শেষ অবধি অসমের লিগ্যাসি ডেটা ছাড়াই জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে ভূমিপুত্র ও চা-জনজাতির মানুষদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভিন রাজ্য থেকে অসমে আসা ভারতীয়দের নাম এনআরসিতে তোলার পক্ষে রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে জানাল, এনআরসি ফর্ম জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত কোনও শেষ তারিখ বেঁধে দিচ্ছে না। আদালত এ দিন এনআরসির কাজ তদারক করার জন্য চার সদস্যের একটি মনিটরিং কমিটি গড়ে দেয়। নির্দেশ দেয়, যে ভাবেই হোক ২০১৬ সালের পয়লা জানুয়ারি নাগরিক পঞ্জি সংশোধনের কাজ শেষ করতে হবে। তবে সঙ্কটের মধ্যেই রইল অসমে বসবাসকারী বাংলাভাষীরা।
১৯৮৫ থেকে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে নাগরিক পঞ্জির প্রামাণ্য নথি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আর্জি জানিয়ে রাজ্য সরকার গত কালই সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের যুক্তি ছিল, যেহেতু ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করেই ১৯৮৫ সালের ভোটার তালিকা তৈরি তাই ১৯৮৫ সাল ও তার পরবর্তী ভোটার তালিকাগুলিকেও নাগরিক পঞ্জির অন্যতম প্রামাণ্য নথি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। পাশাপাশি, রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, যেহেতু বহু পরিবার এখনও এনআরসি ফর্ম জমা দেয়নি বা লিগ্যাসি ডেটা পায়নি, তাই ফর্ম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩১ জুলাই থেকে বাড়ানো হোক। রাজ্য সরকার সূত্রে জানানো হয়, রাজ্যের তফশিল জাতিভুক্ত ৫৯টি পদবী ও উপজাতিভুক্ত হওয়ার দাবি জানানো ৬টি জনগোষ্ঠীর নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারেও হলফনামা দেওয়া হয়েছিল।
অসম গণ পরিষদও গত কাল সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়ে রাজ্যের ভূমিপুত্রদের অধিকার সুরক্ষিত করার আর্জি জানায়। তারা অনুরোধ করে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে অসমে আসা সব বহিরাগতকে চিহ্নিত করে বিতাড়ন করা হোক। রাজ্যের সব ভূমিপুত্রের নাম বিনা প্রমাণে নাগরিক পঞ্জির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে পিটিশন দেয় আসাম সাহিত্য সভা। এই দাবিতেই অসম পাবলিক ওয়ার্কস মূল মামলা শুরু করেছিল। ভিন রাজ্য থেকে অসমে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী ও কংগ্রেস বিধায়ক হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও হলফনামা দেন। এ নিয়ে হলফনামা দিয়েছিল ভোজপুরী পরিষদও.
বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ও আর এফ নরিম্যান এদিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শুনানির পরে রায় দেন, এনআরসিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসরণ করা হবে। এর তিন নম্বর ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে কারা অসমের ভূমিপুত্র। এদের মধ্যে যাদের পূর্বপুরুষের নাম লিগ্যাসি ডেটায় মিলছে না তারাও নাগরিক পঞ্জিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানাতে পারবেন। এই প্রসঙ্গে পরামর্শ বা নির্দেশ দিতে পারবে রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া। অসম পাবলিক ওয়ার্কসের আইনজীবী অরবিন্দকুমার শর্মা বলেন, বিচারপতিরা সিদ্ধান্ত নেন, চা-জনগোষ্ঠীদেরও অসমের আদি অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। তাঁদের ক্ষেত্রে বা অন্য ভূমিপুত্রদের ক্ষেত্রে লিগ্যাসি ডেটা আর বাধ্যতামূলক থাকছে না। তাঁরা যা প্রমাণ ও শংসাপত্র যোগাড় করতে পারবেন তার ভিত্তিতেই নাগরিক পঞ্জিতে নাম তোলার জন্য আবেদন জানাবেন। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এনআরসি কর্তৃপক্ষ। তবে রাজ্য সরকারের একাধিক আবেদন সত্ত্বেও ১৯৮৫-২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে প্রামাণ্য নথি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদনে সাড়া দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট।
ভিন রাজ্য থেকে যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পরে অসমে এসেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষের নাম রাজ্যের লিগ্যাসি ডেটায় না থাকায় সমস্যা হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এদিন রায় দেয়, বাইরে থেকে অসমে আসা ব্যক্তিরা যে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে ভারতের নাগরিক ছিলেন এবং ভারতের কোথাও স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন তার প্রমাণ দিলেই চলবে।
এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন জটিলতা ও সমস্যা হচ্ছে লক্ষ্য করে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি এদিন সিদ্ধান্ত নেন, গৌহাটি হাইকোর্টের তিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আফতাব হুসেন শইকিয়া, ডি বিশ্বাস ও জে এন চৌধুরী ও রাজ্য সরকারের এক সদস্যকে নিয়ে বিশেষ কমিটি গড়ে দেওয়া হবে। এই কমিটি এনআরসির কাজকর্ম তদারক করবে। এনআরসির কাজ নিয়ে কারও অভিযোগ থাকলে বা কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন এনআরসির কাজে বাধা দিলে এই কমিটির কাছে তা নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
ফর্ম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, যে ভাবেই হোক পুরো প্রক্রিয়া ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করতে হবে। এর বিভিন্ন ধাপে সময় সূচি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আদালত পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে ৬ বা ৭ অক্টোবরয়
বরাক উপত্যকা হিউম্যান রাইটস প্রোটেকশন সোসাইটির সম্পাদক নীলাদ্রি রায় জানান, ফর্ম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ঠিক করার বিষয়টি এনআরসি কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় তাঁরা খুশি। নাগরিকত্ব আইনের যে ধারায় অসমের নাগরিক হওয়ার জন্য অসমে জন্ম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—সেই নিয়মের পরিবর্তন চেয়ে ও নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী বাতিলের অনুরোধ করে তারা হলফনামা দিয়েছিলেন। তা নিয়ে পরবর্তী শুনানিতে আলোচনা হবে বলে জানায় আদালত। তাঁদের পক্ষে এদিন হাজির ছিলেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। ভূমিপুত্র ও চা-জনগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার সন্তোষ প্রকাশ করেন আসাম পাবলিক ওয়ার্কসের সভাপতি অভিজিত শর্মা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy