Advertisement
২০ মে ২০২৪

স্বগতোক্তির বৈশাখ

আমি তো জানি কে জন্মায়। আমার রবীন্দ্রনাথ জন্মায় ওই খাঁ খাঁ বৈশাখে। খাঁ খাঁ গ্রীষ্মে, আমি ওঁকে বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরে বেড়াই আর ভাবি—বুঝতে পারি, কিছুই করিনি এত দিন। শুধু শুধু ঘুরে বেড়িয়েছি। এলোমেলো লিখেছি দু’চার লাইন। কিছুই করিনি। তবু ভান করেছি, যেন কত দূর অবধি আমি জানি। যতদূর পর্যন্ত এই তারাপথ ছড়ানো, ততটাই ছড়িয়েও ফেলেছি নিজেকে। ক্ষয় করে ফেলেছি।

লিখলেন রূপক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আমি তো জানি কে জন্মায়। আমার রবীন্দ্রনাথ জন্মায় ওই খাঁ খাঁ বৈশাখে। খাঁ খাঁ গ্রীষ্মে, আমি ওঁকে বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরে বেড়াই আর ভাবি—

বুঝতে পারি, কিছুই করিনি এত দিন। শুধু শুধু ঘুরে বেড়িয়েছি। এলোমেলো লিখেছি দু’চার লাইন। কিছুই করিনি। তবু ভান করেছি, যেন কত দূর অবধি আমি জানি। যতদূর পর্যন্ত এই তারাপথ ছড়ানো, ততটাই ছড়িয়েও ফেলেছি নিজেকে। ক্ষয় করে ফেলেছি। আজ জড়ো করতে গিয়ে দেখি এত রকমের বিসদৃশ সব টুকরো যে জোড়া লাগানোর কথা না ভাবাই ভাল। না, কিছুই করিনি, কিচ্ছু না। বছর অবহেলায় উড়িয়েছি। যে ভাবে শনিবার শনিবার অন্যের পয়সায় দুপুর থেকে বসে থেকেছি রেসকোর্সে। ভুল ঘোড়ার উপর বাজি ধরে উড়িয়েছি পয়সা। যদি বা জিতেছি, তাও খরচ করেছি যে ভাবে মধ্য কলকাতার নিভু নিভু পানশালায়। আশ্চর্য লাগে!

এ সবই ছিল লেখার আয়োজন। যেন লিখব বলেই এ সব করতে হয়। তাই করে গেছি শুধু লেখা বাদে। ছেচল্লিশটা বছর কাটতে কাটতে দেখি সময় চলে গেছে। অনেক সময় চলে গেছে। এই শহরটা-রাজ্যটা-দেশটা-মহাদেশটা-পৃথিবীটা বেশ বুড়ো হয়ে গিয়েছে। লাবণ্য কেটে গিয়ে রুক্ষ ভাব এসেছে সর্বত্র। আকাশ কেমন পাঁশুটে। অথচ এই সে দিনও এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে ছুটে যেতে দেখেছি ট্রাম। তার দু’লাইনের দু’পাশে বসে থাকা পায়রার দল উড়ে গেছে ফরফর ফরফর করতে করতে।

আজকাল বিকেল হতে সূর্য ঢলতে ঢলতেই ভয়ানক মন খারাপ হয়ে যায়। কোনও কাজ শেষ করা হল না। কত কাজ বাকি রয়ে গেল। আরও একটা দিন বয়স বেড়ে গেল। দোকানপাট, রাস্তাঘাট, লোকজনের মধ্য দিয়ে বাড়ি ফিরি। ফিরতে ফিরতে দেখি, রাস্তার কমলা রঙের আলো জ্বলে উঠেছে। পৃথিবীতে এখন সুসময়। সুসময় যার যার নিজের নিজের পৃথিবীতে। কত রকমের নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী-সন্তানসন্ততি পরিচয় নিয়ে এক সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেনাকাটা করছে। রেস্তোরাঁয় খাচ্ছে বসে। বাতাসে গরম ভাব। তাও উপেক্ষা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুখী-অসুখী কতরকমের মানুষ। এই বিরাট গ্রহটার অতি ছোট শহরের এক রাস্তায় ট্রাম-বাস-অটো চলেছে। একটু ফাঁকা জায়গায় অন্ধকারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা। তাদেরও নিয়ে কোনও কোনও ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে। ট্যাক্সিতেই আহ, সব যৌনতার নিবৃত্তি। এই সব দেখি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে এ সবই দেখি। ফিরে দেখি গলিতে হলুদ একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে উঠেছে। দশভূতের বাড়ির উঠোনে টিউব জ্বলছে। তার উপরে-নীচে-ময়লা ও মাকড়সার ঝুল। কেউ পরিষ্কার করার নেই। দেখি ছোট ঘরে মা ঘর অন্ধকার করে বসে আছে আর খানিক ভাঙা গলায় গুনগুন করছে—তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে, কুসুম ঝরিয়া পড়ে, কুসুম ফোটে...। মা রোজই এই গান গায়। কেন যে মা এই গান গায় বুঝি না। ঘরের টিউব জ্বালতে দেখি মা-র ভাঙাচোরা কালচে মুখ। আমার নিয়ে দুর্ভাবনায় হয়ে আসা সাদা চুল। একটা অসহায় ভাব। আর এক রাশ গোপন করা অসুখ। মায়েরও এক দিন শৈশব ছিল। মায়েরও একদিন মা-বাবা ছিল। সত্যি, মা এক দিন ছোট ছিল এ কথা ভাবতেই অবাক লাগে। মা যেন ছোট থেকেই বড়। ছোট থেকেই মাকে দাদু পড়াশুনা করাতে চায়নি কারণ, মেয়ে বলে। মামাদের পিছনে অর্থ সময় ব্যয় করেছে। আর মা যেন কোথা থেকে কোথা থেকে বড় হয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন আমার পাকিয়ে আসা ঝামেলাগুলো একা হাতে। বাবা নেই। একা হাতে সামলেছে। আমি মা-র পাশে বসি। আমি মা-র পাশে বসলে মা এক রকমের স্বস্তি পায়। বোঝে অন্য দিনের মতো ছেলের গায়ে আজ আর বিচ্ছিরি রকমের টকটক গন্ধ নেই। জিজ্ঞেস করে, চা খাবি?

তুমি খাবে?

তুই খেলে খাব।

তা হলে বানাও।

চিড়েভাজা খাবি?

তুমি খাবে?

দু’জনে চা-চিড়েভাজা খাই। খেতে খেতে অন্যমনস্ক ভাবে মনে পড়ে, এখন পার্ক স্ট্রিটে কোন কোন পানশালায় কী তুমুল আড্ডা জমেছে। এই বার চার নম্বর রাউন্ড চলছে। এখন বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে মারামারি-কাটাকাটি চলেছে। খেউড় হচ্ছে। তরজা গান। ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।

টের পাই, মা কখন ডান হাত দিয়ে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কেন, কে জানে? কেন মা আমার গায়ে-পিঠে হাত বুলোচ্ছে, বুঝতে পারি না। আমাকে কখনও মা বাধা দেয়নি। রাজ্যের লোক এসে বলেছিল— ছেলেকে সায়েন্স পড়াও। আমি বাংলা পড়েছি। জীবন গোছাতে পারিনি। একটার পর একটা ভুল করে গেছি। সবাই ছেড়ে গেছে। মা ছেড়ে যায়নি। কেন যে মা আমাকে এ ভাবে আড়াল করে রেখেছে! এ নিয়ে আমার চার পাশের লোকেরা কম মন্তব্য করে না। তারা মা-র এই আড়ালকে কত গাল পাড়ে। আর আমি বুঝতে পারি—কিচ্ছু গোছাতে পারিনি, কিচ্ছু না। অকাতরে অবলীলায় ছেচল্লিশটা বছর নষ্ট করে ফেলেছি। এই সন্ধেটা আস্তে আস্তে রাত হবে। রাত্রি গভীর হলে সূর্যটা তলহারা এক আকাশের ও পাশে সমুদ্রে ডুবে যাবে। আর তাৎক্ষণাৎ আকাশে শুরু হয়ে যাবে দেওয়ালি। কলেজ স্ট্রিটের সারা বছরের বইমেলার মতোই আজীবনের দেওয়ালি। নতুন আকাশ পুরনো আকাশ মরে যাওয়া নক্ষত্রের আলো ধুমকেতু, নীহারিকা—ওহ, আশ্চর্য মহাকাশ ফুটে উঠবে আমাদের ছাদের উপর, উঠোনের উপর। আর দেখতে দেখতে রাত বেড়ে যায়। বিছানা করা, রুটি খাওয়ার মধ্যেই রাত বাড়ে।

নিজের ঘর থেকে সিগারেট খেতে খেতে শুনি, মা এফ এম শুনছে। যেহেতু ঘুম আসছে না। সচরাচর মা-র ঘুম আসেও না। তাই এফ এম শুনছে। আমি জানলার পাশে এসে সিগারেট ধরাই। জীবনটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। খুঁজে বার করি ভুলগুলো। আকাশের দিকে তাকাই। ভুলগুলো মিলিয়ে যায়। তার বদলে এক মহাজাগতিক ভেলা ভেসে ওঠে। অতিপ্রাচীন সব গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যের হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকা সব গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। ময়ূরমুখী এক ভেলা। তার অনন্ত মাস্তুল উঠে গিয়েছে এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের কিনারায়। তার আশ্চর্য শান্তি রঙের পাল তুলে রয়েছে। সেই বেলার ওপর বেশ কয়েক জন সুদর্শন যোদ্ধা। তারা কী এক অত্যাশ্চর্য শক্তিতে ওই ভেলাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে গ্রহ-তারা-গ্রহ-তারা-গ্রহ-তারায়।

কী ভাবে পুড়িয়ে ফেললাম ছেচল্লিশটা বছর। আমি কী আবারও জন্মাব? আবারও এই মা’কে, বাবাকে পাব? এই বাড়ি-বন্ধুবান্ধব, এই ভাষা-শহর—পাব কী এ সব? কিচ্ছু জানি না। তা হলে কেন আমি এত দিন এ ভাবে জ্বালানিহীন রকেটের মতো অন্ধকার-শূন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেন নিজের আয়ুর সঙ্গে মা-কেও এনে ফেলেছি এই উত্তরহীন এ রকম একটা জায়গায়?

কিন্তু যে দিন বিকেল থেকে আমি ঠিক করে রাখি, আজ কিছু একটা হেস্তনেস্ত হবে। আজ এসপার-ওসপার হবে একটা। সে দিন ওই খালাসিটোলায় সুরিন্দরের দোকানে থেকে আলুকাবলি কিনে নিয়ে—। তার পর দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

না, জল আর কোথাও গিয়ে দাঁড়াবে না। গড়িয়ে যেতে থাকে। এর পরে একজন। তার পরে আরও একজন, তার পরে আরও আরও....এই ভাবে করতে করতে বৃত্তটা বড় হয়ে য়ায়। গলায় সুর চড়তে থাকে। ধার-দেনা হতে থাকে। সিগারেট বাড়তে থাকে। কারও কাছ থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে, কতই তো চেনাজানা। অথবা রাস্তায় বেরিয়ে কোথাও থেকে ফোন করে ঈষৎ বিকৃত গলায় জানিয়ে দেওয়া। হ্যাঁ মা, একটু দেরি হবে। ততক্ষণে রক্তে কী যেন এক তোলপাড় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ওই অসহ্য বাংলা মদই মনে হয় অমৃত। এ যেন খেতে ভাল লাগে না, অথচ খাওয়ার পরেই কী অসম্ভব আনন্দ শরীরজুড়ে। তখনই মনে হয়—হ্যাঁ, এই তো জীবন। এই ভাবেই তো কাটিয়ে যাওয়া উচিত। এই ছেচল্লিশ বছরেই যা লিখেছি, তাই রয়ে যাবে আমার ভাষায়। সোনার অক্ষরে। আরও রাত বাড়ে। কে যেন প্রস্তাব দেয়—মাসিমাকে বলে যে, আমার বাড়ি থেকে যাবি।

মনে হয় কতদিনই তো মা-র সঙ্গে রইলাম। থাকি না এক রাত বাইরে। আরও আরও বেশি মদ, আরও আরও বেশি হুল্লোড়। দেখবি নাকি এক বার রবীন্দ্রসদনের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে মেয়ে তুলে? না না, মেয়ের দরকার কী, বরং সময় তোলা থাক ছেচল্লিশটা বছর কিছু নয়। কাল থেকে লিখতে বসলেই হবে।

কাল আমার আর কোনওদিন এল না। অন্যের নাম ভাঁড়িয়ে আতিথেয়তা নিতে গিয়ে সেই রাত্তিরে একা একা টের পাই আমার মধ্যে সূর্য বেশ হেলে গিয়েছে। এই সব হই-হুল্লোড়, পাতলা ইয়ার্কি করতে করতে কখন যেন হেমন্তকাল এসে গিয়েছে। মাঠে মাঠে ধান কাটা সারা। কে যেন একটা আকাশপ্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে শিউলিমঞ্চের পাশে। মেজদি নাকি? মেজদিও কেমন করে জানি প্রায় ষাটটা বছর শেষ করে ফেলল। কেউ এক বার ফিরেও তাকাল না মেজদির দিকে। মেজদিরও দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে গেল। মেজদি আমার জ্যাঠার মেয়ে। তবু আমি, মা আর মেজদি বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে যেন এক পরিবারে এক হাঁড়ির আত্মীয়ের মতো মিশতাম। মাসে এক বার তিন জনে গিয়ে বসে থাকতাম দক্ষিণেশ্বরে। সন্ধ্যা নামল গঙ্গার পারে। দূরে বালি ব্রিজ। ছোট ছোট আলো জ্বলছে। দূরের যাত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন। তার ভেতর আরেক পৃথিবী। প্রতিটা জানলায় একটা-একটা গল্প। এখানে দক্ষিমণেশ্বর ঘাট থেকে ইঞ্জিন লাগানো নৌকো ছাড়ল। ভটভট ভটভট শব্দ করতে করতে চলে গেল বেলুড়ের দিকে। আমি, মা আর মেজদি বাদে আমাদের চার পাশে অজস্র জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকা বসে আছে। তাদের কত রকমের কথা রয়েছে। মেজদিও চেয়েছিল একটা সংসার পেতে, ছেলেমেয়ে-স্বামী নিয়ে সংসার করতে। মাও ভেবেছিল বাবা অনেক দিন বাঁচবে। বিয়ের সতেরো বছরের মাথায় এ ভাবে বাবা চলে যাবে, মা ভাবেনি। আমিও ভেবেছিলাম, যে মেয়েটাকে জগতে সবচেয়ে ভালবেসেছি তাকে বিয়ে করব। একদিন একটা গয়নার দোকানে দু’জনে ঢুকে বসেছিলাম। সে কী সব দেখছিল। সেই দোকানের বাঁয়ে-ডানে-ওপরে-নীচে সর্বত্র আয়না দেখতে পাই। দেখতে পাই সবচেয়ে ভালবেসেছি যে মেয়েটাকে, তার ছোট হাতা জামার মধ্য বেরিয়ে এসেছে অত্যাশ্চর্য সুন্দর দুধ সাদা দুটো হাত। যেন ফুলদানি। আমি স্তম্ভিত হয়ে থাকি। কেন আমি এত দিন এই হাত দুটো খেয়াল করিনি, ভেবে বেদনা বোধ করি। পর দিনই আরও চমকে যাই, সে যখন একটা বাসস্টপে আমার জন্যে দাঁড়িয়ে গভীরতম কালো রঙের একটা পোশাক পরে। তখন সেই কালো পোশাকের ওপর সেই দুধ সাদা হাত। এ কী আষাঢ় মাসের কোনও ছবি নয়। ও কি মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎরেখার প্রস্তাব নয়। তবু সেই প্রেমও আমার মুঠোর মধ্যে থেকে পড়ে খান খান হয়ে ছড়িয়ে গেল বাহান্নটা টুকরোয়। একান্নটা পীঠ হল, আর বাকি একটা আমি নিজের মধ্যে রেখে দিয়েছি। শুধু সময় চলে গিয়েছে। এই ভাবেই সময় চলে গিয়েছে। কোনও কিছুই কাজ হয়নি। অকারণে অপমান করা হয়েছে লেখার ছলে। কখনও মুখে, কখনও লিখে, কখনও মদের ছদ্মবেশে—যা নয়, তাই অপমান করা হয়েছে। আজ ছেচল্লিশটা বছর বাদে টের পাই, একটা দুর্দান্ত চলে যাওয়া হচ্ছে। একটা দিনের সূর্যাস্ত হচ্ছে।

এখন এই শহরটারও সূর্যাস্ত হচ্ছে। আমাদের ছোটবেলায় হলুদ রঙের জামা পরে একটা বুড়ো আসত নাতি অথবা ছেলেকে নিয়ে ডাফলি বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষে করত। লক্ষ্মীপুজোর দিন মাঝরাতে আসত ঢাকি। যাতে অলক্ষ্মী ঢুকতে না পারে। ট্রাম লাইনের দু’পাশে ছিল মোটা মোটা কালচে রঙের অজস্র পাতওয়ালা গাছ কতশত। ছিল মাসে এক বার ঠাকুমার স্বপাক ছেড়ে মায়ের রান্না খেতে দোতলা থেকে নেমে আসা। সে সব বদলে কখন শহরের বুকের ওপর উঠে দাঁড়াল ফ্লাইওভার। পাঁচ হাজার টাকায় মানুষ খুন করার ব্যবস্থা হতে লাগল। ধুলোয় ধুলোয় ভরে গেল শহরটার রাস্তাঘাট। শুধুমাত্র মদ খাওয়ার জন্য পয়সাওয়ালা ব্যর্থ কবিদের প্রশংসা করে পানশালা থেকে পানশালায় ঘুরে বেড়ালাম। সপ্তমীর দিন নীলকমলের তিন তলায় মায়ার ঘরের সামনে বসে বিয়ার খেতে খেতে আমি আর বুড়ো আবিষ্কার করি, এক ভদ্রমহিলা দু’হাতে দুটো বাচ্চা ছেলে নিয়ে উঠে এসেছেন যাঁর কখনওই এখানে আসার কথা নয়। ডান দিকের হাতে ধরা ছেলেটা অন্যটার তুলনায় বড়। সে বার বার বলে, মা বলছি তোমায়, বাবা এখানে নেই। আর ভদ্রমহিলা বলেন, ওরে না, তোর বাবা এখানেই আসে। তবে তো শুধু একা আমারই না। এই যে এত অত প্রাণ, এত এত মানুষ এই দুর্লভ মানুষ জন্মটা পেয়ে এ ভাবে হেলায় হারাল, তার কী হবে, আমি জানব কী করে? সেই যে বাঙালি বাড়িতে রিন্টি নামের মেয়েটা ব্রতীনকে বলেছিল, দিদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে? আমি দিদিকে বলেকয়ে থেকে যাব তোমার সংসারে, খাওয়া-পরা কাজের লোকের মতো। আমি বেরিয়ে এসেছিলাম প্রায় দুশো বছরের পুরনো বাড়ির ছাদটায়। পা টলে গিয়েছিল। অতটা মদ খেয়ে টলে গিয়েছিল পা। অকারণে জল এসে গেছিল চোখে। ব্রতীন তো কখনও, কখনও বলতে আজকের পর আর কোন ওদিনই ফিরে আসবে না ওর কাছে। তা হলে কেন আমার চোখে জল এল। ওই মেয়েটার মতো নানা রকম উঞ্চবৃত্তি করতে করতে আমিও অনেকটা আয়ু ক্ষয় করে ফেলেছি। এক দিনের জন্য মাকে একটু ভাল রাখতে পারিনি এখনও। অথচ মা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছে আমার জন্য। আজও মা একা যায় ডাক্তার দেখাতে। আমাকে ডাকে না, কেননা সে সময় ছেলে যদি কিছু লেখে—এই আশায়।

সত্যি কী আর সময় নেই আমার হাতে। সত্যি কী সব পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে শেষ করে ফেলেছি? কখনও কখনও এই রাত্রের আকাশ দেখলে আমার প্রেমিকার কথা মনে পড়ে। কেন জানি না মনে হয়, কোনও এক শৈলশহরে সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ের ধাপে বানানো বাড়ির সামনেরটায় একটা প্রদীপ জ্বেলে এসে সে চাইল আরও আরও পরিষ্কার ঝকঝকে ঝলমলে রত্নখচিত এক আকাশের দিকে। সে যে তারাটার দিকে চাইল, আমিও ঠিক সেই সময় সেই তারাটার দিকেই চাইলাম। কত কত বছর বাদে সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে আবার আমাদের চোখাচোখি হল। অথচ, কত কত দূরে দু’জন দুটো শহরে রয়েছি। তবুও এই প্রসন্নতা আমাকে উজ্জীবিত করে না। দেখতে পাই বাড়িটার বয়স হয়ে গেল। চারপাশের যারা ছিল, তারা চলে গিয়েছে নতুন নতুন মুখ জায়গা নিচ্ছে। ছোটবেলার বন্ধুরা এখন কোথায়? তার জায়গায় আরও কত কত সব মানুষজন অপরিচিত থেকে পরিচিত হয়ে উঠছে। হিমালয় খুব বড় হলেও ধীরে ধীরে আরও বড় হচ্ছে। পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছে দিনে দিনে। দুই মেরুর বরফ গলছে। সমুদ্রের জল বাড়ছে। এই নীলাভ গ্রহটার বুক থেকে প্রতিদিনই কোনও না কোনও কীটপতঙ্গ-প্রাণী মুছে যাচ্ছে। আবার দুর্গম থেকে দুর্গমতর অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের পরিচয়।

মায়ের রান্নার স্বাদ কমে আসছে। অতিরিক্ত বিষাদে থাকতে থাকতে মা এখন আর সন্ধেবেলা ঘরে আলো জ্বালে না। মেজদিও দোতলায় নিজের ঘরের সন্ধেবেলার আলো জ্বালে না। অন্ধকারে বসে থাকে দুটো ভাঙাচোরা মানুষ। বিষাদ তাদের আরও ক্ষয় বাড়িয়ে তুলছে। একদিন এই জীবনটার সমাপ্তি ঘটে যাবে। এক দিন লাখ লাখ প্রাণের সঙ্গে আমিও পড়েছিলাম এই সুন্দর পৃথিবীতে। আমারও কত কাজ ছিল। অথচ কিছু করিনি আমি। শুধু এক ধূসর প্রান্তরের মাঝখানে রথ নিয়ে এসে ডুবে থাকি বিষাদে। শুধু এক বিরাট পুরুষ আমায় বলে, তোলো গাণ্ডিব তোলো। গাণ্ডিবে কলম যোজনা করো আর লেখো। শব্দ-বাক্যব্যতীত কিছুই থাকবে না। তবু আমি বিকেলবেলা একলা একলা হাঁটতে হাঁটতে টের পাই—হ্যাঁ, সূর্য ঢলে গিয়েছে। আমার মধ্যে এসেছে এখন এক রুক্ষতা। চারদিকে দেখি, পৃথিবীময় এক আশ্চর্য সুসময় এসে গিয়েছে। মানুষরা অনেক ভাল আছে। যেই মুহূর্তে আমি দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে এসে দাঁড়ালাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই কোনও স্বামী-স্ত্রীর মিলনে এই ভর বিকেলেই কোনও প্রাণের এ পৃথিবীতে আসা নিশ্চিত হয়। শুধু আমি অকারণে এতগুলো দিন নষ্ট করেছি। আরও আরও ভাল থাকার চেষ্টা করিনি। আরও আরও ভাল থাকার ব্যবস্থা করিনি। এই ভাবে বাড়ি ফিরে খেয়ে উঠে জানলার কাছে আসি। এখন অনেক রাত। সমস্ত আকাশ জেগে আছে। কেন আমি বার বার নিজেকে জড়িয়ে ফেলি, হারিয়ে ফেলি? ভাবি। ভাবতে ভাবতে দেখি, দলে দলে গ্রহ-তারা সব চলেছে। ক্রমশ এ বিশ্ব বড় হচ্ছে। শুনতে পাই, অত গভীর রাতেও মা-র ঘরে এফএম চলছে। এর পরও মা আবার ভোরবেলা উঠে আমাকে চা বানিয়ে দেবে। বালিগঞ্জের দিক থেকে একটা ট্রাম এইমাত্র টালিগঞ্জের দিকে বেঁকল। একটা, আরও একটা দিন কেটে গেল। কিছু করা হল না। শুধু ছেচল্লিশটা বছর শেষ হয়ে গেল। তার সঙ্গে আরও একটা দিন যোগ হল। তবে আমাদের কবির কথায় বলতে পারি—

অলীক, তোমার স্বপন থেকে শান্ত হাতের একটি দুটি
রৌদ্রপোড়া সাহস

আমায় ঋণ দিয়ে যাও, দোলের দিনে

আবিসন্দর খেলতে ঋণ দিয়ে যাও অলীক তোমার

সকল তামস কলুষ হরণ

গানের অমন ঝর্নাতলায় হাসতে পারি খেলতে পারি

এমন একটা দিন দিয়ে যাও খন তোমার সোনার বরণ

গ্রীষ্মে লেগে কাতর তখন হাতের কাছে হাতপাখা নাও, রৌদ্রোপোড়া

হাতপাখা নাও, তাকিয়ে দেখি হাতপাখাটি, তাকিয়ে দেখিশ

কোলের উপর গ্রীষ্ম লুটাও বর্ষা লুটাও

অলীক তোমার স্বপ্ন থেকে আর একটিবার

শান্ত হাতে আদর করার একটু দুটি

ছল খুঁজে দাও রৌদ্রোপোড়া....

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE