গত লোকসভা নির্বাচনে মেরুকরণ ও পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতিতে তফসিলি জাতিভুক্ত মতুয়াদের সমর্থন পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশাতীত ভাল ফল করেছিল বিজেপি। আগামী বছরের লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে তারা ফের একই কৌশল নিয়ে এগোতে চাইছে। তবে মতুয়াদের পরিবর্তে এ বার বিজেপির লক্ষ্য, রাজ্যের হিন্দু ওবিসি ভোটের মেরুকরণ। যার জন্য, শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওবিসি মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলে সরব হতে শুরু করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। জাতীয় অনগ্রসর কমিশনের একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বিজেপি সভাপতি জেপি নড্ডার অভিযোগ, বাংলায় ওবিসি সংরক্ষণের প্রায় পুরো লাভটাই চলে যাচ্ছে মুসলিমদের ঘরে। যদিও জাতগণনা ছাড়া কিসের ভিত্তিতে ওবিসিভুক্ত কোন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কত আর কারা কত চাকরি পেয়েছেন তা জানা যাচ্ছে, এই পাল্টা প্রশ্নে সরব হয়েছেন বিরোধীরা।
গত সপ্তাহে জাতীয় অনগ্রসর কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরেই চলতি বিতর্কের সূত্রপাত। অনগ্রসর কমিশনের চেয়ারম্যন হংসরাজ গঙ্গারাম আহির বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের তালিকাভুক্ত ১৭৯টি ওবিসি গোষ্ঠীর মধ্যে ১১৮টি মুসলিম সম্প্রদায়ের। তার পরেই গেরুয়া শিবিরের অভিযোগ, এর ফলে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের প্রশ্নে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন ওবিসি শ্রেণিভুক্ত মুসলিমরা। তার জবাবে বিরোধীদের প্রশ্ন, ওবিসিদের জনসংখ্যা কত, সেই হিসেব ছাড়া শুধু ওবিসি সম্প্রদায়ের সংখ্যা গুনে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা যাবে কী করে।
গত কাল হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুরে গিয়ে বিজেপি সভাপতি জেপি নড্ডা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই রাজস্থান, বিহার, পঞ্জাবের মতো অ-বিজেপি সরকারগুলি সবাই ওবিসি সংরক্ষণের নামে মুসলিম তোষণের রাজনীতি করছে বলে অভিযোগে সরব হন। নড্ডা দাবি করেন, ‘‘রাজ্যে (বাংলায়) সংরক্ষণের যে সুবিধা রয়েছে, তার ৯১.৫ শতাংশ ফায়দা নিয়ে যাচ্ছেন মুসলিমরা। বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে।’’
উল্টো দিকে তৃণমূলের বক্তব্য, কোন কোন সম্প্রদায় ওবিসি শ্রেণিভুক্ত হবেন, সেটা জাতীয় অনগ্রসর কমিশনের অনুমোদনের ভিত্তিতেই স্থির হয়। এখানে তোষণনীতির কোনও প্রশ্ন নেই। তৃণমূলের দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য বিজেপি ফের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের যুক্তি, রাজ্যের ওবিসি তালিকায় হিন্দু বা মুসলিম কারও অন্তর্ভুক্তিই অনগ্রসর কমিশনের সম্মতি ছাড়া হয় না। জাতীয় অনগ্রসর কমিশনের চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ হংসরাজ আহির আসলে একটি সম্প্রদায়কে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে চাইছেন। ঈশান কোণে ভোটের ছায়া পড়েছে বলে ওবিসি সমাজকে বিজেপি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করতে চাইছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, পার্শ্ববর্তী বিহারে জাত-পাতের রাজনীতিতে ভোট হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গোড়া থেকেই জাতভিত্তিক ভোটের রাজনীতির গণ্ডির বাইরে থেকেছেন। একদা ওবিসিভুক্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে স্বেচ্ছায় ওবিসি-তালিকা থেকে বেরিয়েও গিয়েছে। কিন্তু গত এক দশকে মতুয়াদের নিয়ে রাজনীতি করে প্রথমে তৃণমূল ও পরে বিজেপি বাংলার ভোট রাজনীতিতে নতুন ধারার প্রবর্তন করে। তবে গত লোকসভায় মতুয়াদের বিপুল জনসমর্থন পেয়েও মতুয়াদের দাবি মতো সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। ফলে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের বড় অংশ ভরসা হারিয়েছেন বিজেপির উপরে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, সেই কারণে বিকল্প হিসাবে লোকসভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গের ওবিসি হিন্দু সমাজকে নিজেদের ছাতার তলায় আনার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন নড্ডারা।
ঘটনা হল, রাজ্যের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পশ্চিমবঙ্গে জাতিগণনার দাবি তুলেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে একটি বহুজাতি কমিশন তৈরির দাবিও ছিল। এখন প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্রীয় শাসক দল সেই দাবিগুলি পূরণ না করে মেরুকরণের রাজনীতি করছে কেন?
অনগ্রসর কমিশন তার রিপোর্টে হিন্দু, মুসলিম ওবিসি-রা জনসংখ্যায় কত শতাংশ সেই হিসাব দিয়েছেন। এনআরসি-বিরোধী যুক্ত মঞ্চের আহ্বায়ক প্রসেনজিৎ বসুর প্রশ্ন, জাতিগণনা ছাড়া এই হিসেব কোথা থেকে এল! ২০১২ সালে রাজ্যের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি আইনে ১৪৩টি সম্প্রদায় ওবিসি-ভুক্ত হয়েছিল। এখন সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৯। ‘‘বিজেপি যদি মনেই করে, ওবিসি হিন্দুরা বঞ্চিত হচ্ছেন, তা হলে জাতগণনাই সেই সমস্যা সমাধানের উপায়। বিজেপি কেন তাতে রাজি হচ্ছে না?’’ প্রসেনজিতের আরও বক্তব্য, ‘‘চাকরিতে সংরক্ষণ থাকা আর চাকরি পাওয়া এক নয়। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও ২০১৫-র পর থেকে কোনও জাতগণনা হয়নি। তা হলে ওবিসি মুসলিমরা যে বেশি চাকরি পাচ্ছেন আর ওবিসি হিন্দুরা বঞ্চিত হচ্ছেন, সেটা জানা গেল কী ভাবে?’’ তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের দাবি, ‘‘অনগ্রসর কমিশনের কর্তা ও জেপি নড্ডারা বাংলার মানুষের উন্নয়ন নিয়ে যদি এত চিন্তিত হন, তা হলে নরেন্দ্র মোদী সরকার পশ্চিমবঙ্গের যে ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা আটকে রেখেছে, তা যাতে রাজ্য পায়, সেই ব্যবস্থা করে দিক।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)