একের পর এক ব্লগার ও মুক্তমনা হত্যার তদন্তে নেমে যে বড়সড় চক্রান্তের হদিশ মিলেছে, তার ফলে ভারতের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কিত বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। হাতে আসা তথ্যপ্রমাণ ইতিমধ্যেই দিল্লিকে দিয়েছেন তাঁরা।
তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা দু’টি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। এক, আইএস-এর নামে প্রায় সব হত্যাকাণ্ড ও নাশকতাই আদতে জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ)-র কাজ। দুই, এর পিছনে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক চক্রান্ত, ভারতও যার স্বাভাবিক লক্ষ্যবস্তু। বিরোধী দল বিএনপি-র শরিক জামাতে ইসলামি ও তাদের শাখা ‘ইসলামি ছাত্র শিবির’ জেএমবি জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে এই চক্রান্তে লিপ্ত। পুরো বিষয়টির তত্ত্বাবধানে রয়েছে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা বলছেন, দুই বাংলা জুড়েই জেএমবি ও ছাত্র শিবিরের জাল ছড়ানো থাকায় ভারতের নিরাপত্তাও বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তাদের আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যেই ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আইএস খুঁজতে গিয়ে এখনও পর্যন্ত যে সব জঙ্গিদের ধরা গিয়েছে, তারা সকলেই জেএমবি-র সদস্য। এদের সংগঠিত করার কাজে ঢাকার কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসও সক্রিয়।’’ গোয়েন্দাদের ইঙ্গিত মূলত পাক হাই কমিশন। সঙ্গে তুরস্ক ও সৌদি আরবেরও দূতাবাসও রয়েছে।
এই গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ‘‘ব্লগার ও মুক্তমনাদের হত্যাকাণ্ড আদতে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করা গিয়েছে।’’ এর পরে কিছু ধরপাকড়ও হয়েছে। গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে জেএমবি ও ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গা-ঢাকা দিয়ে জঙ্গি কার্যকলাপ চালাতে পারে। ভিডিও বার্তায় ভারতে হামলা চালানোর যে হুমকি আইএস সম্প্রতি দিয়েছে, জেএমবি-র প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা তাতেও অংশ নিতে পারে।
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক রাজীব হায়দারকে ২০১৩-র ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন করে বাংলাদেশে মুক্তমনাদের ওপর হামলা শুরু হয়। তার পরে একে একে বেশ কয়েক জন ব্লগার, লেখক, প্রকাশকের সঙ্গে এক জাপানি ও এক ইতালীয় নাগরিককেও হত্যা করা হয়েছে। নাশকতা চালানো হয়েছে কিছু মন্দির, বৌদ্ধ উপাসনালয় এমনকী সুন্নি ও কাদিয়ানিদের ধর্মস্থানেও। আনসারুল্লা বাংলা টিম নামে আইএস-এর অনুগামী একটি জঙ্গি সংগঠন এ সবের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু রাজীব হায়দার ও অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের কিনারা করে বাংলাদেশের পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে, তারা সকলেই জেএমবি-র জঙ্গি। অন্য ঘটনাগুলির তদন্তেও হয় জেএমবি কিংবা ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীদের নাম উঠে আসছে।
গত বছর ২১ এপ্রিল হওয়া সাভারের একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতির তদন্তে নেমেও গোয়েন্দারা প্রমাণ পান আনসারুল্লা বাংলা টিম ও জেএমবি আদতে একই মুদ্রার দু’পিঠ। সে দিন ডাকাতি করতে দিয়ে আট জন ব্যাঙ্ককর্মীকে গুলি করে ও কুপিয়ে খুন করে জঙ্গিরা। মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালত যে ছয় ডাকাতকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, তারা সকলেই আনসারুল্লা বাংলা টিমের জঙ্গি। আবার একই সঙ্গে তারা জেএমবি-রও সদস্য।
জঙ্গিরা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছে, আনসারুল্লা বাংলা টিমের কয়েকটি ছোট ছোট গ্রুপ রয়েছে। তাদের সদস্যরা গ্রুপের নেতা ছাড়া এমনকী অন্য গ্রুপেরও কাউকে চেনে না। কে তাদের নির্দেশ দেয়, সেটা জানতে চাওয়াটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সদস্যদের কাজ শুধু হুকুম তামিল করা। লক্ষ্যবস্তু বেছে দিলে এ ভাবেই হত্যাকাণ্ড বা নাশকতা চালায় গ্রুপের সদস্যরা।
জেএমবি-আইএস যোগের অন্য প্রমাণও এসেছে গোয়েন্দাদের হাতে। সিরিয়া থেকে প্রকাশিত আইএস-এর মুখপত্র ‘দাবিক’-এ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জেএমবি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আব্দুর রহমানকে ‘প্রকৃত মুজাহিদ ও শহিদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনেই ঘোষণা করা হয়েছে— শুধু বাংলাদেশ নয়, দুই বাংলা জুড়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য। গোয়েন্দারা বলছেন, আইএস-এর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে ভারতের পক্ষেও যথেষ্ট উদ্বেগের।
কিন্তু এ ধরনের নাশকতার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি কী?
গোয়েন্দারা বলছেন, প্রধানত দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানো। জঙ্গি অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত গড়ে একাত্তরে গণহত্যার নায়ক রাজাকার নেতাদের বিচার শুরু করে। পাকিস্তান ও তুরস্কের প্রবল বিরোধিতা উড়িয়ে ইতিমধ্যে এক বিএনপি ও চার জামাত নেতার ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। জামাতে ইসলামি আগাগোড়া অভিযোগ করে চলেছে, ভারতের পরামর্শেই হাসিনা সরকার এই কাজ করছে। পাকিস্তানের আইনসভায় নেওয়া নিন্দা প্রস্তাবেও বলা হয়েছে, ‘দিল্লির পরামর্শেই হাসিনা সরকার বিচারের নামে ইসলামি নেতাদের হত্যা করছে’। গোয়েন্দাদের দাবি, নাশকতার মাধ্যমে সরকারের এই কর্মকাণ্ডের জবাব দেওয়ার জন্য ফুঁসছিল জামাতে ইসলামি ও তাদের ছাত্র সংগঠন, যাদের অনেক কর্মীই আবার জঙ্গি কাজে পারদর্শী। সঙ্গে পাওয়া যায় সরকারের অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া মুজাহিদদের সংগঠন জেএমবি-কেও। গোটা চক্রান্তটির সমন্বয়ে এগিয়ে আসে আইএসআই। অর্থের জোগানও তারাই দেয়। গোয়েন্দাদের ধারণা, একই সঙ্গে ভারতকে শিক্ষা দেওয়াটাও তাদের লক্ষ্য।
কিন্তু আইএস-এর নাম এল কী ভাবে?
তদন্তকারীদের বক্তব্য, জেএমবি আগাগোড়া আল কায়দার অনুসারী। পশ্চিম এশিয়ায় আইএস ও আল কায়দার সম্পর্ক সাপে নেউলে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আইএস জঙ্গিরা এখন সব চেয়ে পরিচিত নাম। গোয়েন্দারা বলছেন, বিচ্ছিন্ন খুন জখম বা নাশকতা করে আইএস-এর নাম তার সঙ্গে জুড়ে দিলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার যেমন জোরদার হয়, বাংলাদেশে এই আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের উপস্থিতিও প্রমাণ করা যায়।
গোয়েন্দাদের দাবি, সেই কারণেই প্রথম দিকে বাংলাদেশ ঢুঁড়েও আইএস-এর উপস্থিতির কোনও প্রমাণ মিলছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, আইএস জঙ্গির নামে নাশকতা চালাচ্ছে জেএমবি-ই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy