ্রের প্রকল্পগুলি একের পর এক মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই অবস্থায় উত্তর-পূর্ব তথা ভারতের বাঁশশিল্পকেন্দ্রগুলির ৯০ শতাংশই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ধুঁকছে বাকিরাও। ভারতীয় বাঁশ শিল্প সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর শর্মা জানান, ২০০৪ সালে চালু হয় ‘ন্যাশনাল মিশন ফর বাম্বু অ্যাপ্লিকেশন’ (এনএমবিএ) ও ‘জাতীয় বাম্বু মিশন’। বলা হয়েছিল, বাঁশ শিল্পে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিপণনের জন্য কাজ করবে এনএমবিএ। খরচ করা হবে ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই সংস্থার ডিজি ও আমলাদের বিদেশ সফর, দফতর চালানোর খরচ, বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্য দেওয়ার পর দেশের ৭০টি বাঁশ শিল্পকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ হয় মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। তাও ফেরতযোগ্য। কিন্তু সংগঠনের দাবি, এত দেশভ্রমণের পরেও এনএমবিএ গত ১২ বছরে বাঁশ শিল্পে কোনও নতুন প্রযুক্তি আনতে পারেনি। শুধু বিদেশের প্রযুক্তি নকল করে ভারতে যন্ত্র বসিয়েছে। কিন্তু বাঁশের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির জন্য ভিন্ন প্রজাতির বাঁশ ও যন্ত্র দরকার ছিল। সে দিকে কোনও নজরই দেওয়া হয়নি।
ভারতে বাঁশ শিল্পের ধারক হল ধূপকাঠি কারখানাগুলি। মুম্বইয়ের এম এল ইনসেন্স সংস্থার অধিকর্তা আনন্দ অগ্রবাল বলেন, ‘‘কেন্দ্র যে টাকা বিনিয়োগ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু প্রকল্পের কোনও সুবিধা পাইনি। উল্টে কেন্দ্র প্রায় ২০ কোটি টাকা ফেরতও নিয়েছে।’’ আনন্দবাবু জানান, এত বছরেও কোনও নতুন প্রযুক্তি আসেনি। উল্টে টাকা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হচ্ছে। আনন্দবাবু, সাগরবাবুরা বলেন— ‘‘আমরা এখনও বাঁশ শিল্পের দিনবদলে কেন্দ্রের পাশে দাঁড়াতে তৈরি। কিন্তু চিন ভারতের বাজার দখল করে নিলেও, ভারত সরকারের ঘুম ভাঙছে না। ত্রিপুরা, অসম, ওড়িশায় একের পর বাঁশ শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’’
কী ভাবে আগ্রাসন চালাচ্ছে চিন?
আনন্দবাবু জানান, ভারতে ধূপকাঠি তৈরির জন্য আগে ত্রিপুরা থেকে বাঁশ আসত। কিন্তু ব্যর্থ হওয়া ‘বাম্বু মিশনের’ খেসারত দিয়ে ত্রিপুরা আজকাল বাঁশ সরবরাহ দিতে পারে না। বদলে, প্রতি মাসে ধূপকাঠি তৈরিতে প্রয়োজন ৩ হাজার ৫০০ টন ‘মোসো’ বাঁশ ভিয়েতনাম থেকে ভারতে আমদানি করা হয়। আসিয়ান দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভিয়েতনাম থেকে আমদানি শুল্ক নেওয়া হয় ১০ শতাংশ। কিন্তু ওই প্রজাতির বাঁশ ভিয়েতনামে তৈরিই হয় না। তা মেলে শুধু চিন ও অরুণাচলপ্রদেশের কয়েকটি অংশে। চিন ওই বাঁশ ভিয়েতনামে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে তা ভিয়েতনামের বাঁশ হিসেবে ভারতে ঢোকে। বছরে সেই ব্যবসার পরিমাণ অন্তত ৫০০ কোটি টাকা। ভারতের জন্যই ভিয়েতনামে বিরাট বাঁশ রফতানি ক্ষেত্র চলছে।
সাগরবাবু জানান, ভারতে যেখানে বাঁশকে এখনও গ্রামীণ ও ছোট শিল্প হিসেবে দেখা হয়, চিন সেখানে বাঁশকে সুবৃহৎ শিল্পে পরিণত করে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্বপ্নপূরণ, গ্রামীণ অর্থনীতির ভোল বদল ও কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ করে দিতে পারত বাঁশ শিল্প। কিন্তু কার্যত চিনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ভারত। ফলে ‘বাম্বু ইন্ডাসট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর অধীনে থাকা অসম, অরুণাচল, ত্রিপুরা, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, মেঘালয়ের সংস্থাগুলি ডুবতে বসেছে।
আনন্দবাবুর হিসেবে, ভিয়েতনাম থেকে বিশাখাপত্তনমে বাঁশের একটি কন্টেনার পাঠাতে খরচ হয় ২০০ ডলার। সেখানে মিজোরাম থেকে বেঙ্গালুরুতে বাঁশ পাঠালে ট্রাকপ্রতি দেড় লক্ষ টাকা খরচ। ভারতে মোসো বাঁশের চাষেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
সংগঠনের অভিযোগ, এনএমবিএ এত টাকা নয়ছয় করার পরও কোনও তদন্ত না চালিয়ে কেন্দ্র ২০১৩-১৪ সালে নতুন করে তৈরি করে ‘নর্থ ইস্ট সেন্টার ফর টেকনোলজি অ্যাপ্লিকেশন এ্যান্ড রিচ’ বা ‘নেকটার’ প্রকল্প। এনএমবিএর কর্তা থেকে কর্মী নেকটারে চলে আসেন। তাঁদের হাতে ফের তুলে দেওয়া হয়েছিল ২৯২ কোটি টাকা। সদর দফতর তৈরি হয় শিলংয়ে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত শিলং দফতরে প্রকল্পের অধিকর্তা বা কর্মীরা আসেননি। সকলে দিল্লিতেই বসেন। সাগরবাবু বলেন, ‘‘নিয়মমতো উত্তর-পূর্বের আট রাজ্যের মুখ্য সচিব নেকটারের সদস্য। নেকটারের বৈঠক থাকলে তাঁরাও দিল্লি যান। আমাদের যে কোনও সমস্যায় দিল্লিতে যেতে হয়। এমনকী আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও দিল্লিতেই করা হয়েছে।’’
তাঁদের বক্তব্য— বাম্বু মিশন, এনএমবিএ ও নেকটার মিলিয়ে যে টাকা কেন্দ্র নষ্ট করেছে তার ঠিকমতো ব্যবহার করা হলে ভারতের বাঁশ শিল্পে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারত। লক্ষাধিক কর্মসংস্থান হত। বাঁশ শিল্প বিকাশের নামে বড় সংস্থাকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর বেড়া বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৭ লক্ষ টাকা দিয়ে ‘মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন’ তৈরি করা হয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি রাজীব গোস্বামী, সচিব ডি কে চেতিয়ারা জানান, ১২ বছরে তিনটি প্রকল্পের ব্যর্থতা ও প্রকৃত ছবি জানিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, ৮ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি পাঠিয়েছেন। জানিয়েছেন, ভারতে বাঁশ শিল্প বাঁচাতে হলে চিনা আগ্রাসন রোধ করা, নেকটারের দুর্নীতি রোধ ও বাঁশ শিল্পীদের হাতে নতুন প্রযুক্তি ও বরাদ্দ অর্থ তুলে দেওয়া প্রয়োজন।