এত দিন মানুষ শপথগ্রহণ পর্ব টিভিতেই দেখে অভ্যস্ত ছিল। রাজ্যপালের শুরু করা লাইনে চেনা ছকে চির পরিচিত শব্দগুলি আওড়াতে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা। টিভি নিজের মতো চলতে থাকে। নতুন মন্ত্রিসভা তৈরি হয়। নিজেদের কাজে মশগুল মানুষ পর্দার দিকে দু’পলক হয়তো বা তাকান।
কিন্তু যে আগ্রাসী মন নিয়ে কংগ্রেসের দেড় দশকের শাসন শেষ করতে লড়তে নেমেছিলেন সর্বানন্দ সোনোয়াল, হিমন্তবিশ্ব শর্মারা, কার্যত সেই আগ্রাসন নিয়েই শপথ গ্রহণের চেনা ছককে তছনছ করে তাকে জনসভার চেহারা দিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী, দলের সর্বভারতীয় সভাপতি, ১৩ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে লাখ খানেক মানুষ সেই শপথ গ্রহণে হাজির হলেন। আরও বড় চমক দিলেন হিমন্তরা, এই মঞ্চে বসিয়ে রাখলেন সদ্য প্রাক্তন তরুণ গগৈকে। তাঁকে বসিয়ে রেখেই মঞ্চ থেকে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান স্লোগান তুললেন ‘ভারত মাতা কি জয়’। তাঁর উত্তরসূরী তাঁরই জমানার দুর্নীতি নিয়ে সরব হলেন, বসে বসে তা-ও শুনলেন তরুণ গগৈ।
সোনোয়াল নিজে তরুণ গগৈয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে শপথগ্রহণে হাজির থাকার আমন্ত্রণ জানান। আব্দার করে জানিয়ে দেন, তিনি না এলে শপথই হবে না। দোনামনা কাটিয়ে অনুষ্ঠানে আসারই সিদ্ধান্ত নেন গগৈ।
যখন বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সম্বর্ধনা দেওয়া চলছে তখনও গগৈ আসেননি। একটু পরেই তিনি হাজির হন। তখন মাইক হাতে অনুষ্ঠান সংযোজনার ভার সামলাচ্ছেন এক সময় তাঁর ডান হাত, নয়নের মণি হিমন্তবিশ্ব শর্মা। ২০১৪ সালে হিমন্তর নেতৃত্বে কংগ্রেসে যখন গগৈ হঠাও অভিযান শুরু হয়, তারপর থেকে দু’জনের মুখোমুখি কথা হয়েছে খুবই কম। এরপর হিমন্ত দল ছেড়ে নয় অনুগামী বিধায়ককে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। দুই দলে লড়াইয়ের পাশাপাশি শর্মা বনাম গগৈয়ের লড়াইটাও তারিয়ে উপভোগ করেছে অসমবাসী। এ দিন, খানাপাড়া গ্রাউন্ডে তরুণ গগৈ উপস্থিত হওয়া মাত্র হিমন্ত ‘প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী’ হিসেবে তরুণ গগৈয়ের নাম ঘোষণা করলেন। তাঁকে ‘স্বাগত’ জানালেন। আর সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লাখখানেক জনতা আওয়াজ তুললেন। হর্ষধ্বনি, তবে তাতে ছিল বিদ্রূপের মিশেল। গগৈ তখন উদাস, নির্বিকার।
এসেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও। ছবি: উজ্জ্বল দেব
মাঠের পাশেই কয়নাধারা পাহাড়ের মাথায় গগৈয়ের দেড় দশকের আবাস। শপথগ্রহণের এই মাঠ থেকেই লোকসভা ভোটের আগে মোদী হুমকি দিয়েছিলেন, পাহাড় থেকে গগৈকে নামিয়ে ছাড়বেন। আজ সেই দিন। পদ যাওয়ার পরে ছাড়তে হচ্ছে সেই বাড়িও। সাধারণ গাড়িতে চড়ে গগৈ নিজের অজন্তা পথের পুরনো বাড়িতে মালপত্র সরাচ্ছিলেন গত দু’দিন।
গগৈকে পাশে রেখেই পরপর শপথ নেন সর্বানন্দ। তুমুল জয়ধ্বনির মধ্যে শপথ নেন বিজেপির জয়ের প্রধান কাণ্ডারী হিমন্ত। ভোটের সময় এবং ফল বেরোনোর আগে পর্যন্ত গগৈ বলেছেন, হিমন্তর জন্যই হারবে বিজেপি। আজ শপথ নেওয়ার সময় হিমন্তর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন আছড়ে পড়ছিল ঠিক তাঁর বাঁদিকে মুখ্যমন্ত্রীদের সারিতে বসে থাকা ‘প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর’ কানে।
শপথের মাঠে জনজোয়ারকে সাক্ষী রেখে হিমন্ত-সর্বারা রাজ্য জয় নয়, মানুষের মন জয়ের বার্তা দিয়ে যান। নরেন্দ্র মোদী ভাষণ শুরু এবং শেষ করেন অসমীয়ায়। তিনি বলেন, ‘‘উপজাতি সমাজে জন্মানো এক যুব নেতা অসমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ গর্বের কথা। রাজ্যের উন্নয়নে অসম এক কদম এগোলে, দিল্লি আরও এক কদম এগিয়ে থাকবে।’’
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ অসম, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ ও নাগাল্যান্ডের বিজেপি নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে কংগ্রেস বিরোধী একটি মঞ্চ গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন অমিত। এই চারটি রাজ্য দিয়ে সেই কর্মসূচি শুরু হলেও পরে সারা উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছাও জানান তিনি। এই কর্মসূচির দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয় হিমন্ত বিশ্ব শর্মার উপরে।