Advertisement
E-Paper

রঙিন বেস ক্যাম্পটা মুহূর্তে বরফের মরুভূমি হয়ে গেল

প্রচণ্ড জোরে শ্বাস নিতে নিতে টেলিফোনের ও-পার থেকে প্রথমেই দু’‌টো শব্দ ছিটকে এল— ‘‘বেঁচে গিয়েছি!’’ এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে সবার আগে তুষার ধসের খবরটা জানালেন বারাসতের সুনীতা হাজরা। শনিবার ভোরেই বেস ক্যাম্প ছেড়ে ক্যাম্প ওয়ানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সুনীতা-সহ অন্য এভারেস্ট অভিযাত্রীদের। প্রচণ্ড মেঘ আর কনকনে হাওয়ায় বেরোতে না পেরে মুখ গোমড়া হয়েছিল সকলেরই। কিন্তু এই বেরোতে না পারাটাই যে প্রাণে বাঁচিয়ে দেবে, কে জানত!

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৭

প্রচণ্ড জোরে শ্বাস নিতে নিতে টেলিফোনের ও-পার থেকে প্রথমেই দু’‌টো শব্দ ছিটকে এল— ‘‘বেঁচে গিয়েছি!’’ এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে সবার আগে তুষার ধসের খবরটা জানালেন বারাসতের সুনীতা হাজরা। শনিবার ভোরেই বেস ক্যাম্প ছেড়ে ক্যাম্প ওয়ানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সুনীতা-সহ অন্য এভারেস্ট অভিযাত্রীদের। প্রচণ্ড মেঘ আর কনকনে হাওয়ায় বেরোতে না পেরে মুখ গোমড়া হয়েছিল সকলেরই। কিন্তু এই বেরোতে না পারাটাই যে প্রাণে বাঁচিয়ে দেবে, কে জানত!

তাঁবুর মধ্যেই ছিলেন সুনীতারা। বাইরে তখন হাওয়ার বেগ বাড়ছে, সঙ্গে টানা তুষারপাত। হঠাৎ প্রচণ্ড গর্জনে কেঁপে ওঠে চার পাশ। শব্দটা চেনা। তুষার ধস। মাত্র এক বছর আগে একই শব্দ করে খুম্বু আইসফল থেকে তাল তাল বরফ নেমে আসতে দেখেছিলেন অভিযাত্রীরা। সেই বরফে তলিয়ে গিয়েছিলেন অন্তত ১৬ জন শেরপা। এ বার তফাত একটাই। গত বারের মতো আর দূর থেকে দেখা নয়। তাঁবু থেকে মাথা বার করেই সুনীতা দেখেন, বরফের তালগুলো ঘাড়ের ওপরে এসে পড়েছে, গিলে খেতে আসছে যেন। বাঁ দিকে পামুরি আর ডান দিকে নুৎসে— দু’টি শৃঙ্গের ঢাল বেয়েই সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে নেমে আসছে তুষার। আর কিছু ভাবার সময় ছিল না। সুনীতা বললেন, ‘‘জুতোটাও গলানোর সময় পাইনি। কোনও রকমে তাঁবু থেকে বেরিয়ে দে দৌড়।’’ আশপাশে সবাই তখন যে যে দিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে।

একটা বড় পাথরের পেছনে লুকিয়েছিলেন সুনীতা। কোনও রকমে মাথা নিচু করে শরীরটা ছোট্ট করে বসে পড়েছিলেন। সময়ের আন্দাজ ছিল না। পায়ের তলায় পাহাড় কাঁপছে। প্রথমে ভেবেছিলেন, তুষারধস হলে যেমন চার পাশ কাঁপে, এ-ও তাই। তখনও জানেন না, নেপালের এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পই এই তুষারধস নামিয়েছে।

জুতো ছাড়া পা জমে যাচ্ছিল সুনীতার। কিন্তু আতঙ্ক তখন সেই কষ্টকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। চার পাশে সাদা বরফগুঁড়োর ধোঁয়া। গা ভর্তি বরফকুচির ‘ধুলো’। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তুষার ধসের গুমগুম আওয়াজটা থামার পর বড় করে একটা শ্বাস নেওয়ার জন্য মাথা তুলে উঠে দাঁড়াতেই বজ্রাহতের মতো থমকে যান সুনীতা। তাঁর কথায়, ‘‘একটু আগেই যে জায়গাটা রঙিন তাঁবুতে ভরে ছিল, সেটা বরফের মরুভূমি হয়ে গিয়েছে। সাদা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোথাও জেগে আছে ভাঙা তাঁবু, ছড়িয়ে আছে জুতো, রুকস্যাক, তাঁবুর ছেঁড়া কাপড়।’’

নিজের তাঁবুর কাছে ফিরে এসে জিনিসপত্রের খোঁজ করতে করতে একটাই কথা মনে হয়েছিল সুনীতার— ‘‘এ বারেও হল না।’’ আসলে বারাসত থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের পথটা খুব মসৃণ ছিল না যে! গত বার টাকাপয়সা জোগাড় করে এভারেস্টে পা রাখার স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন এক ছেলের মা সুনীতা। খুম্বু আইসফলের তুষারধসের জেরে সে বছর বাতিলই হয়ে যায় এভারেস্ট অভিযান। এ বছর ফের নতুন করে প্রস্তুতি, নতুন করে লড়াই শুরু। কিন্তু প্রকৃতি এ বারও অন্য রকম ভেবেছিল। পরপর দু’বার বাধা— এমনও হয়! বারাসতের সুনীতা, বসিরহাটের লিপিকা, ব্যারাকপুরের গৌতম, বেহালার দেবরাজরা আশঙ্কা করছেন, এ বারও হয়তো বেস ক্যাম্প থেকেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে।

দেবরাজ বললেন, ‘‘ওই ভয়ঙ্কর সময়টায় যে ঠিক কী মনে হচ্ছিল, বলতে পারব না। দুর্যোগ থামতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে।’’ বুঝতে সময় লাগেনি, অনেকেই বরফে চাপা পড়ে গিয়েছেন। তখন শেরপা, আরোহী, রাঁধুনি, মালবাহক নির্বিশেষে সবাই উদ্ধারকাজে হাত লাগান। কাউকে পাওয়া যায় গুরুতর জখম অবস্থায়, কাউকে মৃত অবস্থায়। দেবরাজ বললেন, ‘‘বেস ক্যাম্পের প্রায় ৯০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। হেলিকপ্টারও নামতে পারছে না আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য।’’

ঠিক কত জন অভিযাত্রী বেস ক্যাম্পে ছিলেন, সে হিসেব এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট নয় মৃত ও আহতের নির্দিষ্ট সংখ্যাটাও। তবে আরোহী-শেরপা সব মিলিয়ে হাজারখানেক অভিযাত্রী বেস ক্যাম্পে ছিলেন বলেই জানালেন নেপাল পর্যটন মন্ত্রকের মুখপাত্র জ্ঞানেন্দ্র শ্রেষ্ঠ। এখনও পর্যন্ত আট জন বিদেশি অভিযাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়েছে বলে জানালেন তিনি। তবে তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি। বাংলার ১২ জন অভিযাত্রীই নিরাপদে আছেন। অসম থেকে ১১ জনের একটি দল এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিল, তাঁরাও সকলে রক্ষা পেয়েছেন। তবে, কোরিয়ার ৮ জন অভিযাত্রীর একটি দল শেরপা-সহ ক্যাম্প ওয়ানের দিকে এগিয়েছিল। তাঁদের কারও খবর মেলেনি এখনও।

অরুণাচলের বমডিলার মহিলা পর্বতারোহী ৩৫ বছরের আনসু জানসেনপা ২০১১ সালে প্রথম বার এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন। সে বার ১০ দিনের মধ্যে পরপর দু’বার এভারেস্টে চড়ে নজির গড়েন তিনি। ২০১৩ সালেও ফের এভারেস্টে চড়েছিলেন। ২০১৪-র অভিযান বাতিল হওয়ায় এ বার ফের দু’বার এভারেস্ট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন আনসু। পরিবার সূত্রের খবর, তিনি নিরাপদে আছেন।

এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে নীচে গোরকশেপে আছেন বাংলার আরও চার অভিযাত্রী সত্যরূপ সিদ্ধান্ত, মলয় মুখোপাধ্যায়, সৌরভসিঞ্চন মণ্ডল ও রুদ্রপ্রসাদ হালদার। কলকাতা পুলিশের কর্মী রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, গোরকশেপে সবাই নিরাপদে আছেন। ১২ জন বাঙালির দলকে উদ্ধার করে আনার জন্য বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

অন্নপূর্ণা ও চো ইয়ু শৃঙ্গ অভিযানে গিয়েছেন বাঙালি এভারেস্টজয়ী দীপঙ্কর ঘোষ ও দেবাশিস বিশ্বাস। যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায় জানালেন, নেপালের ভারতীয় দূতাবাসের তরফে জানা গিয়েছে, অন্নপূর্ণা ও চো ইয়ু শৃঙ্গের আরোহীরা নিরাপদেই আছেন।

শিখর ছোঁয়ার পথে এ বারও প্রকৃতির রোষই যে বড় চ্যালেঞ্জ, তা বিলক্ষণ বুঝছেন দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা।

Basecamp Desert ice Desert Tias mukhopadhyay Earthquake sand
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy