প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের প্রচার শুরু করেছিলেন ‘ঘুসপেটিয়া’ মন্ত্রে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিহার থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বেছে বেছে ফেরত পাঠানো হবে। বিজেপি নেতাদের পরিকল্পনা ছিল, ঘুষপেটিয়া বা বেআইনি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে ধর্মীয় মেরুকরণ করা হবে।
কিন্তু আজ প্রথম দফার প্রচারের শেষে বিজেপির নেতারা বুঝতে পারছেন, বিহারে এসআইআর-এর ঢেউ বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নিয়ে প্রচারের কৌশল ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কারণ, এ নিয়ে প্রচার করলেই বিরোধীদের থেকে পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে, এসআইআর-এ তো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা। তা হলে অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্ন আসছে কেন?
এসআইআরের বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদব বিহারে ভোটার অধিকার যাত্রা শুরু করায় অমিত শাহ অভিযোগ তুলেছিলেন, দুই যুবরাজ অনুপ্রবেশকারীদের ভোট নিয়ে বিহারে সরকার গড়তে চাইছেন। শাহ এখনও একই অভিযোগ তুলছেন। কংগ্রেসের প্রশ্ন, এসআইআরে বিহারের ভোটার তালিকায় কত জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত হয়েছেন? কত জন অনুপ্রবেশকারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে? নির্বাচন কমিশন এ নিয়ে নীরব কেন? কংগ্রেসের নেতাদের মতে, বিহারের মুসলিম অধ্যুষিত সীমাঞ্চলে চার জেলায় অনুপ্রবেশকারী নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিজেপি কিছুটা ফায়দা পেতে পারে। কিন্তু অনুপ্রবেশকারী নিয়ে বেশি হইচই করলে বিরোধীদের পক্ষে মুসলিম ভোট এককাট্টা হবে। জেডিইউ যে মুসলিম ভোট পায়, তাও মহাগঠবন্ধনের পক্ষেসরে আসবে।
বিজেপির এই অনুপ্রবেশকারী নিয়ে প্রচার ভেস্তে যাওয়ায় বেজায় খুশি জেডিইউ নেতারাও। কারণ, জয়প্রকাশ নারায়ণ ও রামমনোহর লোহিয়ার অনুসারী নীতীশ মতাদর্শগত ভাবে বরাবর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজবাদের নীতি আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে টিকে থাকতে তিনি বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালেও হিন্দুত্বের রাজনীতিতে তাঁর ঘোর আপত্তি রয়েছে।
‘জানেন তো, কর্মনাশা নদীর তীরে এসে হিন্দুত্ব ডুবে যায়!’ পটনায় ভাই বীরচাঁদ পটেল মার্গে জেডিইউ সদর দফতরে বসে নীতীশ কুমারের দলের প্রবীণ নেতা ‘বিহারের রাজনীতির প্রাচীন প্রবাদ’ শোনাচ্ছিলেন। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের সীমানা বরাবর কর্মনাশা নদী বয়ে গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। রাজ্যের সমাজবাদী নেতাদের দাবি, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির হিন্দুত্বের ঢেউ সেই নদীতে ডুবে যায়, বিহারে আর ঢুকতে পারে না। একই কারণে আরএসএস বিহারে শিকড়ছড়াতে পারেনি।
জেডিইউ নেতাদের দাবি, বিজেপি বিহার থেকে অনুপ্রবেশকারী তাড়ানো বা সীতামঢ়ীতে জানকী মন্দির ঘিরে সীতাপুরম তৈরির কথা বলেছে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না বুঝে জাতপাতের সমীকরণ, সরকারি প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্ত, সুশাসন নিয়ে প্রচারে জোর দিচ্ছে। সেই কারণেই মোদী-শাহের সঙ্গে ওবিসি ভোট জিততে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব বা বণিক সম্প্রদায়ের ভোট জিততে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তকে প্রচারে নামানো হচ্ছে। উগ্র হিন্দুত্বের মুখ যোগী আদিত্যনাথকে প্রচারে আনা হয়েছে সীমিত ভাবে।
বিহারে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মতো মুখের অভাবেও ভুগছে বিজেপি। শাহ বলেছেন, বিহারে নীতীশের নেতৃত্বেই এনডিএ ভোটে লড়ছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, নির্বাচনের পরে বিধায়করা সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে নীতীশকে আগেভাগে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা না করলেও বিজেপি নিজের শিবির থেকে কাউকে বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। পটনায় বিজেপির রাজ্য দফতরে একদিকে নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমারের ছবি। অন্য দিকে তিন জন বিহার বিজেপির নেতার ছবি— দুই বর্তমান উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধরি ও বিজয় কুমার সিন্হা এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ জয়সওয়াল। এ ছাড়া গিরিরাজ সিংহ বা নিত্যানন্দ রাইয়ের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রয়েছেন।
জেডিইউ নেতাদের দাবি, বিজেপির বিহারের নেতারা কেউই ধারে-ভারে নীতীশের ধারেকাছেও আসেন না। সেই কারণে বিজেপিও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে সামনে রেখেই প্রচার করছে। জন সুরাজ পার্টির নেতা প্রশান্ত কিশোর কটাক্ষ করেছেন, বিশ্বের বৃহত্তম দল বলে নিজেদের দাবি করা বিজেপির বিহারে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মতো কোনও নেতা নেই? বিজেপির নেতাদের যুক্তি, এর আগে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ে অপরিচিত নেতাদের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে আনা হয়েছে। তবে তাঁরা মানছেন, এনডিএ ক্ষমতায় ফিরলে সঙ্গে সঙ্গে নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া কঠিন হবে, সে তাঁর অসুস্থতা যতই থাকুক না কেন।
তার প্রমাণ? পটনায় ভাই বীরচাঁদ প্যাটেল মার্গে জেডিইউ-র দফতর থেকে একটু দূরেই বিজেপির রাজ্য দফতর। সেখানে ‘সেলফি পয়েন্ট’ তৈরি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী ছাড়া আর এক জনেরই ছবির প্রমাণ মাপের কাটআউট রয়েছে। নীতীশ কুমার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)